২য় পর্ব
___________
রামকৃষ্ণ আশ্রমে একজন
বৃদ্ধা থাকতেন। আমরা দিদিমনি ডাকতাম। উনার ক্ষীণদেহী নাতিটি ছিলেন আমার সহপাঠী।
ওখানে গেলে তিনি মাঝেমধ্যে খুব আদর করে আমাকে তালের পিঠা খাওয়াতেন আর একটা গল্প
আমাকে প্রতিবারই বলতে কখনো ভুলতেন না। 'আমি ব্রজেন্দ্র দত্তের বিয়ে দেখেছি। তোমার
দাদুর বাবা। আমি তখন খুব ছোট! আহা কি মানুষ ছিলেন। উনার বিয়েতে কত হাজার লোকের যে
ভোজ হয়েছিল কি বলব। ঠাকুর মা এসব বলে না তোমাদের? উনি তো দেখেননি। আমি দেখেছি। কি
সুন্দর মানুষ ছিলেন। ধুতির কাঁছা করতেন সোনার কাঠি দিয়ে। সকাল সন্ধ্যা চণ্ডী না
পড়ে খেতেন না কখনো। কি সব মানুষ। এখনকার দিনে এসব মানুষ কোথায়?'
ব্রজেন্দ্র কুমার দত্তের
ছবি আমি দেখেছি স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-ভগিনী ইত্যাদি সমেত। একটা ছবি সংরক্ষিত ছিল যার
কোন হদিশ আজ আর নেই। আমি জানি না আমার বাকী ভাইবোনদের এই ছবির কোন স্মৃতি মনে আছে
কি না। তবে এই ছবি যে কোথায় গেল আমি বলতে পারব না। শুধু জানি আমাদের পারিবারিক
ঐতিহ্যের কোন বিশেষ স্মৃতি আজ আমাদের কাছে নেই আর। আশ্রমের ওই দিদিমনির কথায়
আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক বৈভবকে ছাড়িয়ে আরেকটা দিক বিশেষ ভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠত।
সেটা হল এই পরিবারের ধর্মভীরুতা। আমার ঠাকুরদার স্মৃতি আমার কাছে ঝাঁপসা। আমার
শৈশবের প্রথমার্ধেই তিনি প্রয়াত হন। কিন্তু কোলকাতায় পড়াশোনা করা ওই গৌরবর্ণ পুরুষ
যে প্রবল মাত্রার বাঙালি ও নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন তা আমি অনুভব করতে পারি।
ফিনফিনে ধুতি পড়তেন। নিত্য গীতাপাঠ করতেন যা আমার ঠাকুরমার মধ্যেও এসেছিল একসময়।
পুরণো সিন্ধুকে রামায়ণ মহাভারত রাখা ছিল অনেক যত্নে। ঠাকুরমার কোলে বসে
রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শুনতাম আমি। তিনি প্রণবানন্দ শিষ্য স্বামী বেদানন্দের
শিষ্যা ছিলেন। আমার ঠাকুরদা এই ধর্মপ্রাণতা লাভ করেছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রেই।
ব্রজেন্দ্র দত্তের আগের জেনারেশনের ধর্মাচার নিয়ে অনেক কথা। দত্তবাড়ি থেকে এসব
কবেই চলে গেছে। বাড়ির পূজাপার্বণ নেই আর। বংশের গৃহদেবতা শালগ্রাম নারায়ণ এখন
গৃহেই থাকেন না। আগে যজমান এসে নিত্য পূজা করে যেতেন! বাব্বা! শালগ্রাম রাখা কি
চাট্টিখানি কথা! রোজ বামুন না হলে তাঁর পূজাআচ্চা হয় না। এখন তিনি জয়কালী মন্দিরে
পূজা পান। একসময় নাকি নারায়ণ ঠাকুরের জন্য একটা আলাদা গরু রাখা হয়েছিল। রাখা ছিল
আলাদা সুবাসিত চালের বরাদ্দ। সেই আলাদা গাইয়ের দুধ আর আলাদা বরাদ্দের চালে তিনি
পায়েস খেতেন। এ দৃশ্য আমরা অবশ্য দেখিনি। তবে ঘটা করে নারায়ণের ঠাট বজায় রাখার কি
মহিমা সেটা দেখা আছে বাল্যকাল থেকেই। আমাদের সেই সনাতনী পূর্বপুরুষদের অনেকেই নাকি
একাহারী ছিলেন। মাংসভূক ছিলেন না। কেবল প্রসাদী মাংস হলে খেতেন। এইসব রীতি উঠেছে
কিসের ঠেলার জানি না। আমরা কিন্তু কারণে অকারণে প্রচুর মাংস খেতে অভ্যস্ত হয়েছি।
শোনা যায় আমাদের পরিবারের সাথে বর্ধমানের রাজপরিবারের বৈবাহিক সম্বন্ধ হয়েছিল
একবার। তাদের বাড়ির মেয়ের হাতেই আমাদের এরকম কট্টর হিন্দুয়ানি প্রথার কিছু বিবর্তন
ঘটেছিল। এ ছাড়াও নবীনচন্দ্র দত্তের ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণও একটা বড় প্রভাবক হতে পারে। বাড়িতে
উপনিষদের চর্চাটাও প্রাচীন যা এখনো আছে বটে। আমাদের পূর্বপুরুষদের কেউ একজন উপনিষদ
নিয়ে কিছু একটা লিখছিলেন যার হারিয়ে যাওয়া পান্ডুলিপি আমি রামকৃষ্ণ আশ্রম থেকে
উদ্ধার করেছিলাম একদিন। কেন আমরা সব হারিয়েছি? কিভাবে হারিয়েছি? ঠিক কি ভাবে এ
বাড়ি থেকে দূর্গাপূজা, কালীপূজা সব উঠে গেল তার সুনির্দিষ্ট ইতিহাস আজও আমাদের
অজানা। এখন কোন পূজা হয় না! পাঁঠাবলি দিয়ে যে মনসাপূজা হত তাও আর নেই। আমি
ছেলেবেলায় কত পূজা দেখেছি সেসবের কিছুই নেই। নারায়ণ আবার ঘরে ফিরে এলে হবে হয়ত।
কিন্তু তিনি আসবেন কি? কবে আসবেন?
নবীন দত্ত ব্রাহ্মধর্মের
কোন অংশের অনুসারী হয়েছিলেন জানি না। তিনি যদি কেশব সেনের নববিধানে নাম লেখান তবে
হয়ত সেই সময়ে তিনি উপবীত ত্যাগ করেন। বাবার কাছে শুনেছি আমার দাদুর আমল থেকেই আমরা
উপবীত ছেড়েছি। তবে কি নবীনচন্দ্র উপবীত রেখে দিয়েছিলেন? কায়স্থ পরিবারের উপবীত
ধারণের রেওয়াজ আমি আর দেখিনি। এই প্রসঙ্গে লিখব
বিস্তারিত। মোদ্দাকথা হল এই পরিবারটি ছিল অত্যন্ত আদর্শগত হিন্দুত্বে
বিশ্বাসী এবং কোন এক সময় এর অভ্যন্তরেই একটা পরিবর্তনের আন্দোলন তীব্র ভাবে
উপস্থিত হয়। আমাদের বাড়িতে কখনো কেক কেটে কারো জন্মদিন পালন হয়নি। আমরা হিন্দুত্ব
আর বাঙালিয়ানায় শিক্ষিত। জন্মদিনের দিন সকালে উঠে বড়দের প্রণাম করে, স্নান করে
ঠাকুর প্রণাম করতাম। নারায়ণের বিশেষ পূজা ও ভোগ হত। কিছু নিমন্ত্রিত অথিতি আসতেন।
প্রসাদ পেতেন। বাবা মার কাছে উপহার হিসেবে সোনার আংটি, সোনার চেইন পাওয়ার বাল্য
স্মৃতি এখন ধীরে ধীরে আমার ফিকে হয়ে যাচ্ছে। ওইদিন রাতে অবশ্য বিরিয়ানি পোলাও কিছু
একটা হতই হত! এখানে আবার বাঙালিয়ানা আর মোঘলিয়ানার মিশ্রণ! ইংরেজী ভাষায় আছে সবারই
প্রেম। রামকিনু দত্তের ইংরেজি কাব্যগ্রন্থও ছিল। এসব বিষয়ে আমি কয়েকবার লিখেছি এবং
এই ধারাবাহিক লেখায় সেসব আবারও উঠে আসবে। আমি বাড়িতে যেমন হিন্দু পুরাণ, বেদান্ত
এসব দেখেছি তেমনি দেখেছি শেক্সপীয়র থেকে শুরু করে কার্ল মার্ক্সকেও! আমার
বাবা-কাকারা পড়ুয়া মানুষ! তাদের রক্তে আছে। কিন্তু আমাদের রক্তে সেটা লক্ষ্যনীয়
মাত্রায় কম মনে হয়। ভুল লিখলাম? এমনকি সেই ধর্মচেতনা বা চিন্তার প্রবাহ যা আমাদের
পূর্বজরা বহণ করতেন আমরা তার ধারক হইনি। আমি যদিও এসব নিয়ে একটু বেশীই ভেবেছি।
আমাদের বংশে কয়েকজনের সন্ন্যাস নেবার কথা আমি শুনেছিলাম ঠাকুরমার কাছে। এর সত্যতা
কতটুকু? কিন্তু আমি প্রভাবিত ছিলাম বটেই। যদিও রেশনালিজমের পোকা আমাকে আটকে দিয়েছে
মাঝপথে। আমার যে পিতৃব্য তরুণ বয়সে বিষপানে আত্মহত্যা করেন আমার মধ্যে তার
চরিত্রের ছায়া আমার ঠাকুরমা যেমন দেখতেন তেমনি কখনো কখনো আমার বাবাও দেখেছেন।
কিন্তু কমল দত্ত কেন এত অল্প বয়সে আত্মহত্যা করেছিলেন? কমল দত্তের আত্মহত্যার কিছু
মাস পর মিত্রবাড়ির এক মেয়ে আত্মহত্যা করে। আমার ছোট বাবু (কাকু) এ নিয়ে এক
মারাত্মক সিনেমেটিক গল্প শুনিয়ে দিলেন আমাকে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, মিত্রবাড়ির
খোঁজ নিলাম- এ দুটো আত্মহত্যার কোন সংযোগ নেই। নেই কোন প্রেমকাহিনী। প্রচণ্ড
মেধাবী কমল দত্ত তবে কেন আত্মহত্যা করেছিলেন? তাঁকে বিষ এনে দিয়েছিলেন তারই এক
ঘনিষ্ট বন্ধু! এই রহস্যের জট আমরা খুলতে পেরেছি?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন