৪র্থ পর্ব
___________
ছোটবেলায় ঠাকুরমার মুখে একটা বুলি শুনতাম- 'দত্ত কারো ভৃত্য নয়। সঙ্গে মাত্র
আসে।' বড় হয়ে আরও অনেক দত্তের সাথে মিশে বুঝলাম চট্টগ্রামের কমবেশী দত্ত পরিবারে এই
বুলিটি বেশ সচল। ফেক-দত্তদের ক্ষেত্রে কেমন জানি না। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ফেক-দত্ত,
ফেক-সেন, ফেক-সেনগুপ্তের অভাব নেই! মুসলিম সমাজেও এরকম সারনেম বদলে অনেকেই নিজেদের
স্ট্যাটাসের উন্নয়ণ ঘটিয়েছেন! আগে হয়ত লিখতেন মোহাম্মদ গিয়াস, এখন লেখেন সৈয়দ
মুহম্মদ গিয়াস অথবা গিয়াস উদ্দিন খান! আমরাও দেখেছি এক ঘর দত্তের পাশে ব্যাঙের
ছাতার মত আরও অনেক ফেক দত্ত পরিবার গজিয়ে উঠতে। সারনেম বদলালেই কি সব হয়ে যায়
বাপু? দত্তদের বনেদিয়ানার ইতিহাস আছে। যদিও এসব বনেদিয়ানার গরিমা আমার নেই কিন্তু
ফেক-বনেদিয়ানাকেও আমি বরদাস্ত করতে পারি না। এসব ফেক-দত্তদের কাছে পরম্পরাগত
দত্তদের ঐতিহ্য আমি প্রত্যাশা করি না। আপাতত ওই বুলিটির দিকে তাকাই। গতকালেই
লিখেছি চট্টগ্রামে আমাদের আগমন ১৬৬৬ সালে মুঘলবাহিনীর সাথে। চট্টগ্রামের ইতিহাস থেকে
জানলাম ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রামে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য মুঘল সেনানায়ক
শায়েস্তা খান ও তাঁর ছেলে বুজুর্গ উমেদ খান চট্টগ্রাম আক্রমণ করেন ও আরাকানীদের
চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করেন। তখন চট্টগ্রামের নাম হয়- 'ইসলামাবাদ'। এই
মুঘলবাহিনীর সাথে দত্তদের চট্টগ্রামে আগমণ। গতকালের সংবাদপত্রের রিপোর্টে লেখা ছিল
তারা হুগলী থেকে আসেন। তবে আমাদের উৎপত্তি হুগলীতে নয় বলেই মনে হয় একটা কারণে।
আসছি সেই কথায়। দত্ত টাইটেলটা এসেছে ঋষি দত্তাত্রেয় থেকে। পুরাণে যিনি বিষ্ণুর
অংশ। দত্ত কোন বাঙালি উপাধি বিশেষ নয়। ভারতের আরও কিছু অঞ্চলে দত্তদের দেখা যায়
অল্পবিস্তর। বলিউডের সঞ্জয় দত্ত কিম্বা লারা দত্তের কথা-ই ধরুন না। উত্তরভারতের
কিছু স্থানে, পাঞ্জাবে আর এদিকে আসামে অনেক দত্ত আছে। বাংলায় দত্তরা কি পরে প্রবেশ
করেছে কিনা এ নিয়ে কোন তথ্য আমার জানা নেই। যেমন ব্রাহ্মণরা বাংলার আদি গোষ্টী নয়।
তাদের আগমণ ঘটেছে ১০০০ সালের পরে। দত্তদের তেমন কিছু ঘটেছে হয়ত। আমাদের পরিবারের
'গোত্র' দেখলে এই ধারনাটা জন্মায়। আমাদের গোত্র 'পরাশর'। বাংলায় কোন কায়স্হ
পরিবারের গোত্র 'পরাশর' হয় না। এটা বামুনদের গোত্র। এই 'পরাশর গোত্র' নিয়ে অনেক
ঘাঁটাঘাঁটি করে অবশেষে উদ্ধার করতে পারলাম শুধুমাত্র রাজপুতদের একটা কূল যাদের
'বিষেণ ক্ষত্রিয়' বলা হয়, যাদের প্রথম রাজার নাম ছিল ময়ূরভট্ট এবং শুধুমাত্র এরাই
গোত্রে 'পরাশর' ছিলেন। ক্ষত্রিয়দের মোট ৩৬টা কূল ছিল। এর মধ্যে 'বিষেণ ক্ষত্রিয়'
একটা। এই কূল ছাড়া অন্য কোন কূল 'পরাশর' লেখে না! রাজপুতদের বিকাশ নিয়ে পড়ছিলাম গত
পরশু সতীশচন্দ্রের বিখ্যাত 'হিস্টোরি অফ মেডিয়েভাল ইন্ডিয়া'তে। যদিও রাজপুতদের
পুরাণবর্ণিত চন্দ্রবংশ, সূর্য্যবংশ ও অগ্নিবংশের ধারা বলা হয় কিন্তু ঐতিহাসিক
দৃষ্টিকোন থেকে ভাবা হয় এরা আসলে আর্য্য বামুন এবং উত্তরভারতের অন্য কিছু যোদ্ধা
গোত্রের সংকর। আমি বহুদিন ধরে আমাদের এই উদ্ভট অ-কায়স্থ ধাঁচের 'গোত্র' নিয়ে
ভেবেছি যা নিয়ে আমাদের পরিবারের এত গর্ব ছিল- অনেক পরে গিয়ে এর রহস্য উদ্ধার করতে
গিয়ে বুঝলাম আমাদের রক্তের ধারা বাংলায় মিশেছে শুধু। আমরা বাঙালি ছিলাম না। হুগলি
থেকে মুঘলরা যুদ্ধ করার জন্য বাঙালিদের ধরে এনেছে এটার কোন যুক্তি নেই। বরং এটা
হবারই সম্ভাবনা প্রবল যে মুঘলদের সাথে রাজপুতরাই এসেছিল বাংলা দখল করতে এবং আমরা
তাদেরই অংশ। এই রাজপুতদের সাথে মুঘলদের সম্পর্কের ভিত্তি ধরেই হয়ত বলা- 'দত্ত কারো
ভৃত্য নয়', মুঘলদের সঙ্গে আসার জন্যই বলা- 'সঙ্গে মাত্র আসে।' 'দত্ত কারো ভৃত্য
নয়। সঙ্গে মাত্র আসে।' বঙ্গদেশে সব দত্ত পরিবারের ক্ষেত্রে হয়ত কাহিনীটা এক নয়।
আমি শুধু আনোয়ায়ার দত্তদের উৎপত্তি আবিষ্কারের চেষ্টায় ছিলাম। তবে চট্টগ্রামের আরও
কিছু দত্তের মুখে 'দত্ত কারো ভৃত্য নয়' শুনে অনুমান হয়- এদের কমবেশীর আগমণ ওই
সময়েই ঘটেছে এবং প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের সময়ের আবর্তনে আজকে তারা পুরোপুরি বাঙালি
এবং অতীতবিস্মৃত। বাঙালি এরকম বহুজাতিক সংমিশ্রিত একটা জাত। এখানে মুঘল, পাঠান,
রাজপুত, আরাকানী, আসামী, কনৌজের বামুন সব মিশে এক। এই তো গেল আমাদের শেকড় উদ্ধার ও
আমাদের বিচিত্র 'গোত্র' এর ক্যাঁচাল। কিন্তু একটা প্রশ্ন আমাদের সবার মাথাতেই আছে-
সেটা হল ভূর্ষিতে জায়গীর পাওয়া রাজযোদ্ধারা কবে ও কি কারণে আরও দক্ষিণে আনোয়ারা
চলে এল? আমরা রামকিনু দত্তের আগে শুধুমাত্র তাঁর বাবার নামটুকুই জানতে পেরেছি।
অনেককিছুর মত আমাদের বংশের পূর্বপুরুষদের নাম সম্পর্কিত যে ভূজ্যপত্র ছিল তাও
বিনষ্ট হয়েছে। আমি পটিয়ার ওই দিকের কাছাকাছি এক জমিদারের নাম শুনতে পেয়েছিলাম।
জমিদার তিনকড়ি দত্ত। যিনি নাকি খাজনা না দিয়ে গোরা সৈন্যদের উল্টো নিজ লাঠিয়াল
বাহিনী দিয়ে পেঁদিয়েছিলেন একবার। আমাদের ইতিহাস সংরক্ষণের সংস্কৃতি না থাকার দরুণ
এরকম নানান ছোটখাটো বিপ্লবের কথা আমরা একদমই জানি না। এসবের কথকতা হয়ত লোকের মুখে
মুখে কিছু প্রজন্ম পর্যন্ত চলে। তারপর চিরতরে হারিয়ে যায় আঁধারে। বাংলাদেশের
ইসলামাইজেশনের ফলে অনেক কীর্তিমান হিন্দুর নামগন্ধও মুছে গেছে নির্মম ভাবে। যদি
তিনকড়ি দত্ত নামে কেউ আসলেই ছিলেন এবং তিনি ইংরেজের সঙ্গে ওরকম করেছেন তবে তার
প্রতিফল মঙ্গলদায়ক কিছু ছিল না বলে ধরে নেয়া যায়। এমনও হতে পারে তার কর্তাগিরি
নস্যাৎ হবার পর তাদের বংশ আনোয়ারাতে মাইগ্রেট করে নেয়। পটিয়া অঞ্চলে এই দত্তদের
কোন হদিস নেই। কেউ দক্ষিণভূর্ষি গিয়ে একটু খোঁজ নিতে পারো। আমরা শুধু ধলঘাটের
দত্তদের কথা জানি। এরাও জমিদার। আমাদের আত্মীয়। ধলঘাটের বিখ্যাত কালী মন্দিরটি
এদের কীর্তির দৃষ্টান্ত। এই পরিবারে একজন রেলও্য়ে ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন যাকে বৃটিশ
নিযুক্ত করেছিলেন চট্টগ্রামের রেলওয়ে কনস্ট্রাকশনে। এই পরিবারের সুনাম দেখেই আমার
বাবার পিসির বিয়ে হয়েছিলে ওই রেলও্য়ে ইঞ্জিনিয়ারের ছেলের সাথে যার নাম এই মূহুর্তে
আমার মনে নেই। আমার বাবার সেই পিশেমশাই তখন লণ্ডন থেকে গাইনোকোলজি পড়ে ফিরেছেন
সবে। বিয়েটা হয়েছিল ১৯২৯ সালে। বাবার কৈশোর কেটেছে ধলঘাটের সেই দত্তবাড়িতেই। বাবা
বলেন অনেক পড়াশোনা করলেই কেউ মহাণ হয় না, মানুষের মনুষ্যত্ব থাকতে হয়! পড়াশোনা
করলেই যে মানুষ হওয়া যায় না তার দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখাতেন- বাবার সেই ডাক্তার
পিশেমশাইকে! এই ধলঘাটের দত্তরা আমাদের ওপর কি জঘন্য অত্যাচার চালিয়েছে তার
হৃদয়বিদারক অনেক ঘটনা আছে। আমার দাদুকে খুন করার চেষ্টা হয়। ঘাটফরহাদবেগে আমাদের
যে বাড়ি ছিল সেখানে গুন্ডাবাহিনী এনে আমাদের উৎখাত করা হয়। আমাদের জমিদারীর ধান
চাল পর্যন্ত ওরা ধলঘাট থেকে এসে লুট করে নিয়ে যেত। আমার দাদু ছিলেন একা। সবাই
কোলকাতায়। আমার দাদুর অতিরিক্ত দেশভক্তির ফলাফল তিনি চরমভাবে ভুগেছেন। অত্যন্ত সহজ
সরল এই মানুষটা জীবনের একপর্যায়ে একদম নীরব হয়ে যান, স্মৃতিশক্তি চলে গিয়েছিল।
দাদুর এক শ্যালক এই সুযোগে আমাদের ব্যাংক লুটে আমাদের সর্বশান্ত করেন। তখনই আমরা
আমাদের শহুরে জীবনের সিংহভাগ হারিয়ে বসি। আমাদের ঘাটফরহাদবেগের বাড়ি, পাথরঘাটার
ব্যবসা, ওষুধের ফ্যাক্টরি, এনায়েত বাজারের জায়গা (বর্তমান যেটা মহিলা কলেজ) সব উড়ে
গেল! ঠিক ওই সময়েই আমরা আনোয়ারা নিবাসী হয়ে যাই পাকাপোক্ত ভাবে। কুঠিবাড়ি হয়ে যায়
আমাদের সব। ধীরেধীরে সেসবও আমরা রক্ষা করতে পারিনি। পারছিও না। হয়ত পারবও না।
ধলঘাটের দত্তদের সাথে আমাদের সুপ্রাচীন ঝামেলা আবার শুরু হয়েছে। অমুক মিয়াঁ তমুক
আলী এসে জায়গা গিলে খায়! আমিলীগ-বিম্পি সবাই হিন্দুর জায়গা গিলতে পারলে আনন্দিত।
কত জমিজমা পাকিস্তান শত্রুসম্পত্তি করে ফেলেছে। কতকিছু চলে গেল সরকারের খাস দখলে।
আমার দুঃখ হল- আমাদের প্রাচীন বৈভবের সংরক্ষণ আমরা করতে পারিনি ঠিকই কিন্তু আমাদের
ধরে রাখার মত কিছু স্মৃতিচিহ্ন ছিল- সেগুলোও কেন আমরা রাখতে পারিনি? কথা হবে। এখন
রাখছি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন