মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৭

দত্তকথা ৫

৫ম পর্ব
_____________
রামকিনু দত্তের তিন ছেলের কথা লিখেছিলাম। প্রথম ছেলে নবীনচন্দ্র, দ্বিতীয় ছেলে অনঙ্গচন্দ্র এবং তৃতীয় ছেলের নাম বিপিনচন্দ্র। এখন নবীনচন্দ্রের বিষয়ে আলাপ হবে। চট্টগ্রামের জনপ্রিয় সংবাদপত্র 'দৈনিক আজাদী'তে নেছার আহমদ নামক জনৈক লেখক নবীনচন্দ্র দত্ত নিয়ে একটা নিবদ্ধ লেখেন। চট্টগ্রামের ইতিহাসের সাথে নবীনচন্দ্রের সংযোগ কোথায় তা এই নিবদ্ধ পড়লে জানতে পারব।
________________________________
"প্রজ্ঞাবান, তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন ও প্রতিভাবানরাই মনীষী হিসেবে স্বীকৃত। যাদের বুদ্ধিমত্তা ও মনীষাযুক্ত কর্মকাণ্ডে সমাজ আলোকিত, জাতি উপকৃত এবং মনুষ্যত্বকে বিকশিত করে, যা দেশ ও দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব সভাকেও আলোকিত করেছেন, সে সব মহান মণীষীদেরকে স্মরণ করা আমাদের নৈতিক কর্তব্য।
সে সব নাম জানা ও অজানা ব্যক্তিত্বদের মাঝে মহান মণীষী ও সাধক চট্টগ্রামের সুবিখ্যাত চিকিৎসক সম্ভবত যিনি চট্টগ্রামের বাঙালিদের মধ্যে সর্বপ্রথম সিভিল সার্জন ডাক্তার হিসেবে স্বীকৃত ডা. নবীন চন্দ্র দত্ত।
নবীন চন্দ্র দত্ত ৮ মে ১৮৫২, ১৪ বৈশাখ ১৩২৭ বাংলা চট্টগ্রাম শহরের ঘাটফরহাদবেগের পৈত্রিক বাসভবনে বিখ্যাত দত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার আদি নিবাস চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এলাকা আনোয়ারায়। পিতা রামকিনু দত্ত। পেশায় একজন চিকিৎসক ছিলেন, যিনি ব্রিটিশ শাসিত সময়ে সরকারের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলে প্রাথমিক পাঠ শেষ করে চট্টগ্রাম জিলা স্কুল হতে তিনি এন্ট্রাস পাস করেন। চট্টগ্রাম হতে এন্ট্রাস পাস করে কলিকাতায় কলিকাতা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষা গ্রহণের জন্য কলিকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। কলিকাতা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নকালীন তিনি সে সময়ের আলোচিত সমাজ সংস্কারক সংগঠন ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। সে সময়কালে ব্রাহ্ম সমাজ ব্যবস্থা পুরো ভারত বর্ষকে আলোড়িত করে। অনেক উচ্চ শিক্ষিত সনাতন ধর্মের লোকেরা এতে অংশ নেন। ১৮৭২ এ কলিকাতা মেডিকেল কলেজ হতে নবীন চন্দ্র এম.বি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। ডা. অন্নদাচরণ খাস্তগীরের পর তিনিই চট্টগ্রামের এম.বি পাস ডাক্তার।
ডাক্তারী পাসের পর নবীন চন্দ্র সরকারের চিকিৎসা বিভাগের চাকরিতে যোগ দেন। চারকরিতে যোগদানের প্রথম দিকেই ১৮৭২ এ তিনি অযোধ্যার সীতাপুরে এ্যাসিটেন্ট সার্জনের পদে নিয়োগ পান। ১৮৭৯ তে তিনি উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সেনাবিভাগে মেডিকেল অফিসারের পদে যোগ দেন এবং তদানিন্তন ৩ নং গুর্খা পল্টনের দায়িত্ব পান। সম্ভবত তিনিই প্রথম বাঙালি মেডিকেল অফিসার যিনি বাংলা প্রদেশের বাইরে সেনাবিভাগে উর্ধ্বতন পদের চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্তি লাভ করে। এরপর লখনৌতে সুপার নিউমেরারি অতিরিক্ত চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। মধ্য প্রদেশের এবং বিহারের দ্বারভঙ্গ জেলার দীর্ঘ দিন সিভিল সার্জন হিসেবে কর্মরত থেকে সুনাম অর্জন করেন।
১৯০৯ এর দিকে তিনি সরকারী চাকরি হতে অবসর নেন। সম্ভবত পিতার ঘাটফরহাদবেগস্থ পৈত্রিক বাড়িটি তিনি তাঁর ভ্রাতষ্পুত্র বিখ্যাত কবি জীতেন্দ্র কুমার দত্তকে দান করে দেন। নিজে নন্দনকানন এলাকায় নতুন বাড়ী নির্মাণ করে সেখানে বসবাস করেন এবং নিজ বাড়ীর নাম রাখেন “নির্বাণ কুটির”
এ বাড়ীতে থেকেই তিনি তাঁর যাবতীয় কার্যাদি করেন এবং বাকী জীবন অতিবাহিত করেন। চাকরিকালীন এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর সামাজিক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার কর্তৃক নবীন চন্দ্র দত্ত, রায় বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন। কর্মজীবনে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক হয়েও তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যানুরাগী ব্যক্তিত্ব। নবীন চন্দ্র দত্ত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯১২ তে চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম সাহিত্য পরিষদ গঠিত হয়। তিনি নব প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
চট্টগ্রাম সাহিত্য পরিষদের সূত্রে কবি গুনাকার নবীন চন্দ্র দাশের সাথে তাঁর হৃদ্যতায় সম্পর্ক গড়ে উঠে। ১৯১৩ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের ষষ্ঠ অধিবেশনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। চট্টগ্রামের আর্য সঙ্গীত সমিতির সাথেও তিনি যুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রাম ধর্মমণ্ডলী নামক একটি অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করে তিনি নিজেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় পরিচিতি করতে সমর্থ হন। ১৯১৬ এ প্রতিষ্ঠানের দশম বার্ষিক অধিবেশনে তাকে “বাঁচস্পতি” উপাধী দিয়ে সম্মানীত করা হয়। ১৯১৮ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনের চট্টগ্রাম অধিবেশনে তিনি অংশ নেন। ১৯২০ এর ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে সদ্য নির্মিত যাত্রামোহন সেন হলের তিনি দ্বারোদঘাটন করেন। চট্টগ্রামের ব্রাহ্ম সমাজ গঠনে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
সে সময়কালে চট্টগ্রামের সকল কবি সাহিত্যিকদের সাথে নবীন চন্দ্র দত্তের ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠে। কবিকর নবীন চন্দ্র সেন তাঁর আত্মজীবনীতে নবীন চন্দ্র দত্তকে “আমার বন্ধ ও সবোদরোপম”্‌ বলে উল্লেখ করেন। নবীন চন্দ্র একজন অসাধারণ বাগ্মী হিসেবে সুপরিচিত হয়ে উঠেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের উপর অনেক লেখালেখি করেছেন। কিন্তু তাঁর রচিত রচনাবলীর পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়নি। সে সময়ে পত্র পত্রিকায় তাঁর প্রকাশিত তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধের উলেখ পাওয়া যায়। ১৩২২ এর “তপোবন” পত্রিকায় প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে তাঁর রচিত ‘ভারতে নবজীন” শীর্ষক প্রবন্ধটি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং এটি তাঁর লেখা উলেখযোগ্য রচনা। ১৮৮৮ সালে “নব্যভারত” পত্রিকায় (১২৯৫) বঙ্গ ভাষায় উন্নতিতে তাঁর সাহিত্য সাধনায় দীর্ঘ প্রশংসা করে প্রবন্ধ বের হয়। সমাজ সংস্কারক এবং চিকিৎসক হিসেবে তিনি বাল্য বিবাহ ও মাদক দ্রব্য ব্যবহার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেন।
১৯১২ সালে চট্টগ্রাম ধর্মমণ্ডলীর বার্ষিক অধিবেশনে ‘বাল্য বিবাহ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পাঠ করে সকল মহলে প্রশংসিত হয়। প্রবন্ধটি পরবর্তীতে “প্রভাত” পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ধুমপান ও তামাকপাতা চর্বনের কুফল বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে তিনি হিন্দি ও বাংলা ভাষায় “তামাক চর্বন ও বিষাক্ত ঘা” শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন যা চিকিৎসক মহলে দারুণভাবে প্রশংসিত হয়।"
____________________________________________
নেছার আহমদের এই লেখা থেকে আমরা আমাদের আরও একটি আবাসের কথা জানতে পেরেছি যার নাম 'নির্বাণ কুটির'। নন্দনকানন এলাকাতে ছিল। সেটা পরে কে গিলে ফেলল? ঘাটফরহাদবেগের বাড়ি যাকে দেবার কথা হচ্ছে তার নাম ভুল আছে- তিনি হলেন অনঙ্গচন্দ্র দত্তের ছেলের কবি জীবেন্দ্র কুমার দত্ত। অনঙ্গচন্দ্র পেশায় সাবজজ ছিলেন। জীবেন্দ্র কুমারের শারীরিক বৈকল্য ছিল কিছুটা। এই বাড়ি লিখে দেয়ার ব্যাপারে কিছু জানতে পারিনি। কিন্তু শুনেছি আরেকজন বিশেষ ব্যাক্তির কথা যিনি ওই বাড়িতে থাকতেন- প্রভাত কুসুম দত্ত। ইনি একজন কেমিস্ট ছিলেন। জীবেন্দ্রকুমার দত্ত আনোয়ারাতে থাকতেন। আমার বাবার মস্তিষ্কে তাঁকে ও তার বোন কবি হেমন্তবালাকে দেখার স্মৃতি এখনো আছে। আমরা জীবেন্দ্র কুমার সম্পর্কেও জানব পরবর্তী পোস্টে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

গ্রাস

  বুঝি আর আমাকে দিয়ে হবে না কিছুই। অসময়ে, অনাহুত, অতি অনভিপ্রেত জানি, সমস্ত বিবাদী উষ্মার অন্তরালে হারিয়ে যাব আমার এ যাবৎ যতনে গড়া সুরের ...