বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

দত্তকথা ৮

৮ম পর্ব
______________
১৩ জানুয়ারী সর্বশেষ পারিবারিক ইতিহাস বৃত্তান্তের কথা লিখে আজ আবার ৮ম পর্ব লিখতে বসলাম। বিগত পর্বগুলোতে এই পরিবারের কয়েকজন দিকপালের দিকেই বেশী নজর দেয়া হয়েছে। নজর দেয়া হয়েছে তাদের কীর্তিগাঁথার ওপরই বেশী! তাদের ধনপ্রাচুর্য্যের আভাস দেয়া হলেও তার কোনরকম বিবরণ দেখাইনি এবং সেটা এখনও প্রয়োজন মনে করছি না। তাদের এত বৈভব কি করে বিলুপ্ত হল এবং চট্টলের ইতিহাসের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত হয়েও কি করে তার নামগন্ধও বলতে গেলে একেবারেই মুছে গেল সে প্রসঙ্গেও কথা হবে। তবে আজকের পর্বে আমি আমাদের পরিবারের কথা বাদ দিয়ে সামগ্রিক ভাবে 'দত্ত' এর ব্যুৎপত্তি নিয়ে কিছু কথা লিখতে চাই। যাতে আশা করি কেউ কেউ উপকৃত হবেন। উল্লেখ্য যে 'দত্ত' একটা ক্ষত্রিয়কূলোদ্ভব কায়স্থ surname. কোন আলাদা বর্ণ নয়! আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস- ওসব বর্ণের বালাই যত দ্রুত মরে ততই আমাদের কল্যাণ হবে।
বাংলাতে কায়স্থ শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে গুপ্ত শাসনামলেরও আগে (৩২০-৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ)। সে সময় কায়স্থ বলতে বিভিন্ন বর্ণের মানুষের একটা সংমিশ্রিত শ্রেণী বোঝান হত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় সব মিলে। (সে সময়ে বাংলায় ব্রাহ্মণ ছিল কি না তা নিয়ে ভাবতে হবে!) গুপ্ত যুগের পরই কায়স্থরা বাংলায় একটা আলাদা বর্ণ (caste) হিসেবে সংগঠিত হয়। পাল, সেন শাসনামলে বাংলায় কায়স্থরা সবচেয়ে উচ্চবর্ণ হিসেবে সমাজের মাথা হয়ে থাকত। 'দত্ত' সেইসব কায়স্থদেরই একটা surname. বৈদ্যকূলেও 'দত্ত' টাইটেল এর প্রয়োগ দেখা যায় অবশ্য তারা পেছনে গুপ্ত অথবা শর্মা লাগিয়ে নেন। আধুনিক সমাজে কায়স্থদের মধ্যে বর্ণকেন্দ্রিক ক্যাঁচাল দেখা না গেলেও 'বৈদ্য'রা এসবে ব্রাহ্মণদের চেয়ে বেশী গোঁড়া। তাদের কথা নাই বা বলি। দত্তদের বাংলায় কি অবস্থান ছিল সেটা সম্পর্কে এই তথ্য থেকে মনোমত ধারণা করা যায়। তবে দত্তদের উৎপত্তিস্থল বাংলা কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে আমার। আসামে দু'ধরণের দত্ত দেখা যায়। এদের একটা অংশ 'কোচ রাজবংশী' সংক্ষেপে 'কোচ' এবং 'কলিত' জনগোষ্টীর মধ্যে পরে। 'কোচ'দের আগমণ ধরা হয় সাধারনত নেপাল থেকে। পরবর্তীতে তারা বাংলার কুচবিহার এবং বিহার ও আসাম রাজ্যে ব্যপ্ত হয়। এই 'কোচ' জনগোষ্টীদের মধ্যে 'দত্ত' লেখার চল আছে। এতে এটাও অনুমান করা যেতে পারে যে হিমালয়-উপত্যকার দিকেও এই দত্তদের চলাচল ছিল। এদিকে 'কলিত দত্ত'রা আবার মধ্যযুগে প্রবর্তিত 'একশরণ ধর্ম' এর অনুগামী এবং মূর্তিপূজাবিরোধী। আসামের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে এদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান আছে। সে যা-ই হোক, আসামের দত্তদের ইতিহাস দেখে মনে হয় তারা সেখানে একটা আদি জনপদের বাসিন্দা হলেও একেবারে আদিবাসী হয়ত নয় এবং খুব উচ্চবর্ণ হিসেবেও তাদের স্বীকৃতি নেই যেটা বাংলায় দেখা যায়। প্রশ্ন হল- কোচ, কলিত, কায়স্থদের মধ্যে 'দত্ত' এর ব্যবহার কি আলাদা আলাদা সময়ে আলাদা আলাদা ভূখন্ডে হয়েছে? সেটা আসলে কতটুকু সম্ভব? একটু মনযোগ দিয়ে ভাবলে সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বরং এটা ভাবাই সমীচীন হয়ত যে- 'দত্ত'রা কোথাও একটা বৃহৎ জনগোষ্টী (clan) হিসেবে ছিল এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে তারা বিভিন্ন কারণে নানান স্থানে বিভক্ত হয়েছে। সেসময় 'টাইটেল' পালটে স্ট্যাটাস বাড়ানোর মত মনোবৃত্তি কারো ছিল বলে তো মনে হয় না! দত্তদের সবচেয়ে পুরনো অবস্থান দেখা যায় উত্তরভারতে। আমার নিজের পরিবারের উৎপত্তি দেখাতে গিয়ে আমি সে দিকে আলোকপাত করেছি। 'পরাশর' গোত্রের অধিকারী দত্তরা 'বিষেণ ক্ষত্রিয়' ও রাজপুত বলে জেনেছিলাম। গোত্র রীতি অনুযায়ী 'পরাশর' ব্রাহ্মণ বলেই আমার চিরকাল আমাদের পারিবারিক বর্ণ নিয়ে সংশয় ছিল। যত এই বিষয় নিয়ে আরও গভীরে যাচ্ছি তত সংশয় আরও বাড়ছে। যেহেতু কায়স্থ সমাজে ব্রাহ্মণ বর্ণের সংমিশ্রণ ছিল সেহেতু অনেক কায়স্থের ব্রাহ্মণ গোত্র থাকা, মানে origin ব্রাহ্মণ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আবার এদিকে কায়স্থদের 'পরাশর' গোত্র আবিষ্কার করতে গেলে একমাত্র রাজপুতদের 'বিষেণ' কূলেই এর ব্যবহার দেখি। বাংলাতে ব্রাহ্মণদের মধ্যেই শুধু 'পরাশর' হয়। তাহলে আমরা কি সেই 'বিষেণ ক্ষত্রিয়'? নাকি এখানকারই কোন পরাশর বামুনের প্রজন্ম? আসলেই বের করা মুশকিল। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার দত্তরা 'মোহিয়াল ব্রাহ্মণ' ও এরা ভরদ্বাজ মুনির গোত্রে বলে জানা যায়। ওই অঞ্চলে দত্ত মানে ব্রাহ্মণই। আরও একটা মাথা গুলিয়ে ফেলার বিষয় হল 'বিষেণ ক্ষত্রিয়'দেরও 'ভরদ্বাজ' গোত্র লেখা হত! যে তিন চার জায়গার দত্তদের কথা বললাম তাদের মধ্যে এরাই সবচেয়ে পুরাতন। হতে পারে এদের থেকেই দত্তরা অন্যত্র ছড়িয়েছে। এই সম্ভাবনাটাই বেশী মনে হচ্ছে। বঙ্গের জনপদে ক্লাসিক্যাল আর্য রক্তস্রোত এসে মিশেছে শুধু। বাঙালী একটা সংকর জাতি। দত্তরাও একটা বড় সংকর। আরও কিছু দত্ত পরিবারের ইতিবৃত্ত বের করতে পারলে আমরা হয়ত আরও চমকদার কিছু জানতে পারতাম।
বাংলায় কায়স্থ সমাজের যশ অনেকদিনের হলেও দত্তদের সংযোজন কবে থেকে সে ব্যাপারে তো কিছু বলা সম্ভব হবে না হয়ত। কারণ এরকম specific history কে রাখতে যাবে! বিভিন্ন উপাত্ত ঘেঁটে একটু মনে হচ্ছে- মধ্যযুগের আগে বাংলায় দত্তদের তেমন ব্যাপ্তি ছিল না, অথবা কোন 'দত্ত'ই হয়ত ছিল না এখানে। তারা পরে বাংলায় এসেছে। আমার একটা বিগতপর্বে 'দত্ত কারো ভৃত্য নয় সঙ্গে মাত্র আসে' এই বুলিটির ব্যখ্যা লিখেছিলাম। আমার সংশয়ের সমাধান হয়েছে এ ব্যাপারে- এটা শুধু চট্টলার দত্তরাই বলে তা নয়- পশ্চিমবাংলার দত্তদের ভেতরেও এই বুলির প্রচলন আছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যখন এটা দত্তরা আউড়ে যাচ্ছে তাহলে তার পেছনে কোন ইতিহাস তো নিশ্চয় আছে। আমাদের পরিবারের বাংলায় আগমণ মুঘলদের সাথে ১৬৬৬ তে এবং এর নীরিখে এই বুলির সম্পৃক্ততা কি রকম হতে পারে তা লিখেছিলাম এবং এসব কথা কেবলই অনুমান। যুক্তিসঙ্গত অনুমান তো বটেই! অরুণ কুমার ঘোষ প্রণীত 'বৃহত্তর দত্তপুকুরের সেকাল-একাল'এ চোখ বুলাতে গিয়ে দেখলাম সেখানেও দত্তদের আগমনের সময়টা ১৬১০ খ্রীষ্টাব্দ পরবর্তী কোন একটা সময় অনুমান করা হচ্ছে এবং এই বুলির চল সেখানেও আছে। এই দত্তরা তবে ১৬০০ থেকে ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দের অন্তর্বর্তী সময়ে এসে বাংলায় আবাস গড়েছে তেমনই হবে। এই বুলির পেছনে আরেকটা নতুন দাবী শুনতে পেলাম- কণ্যাকুব্জ (কণৌজ) থেকে যখন বাংলায় পাঁচ গোত্রের ব্রাহ্মণদের আগমণ ঘটে তখন তাদের সাথেই দত্তরা আসেন। এই ঘটনা ১০০০ সালের দিকের কথা। যদি আসে -প্রশ্ন হল সেই দত্তরা কারা ছিল তবে? মোহিয়াল বামুন? নাকি বিষেণ ক্ষত্রিয়? নাকি উভয়ই? অথবা এই ঘটনাটাই সত্যি নয়? দাবী হল দত্তরা এই পাঁচ বামুন গোত্রের অনুচর/সহচর হিসেবে এসেছিলেন- এবং সে কারণেই তারা 'ভৃত্য নয়, সঙ্গে মাত্র আসে'। এটাও একটা ইতিহাসের প্রাসঙ্গিক অনুমান শুধু তবে আমার কাছে খুব বেশী গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। বরং দত্ত একটা ক্ষত্রিয়কূল হয়ে কোন রাজশাসনে এখানে প্রবেশ করে ও নিজেদের স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রাখার চেষ্টা করে এই বুলিটি প্রসার করে ফেলে। ব্রাহ্মণকূলের অনুচর কিম্বা সহচর হয়ে এলে এই দম্ভোক্তিসুলভ বুলিটি অত্যন্ত ক্ষীণ ও অর্বাচীনের প্রলাপের মত শোনায়। ইতিহাসের যে সময়টা বাংলায় ব্রাহ্মণদের প্রবেশ ঘটেছে বলে নির্ণীত হয়- সে সময়ের আগে থেকেই বাংলায় কায়স্থ সমাজ আছে- তবে সেখানে দত্তরা ছিল বলে আলাদা ভাবে কিছু জানা যাচ্ছে না, এমনকি কনৌজের বামুনদের সাথে তারা এসেছে সে ব্যপারেও কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ হয়ত নেই। তবে এটুকু মোটামুটি ভাবে বলা যায়- বাংলায় দত্তদের নজরে পড়ার মত নড়াচড়াটা মধ্যযুগের পর থেকে। এতে কোচ ও কলিতদের মিশ্রণও থাকতে পারে। সবাই বিশুদ্ধতম মোহিয়াল অথবা অন্য কিছু হবে তেমনও নয়।

৬টি মন্তব্য:

  1. নমস্কার। আমার পিতামহের বিশাল দত্ত পরিবার দেশভাগের আগে চাঁদপুর অঞ্চলে বাস করতেন। বিশাল, কারণ এখনো আমাদের পারিবারিক স্মৃতিতে চাঁদপুরের "পাঁচ গাঁ দত্তবাড়ি" কথাটা চালু রয়েছে। আমার ঠাকুমা আমায় বলতেন। তিনি আরও বলতেন, "দত্ত কারো ভৃত্য নয়, এ ধরায় এসেছে"। আমার পিতামহ বিশাল গোষ্ঠী সঙ্গে করেই আসেন, তাঁরা পাঁচ ভাই, এবং আরও দুঘর জ্ঞাতি - এই কয়েকটি দত্ত পরিবারের কথা অন্ততঃ আমি জানি। এখানে আপনার উল্লেখ করা "সঙ্গে মাত্র আসে" আমার কাছে নতুন, প্রথমবার শুনলাম। আমাদের গোত্র আলিম্মান। এই গোত্র আর অলম্বায়ন এক কিনা আমার জানা নেই, আপনি এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারলে বাধিত হব। আরও একটা জরুরি তথ্য দিই - এখনো আমাদের পারিবারিক স্মৃতিতে ঈশ্বরের কৃপায় আমার পিতার পূর্বতন আট পুরুষের নাম রয়েছে। এঁদের মধ্যে যিনি প্রথম, শুনেছি তিনি উজ্জয়িনী থেকে তাঁর শিশুপুত্রের সঙ্গে বঙ্গদেশে আসেন। হিসেব করলে দেখা যাবে সময়টা প্রায় তিনশো বছর আগে। আপনি ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দ উল্লেখ করেছেন, তার কাছাকাছি।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. Please mail me at coolpappu01@gmail.com
      I am someone from the area you mentioned. I'm interested to explore. Thanks in advance.

      মুছুন
  2. গুপ্তের মাঝে কি কোন ভাগ রয়েছে কি? যেমন গুপ্তের কোন গোষ্ঠী পূর্ব পুরুষ ধরে স্বর্ন কাজ করে তাহলে তারা কি বনিক সম্পাদয় নাকি কায়স্হ সম্পাদয়।

    উত্তরমুছুন
  3. নমস্কার, আমি ধ্রুব দত্তচৌধুরী...আমরা দক্ষিণ-রাঢ়ীয় শ্রেণীর 'কুলশ্রেষ্ঠ' কায়স্থ ভরদ্বাজ গোত্রীয় দত্ত...আমাদের আদি পিতা পুরুষোত্তম দত্ত কনৌজ দেশ থেকে বঙ্গদেশে এসেছিলেন...উনার উত্তরসূরিরা হাওড়ার বালিতে বসবাস করার জন্যে তাঁদের 'বালির দত্ত' হিসেবে জানা গিয়ে থাকে...এই বালির দত্তদের অনেক শাখা-প্রশাখা আছে যার মধ্যে অন্যতম হাওড়ার আন্দুলের দত্তচৌধুরী পরিবার, লোকমুখে 'আন্দুলের চৌধুরী'...আবার এই দত্তচৌধুরী পরিবারের এক শাখা হল উত্তর কলকাতার 'হাটখোলার দত্ত' পরিবার...

    উত্তরমুছুন
  4. (cntd.) আমাদের বংশতালিকা অনুযায়ী ভরদ্বাজ গোত্রীয় পুরুষোত্তম দত্ত থেকে অষ্টম পুরুষ ছিলেন নারায়ণ দত্ত...উনি সেই সময় বালক হলেই ছিলেন ক্ষত্রিয়তেজী...বংশরাজ বল্লাল সেন যখন কায়স্থদের সমাজে নিচু করার লক্ষ্যে কিছু শূদ্রাচারী নিয়মে তাঁদের বিষয়ীভূত করার চেষ্টা করছিলেন তখন নারায়ণ দত্ত সেটার প্রতিবাদ করেছিলেন সেই কারণে রাজা আমাদের এই দত্ত কুলের কৌলীনত্ব সিকার করেন নি, আমাদের 'অকুলীন' বলে ঘোষণা করেছিলেন..

    উত্তরমুছুন
  5. আমি দত্তপুকুরের দত্ত।আমরা ষান্ডিল্য গোত্র।

    উত্তরমুছুন

আমায় তুমি করছ আড়াল

  আমায় তুমি করছ আড়াল আঁচল ছায়ে তোমার কোলে, আমি বড়ই অধীর বাইরে যেতে বড়ই  ব্যাকুল, দুষ্ট ছেলে! বিশ্বভুবন দিচ্ছে সাড়া- 'ও তুই চোখ খুলে...