৬ষ্ঠ পর্ব
____________
ইন্টারনেটে বহু ঘাঁটাঘাটি করে জীবেন্দ্র কুমার দত্তের লেখালেখির কিছু উৎস
পেলাম। তাঁর 'তপোবন' ও 'ধ্যানলোক' নামের দুটো কাব্যগ্রন্থ আছে রবীন্দ্রভারতী
বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে। 'ধ্যানলোক' কাব্যগ্রন্থটি রক্ষিত আছে নেশনাল লাইব্রেরি অফ
ইন্ডিয়াতেও। এ ছাড়া নানাবিধ সাইটে আরও অনেক লেখা পেলাম। 'মিলনসাগর' নামক বাংলা
কবিতার একটা সাইটে দেয়া হয়েছে তাঁর ৩১টি কবিতা। কবি জীবেন্দ্রকুমারের বোন
হেমন্তবালা দত্তও ছিলেন কবি। তাঁর 'মালা' (১৯১০), 'নীলিমা' ও 'বৈশাখী ঝড়' নামে
তিনটি কাব্যগ্রন্থ ছিল। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন। 'বঙ্গের মহিলা কবি' (১৯৩০,
লেখক- যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত), 'সংসদ বাংলা সাহিত্য সঙ্গী' (২০০৩, সম্পাদক- শিশির
কুমার দাশ)- এই গ্রন্থদ্বয়ে দুই কবি ভাই-বোনের বৃত্তান্ত আছে। হেমন্তবালা সম্পর্কে
কম জানতে পেরেছি। কালীপ্রসন্ন দাশগুপ্ত সম্পাদিত মাসিক 'মালঞ্চ' পত্রিকায় আশ্বিন
১৩২৩, সেপ্টেম্বর ১৯১৬ সালে তাঁর রচিত শেষ কবিতা হিসেবে 'মাতৃপূজা' কবিতাটা পাওয়া
যায়। ওখানে উল্লেখিত থাকে সেটা কবির প্রয়াণের পর ছাপা হয়েছে। এ থেকে এই সিদ্ধান্তে
আসা যায় কবি কবির আয়ুষ্কাল ১৯১৬ তে শেষ হয়ে যায়। 'মিলনসাগর' সাইটে কবি হেমন্তবালা
দত্তের কয়েকটি কবিতা দেখতে পেলাম। দুই-ভাই বোনের কবিতা গুলো পড়ছিলাম। ভাষার
লালিত্য মুগ্ধ করেছে। এই পর্বে আমি জীবেন্দ্রকুমার দত্ত সম্পর্কে বিশদ তথ্যবহুল
বিবরণ দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মনে হল তাদের জীবনের কথাগুলো না
হয় পরেই লিখি। দু'তিনটি কবিতা দিয়ে দিলে কেমন হয়? সাইটে প্রকাশিত কবিতাগুলোতে বানানে
প্রমাদ আছে। কয়েক জায়গায় মূলগ্রন্থ থেকে পাতা স্ক্যান করে নেবার দরুণ লেখা
অস্পষ্ট। আমি এখানে সংশোধিত করে লিখে দেবার চেষ্টা করছি কিছু নমুনা। সাইটের লিংক
দিলাম। ইচ্ছে হলে পড়া যাবে- http://www.milansagar.com/kobi_3/jibendrakumar_dutta/kobi-jibendrakumardutta.html
১৯১৯ সালের জানুয়ারী মাসে প্রকাশিত কবি জীবেন্দ্র কুমার দত্তের 'কাঞ্চী বা
কর্ণফুলি' কবিতার কিছু অংশ-
'' পূণ্যতোয়া কাঞ্চী অয়ি! অয়ি চট্টলার
স্নেহ-প্রবাহিনী!
যুগান্তরের পূত স্মৃতি সারা বক্ষে
লয়ে নিতি
তুলিছে অনুক্ষণ কি মহারাগিনী!
জীবন তোষিনী প্রিয়া সতী ব্রতে বিসর্জিয়া
সংহার মূর্তির বেশে উদ্ভ্রান্ত হৃদয়ে
প্রচণ্ড ঝঞ্ঝার সম মথিয় ভূবন
তাণ্ডব চরণে
কিবা অপার্থিব স্নেহে মৃতা দাক্ষাস্বিণী
দেহে
রক্ষিলেন স্কন্দোপরে সম্ভ্রমে যতনে!
প্রেমের প্রকট রূপ উদ্ভাসি ত্রিলোক
হল দীপ্যমান-
......।"
জীবেন্দ্র কুমারের কবিতার ভেতর তাঁর নিজস্ব ঢঙটা খুবই সাবলীল দেখতে পেলাম।
তিনি কিছু ঋকসূত্রেরও অনুবাদ করেন বলে জানা যাচ্ছে। এর অর্থ হল আমি কৈশোরে যে
পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের কথা আগের এক পর্বে উল্লেখ করেছি সেটা সম্ভবত তাঁর। এটা হবার
সম্ভাবনা বেশী কারণ তিনিই অধিক সময় আনোয়ারাতে কাটিয়েছেন বলে বাবার কথায় বুঝলাম।
জীবেন্দ্রকুমার দত্তের চেয়ে তাঁর ভগিনী কবি হেমন্তবালা দত্তের কবিতাতে প্রাঞ্জলতা
ও ছন্দের ঐতিহ্যগত চলনটা বেশী। তাঁর 'মাতৃপূজা' নামক শেষ কবিতাটি দুটো স্তবক
লিখছি। এটা 'নীলিমা' কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া।
''এস মা জননি! ভকতবৎসলে!
পূজিছে তোমারে ধরা!
এস মা কল্যাণি! করুণারূপিনী!
বিপদ-বিষাদ-হরা!
এস মা অভয়ে! এস মা বরদে!
অশেষ শকতিময়ী!
তোমারি প্রসাদে ভকত সন্তান
সংসার-সংগ্রাম জয়ী!''
হেমন্তবালার কবিতার ভেতর বঙ্কিমের একটা অন্তঃসলিলা স্রোত আছে। দেশমাতৃকা ও
ভগবতীর একীভূত রুপ দেখাটা সে যুগের বিপ্লবীদের একটা স্বকীয়তাতে রূপ নিয়েছিল যার
প্রভাব রবীন্দ্রনাথের গায়েও লেগেছে একসময়। এসব অন্য কথা। আমি দত্ত পরিবারের ইতিহাস
নিয়ে লিখছিলাম। পরিতাপের বিষয় হল দত্ত বাড়িতে এত লেখালেখি হয়েছে, এত বই-টই
প্রকাশিত হয়েছে অথচ আমাদের কাছে একটা বইয়ের কপিও সংগ্রহে নেই! কিন্তু কেন? এই
'কেন' প্রশ্নের উত্তর লাভের চেষ্টা করব আমার এই ধারাবাহিক লেখার শেষদিকে। আগামী
পোস্টে জীবেন্দ্র কুমার দত্ত সম্পর্কে আরও বিস্তারিত লিখব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন