আমি একটা ধারাবাহিক লেখা শুরু করলাম যার প্রথম পর্ব এটা। শুরুতেই বলে রাখি এই
লেখাটা একান্তই আমার পরিবার সম্পর্কিত, যদিও এর সাথে চট্টলার ইতিহাসের সামান্য
যোগসাজশ আছে, তবুও লেখাটা শুধুমাত্রই ফেসবুকে আমার সাথে সংযুক্ত আমার পরিবারের
সদস্য ও অন্যান্য আত্মীয়বর্গের জ্ঞাতার্থে শুরু করছি। আমরা সবাই একে অপরের কাছ
থেকে নানা কারনে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি। আমাদের শারীরিক
দূরত্বের চাইতে বেশী আমাদের মানসিক দূরত্ব প্রকট। কোথাও একসাথে বসে এইসব
আলাপচারিতার অবকাশ আমাদের কখনো হয়ে ওঠেনি এবং আমি জানি না ভবিষ্যতেও এর সম্ভাবনা
কতটা আছে। পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে আমি সবসময় অনুভব করেছি আমাদের ভেতর একরকম
ঐক্য ও সহমর্মিতা সংরক্ষণের। আমাদের জানা উচিৎ আমাদের অতীতকে যা আমরা অতিমাত্রায়
বিস্মৃত এবং এর জন্য আমাদের প্রপিতামহ, পিতামহ এমনকি আমাদের পিতারাও কিছুটা হলেও
দায়ী। ফেসবুকে মেসেজ চালাচালির মাধ্যমে এই কথাগুলো খুব একটা গুছিয়ে বলা যায় না
দেখেই আমি এখানে বিশদ আকারে এগুলো লিখছি। যে প্রসঙ্গে আমি লিখছি সে বিষয়ে হয়ত
তোমরা আমার চেয়েও কিছু বেশী জানতে পারো। তাই ট্যাগ করলাম।
আনোয়ারার দত্তদের শেকড়টাকে খুব বেশী ভাবে অনুভব করার সুযোগ ও সময়টা পেয়েছিলাম
আমি। যদিও আমার বাবা আমাকে কখনোই আমাদের অতীত নিয়ে কিছু বলেননি। আমি
পাড়া-প্রতিবেশীর কাছেই দত্তদের কীর্তি নিয়ে অনেক কথা শুনতাম ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু
বড় হয়ে যখন চট্টলার ইতহাসেও আমাদের নিয়ে ছড়ানো-ছিটানো কিছু কথাবার্তা দেখতাম তখন
বুকের ভেতর একটা যুগপৎ গর্ব ও গভীর বেদনা সৃষ্টি হত। ১৬/১৭ বছর বয়সে আমি নিজেও
'দৈনিক পূর্বকোণ' থেকে আসা জনৈক সাংবাদিকের জিজ্ঞাসাবাদের সামনা করেছি। কিন্তু ঐ
বয়সে আমি বিশেষ কোন তথ্য তাঁকে দিতে পারিনি। পরবর্তীতে তাঁর লেখা একটা কলামে
আমাদের কিছু ইতিহাস উঠে এসেছিল যার ফলে আমি আমার পরিবার নিয়ে কিছু জেনেছিলাম যা
আমার বাবা-কাকারা কখনো আমাকে বলেননি। আমি সেই সব ইতিহাস ও আমাদের করুণ পরিণতি
নিয়েই লিখছি। প্রথম দিকে বলব আমার শৈশব অভিজ্ঞতার কথা।
আমাদের বাড়িতে অনেক বর্গাচাষীর আনাগোনা ছিল। এর মধ্যে একজন হিন্দু জেলে- 'সাগর
কাকু' এবং বাকী সবাই বিলপুরের মুসলিম। এই মুসলিম পরিবারের একজন আবার নামকরা
রাজাকার ছিলেন এবং যতদূর জানি এই রাজাকারের কৃতজ্ঞচিত্তের কারণেই ৭১ সনে আমাদের
বাড়িটা পাকবাহিনীর তাণ্ডব থেকে বেঁচে যায়। আরও একটা কারণ শুনেছি ঠাকুরমার কাছে যে-
থানার দারোগা বাবু আমাদের ঠাকুরদাকে একজন ভাল মানুষ হিসেবে খুব শ্রদ্ধা করতেন এবং
আমাদের বাড়িটা বেঁচে যাবার পেছনে তাঁর একটা ভূমিকাও আছে। ছোটবেলায় সাগরকাকু আমাকে
বেড়াতে নিয়ে যেতেন কখনো কখনো। রাস্তায় কিছু বয়স্ক মুসলমান ভদ্রলোকের সাক্ষাৎ হত
মাঝেমাঝে। তারা আমাকে আদাব দিতেন ওইটুকু বয়সেই। আমি তখন এসবের মানে জানতাম না।
কিছুটা বড় হবার পর আমি জেনেছি স্থানীয় জমিদারদের বংশধরেরা প্রাচীন আমলে এসব পেয়েই
অভ্যস্ত। আমি অত্যন্ত পুরাকালে তো জন্মাইনি। কিন্তু তারা অতিশয় বৃদ্ধ ছিলেন এবং
তারা তাদের রীতিটাকে মানতেন। এই সম্মানের আধিক্যের আরেকটা কারণ হল দত্তরা
পাইক-পেয়াদা রেখে খাজনা খেয়ে চলা সামন্তবাদী জমিদারী কখনো চালায়নি। তাদের জীবন
কেটেছে পড়াশোনা, ডাক্তারি, ওকালতি, সরকারী চাকরী আর শিল্প-সংস্কৃতি ধরে। তাদের
তালুকের জমিতে কে আছে সে নিয়ে তাদের মাথাব্যথা ছিল না। এই উদারতার কুফল নিয়ে আলাপ
হবে পরে। আমাকে 'তেলেবিল' এর ধারে দাঁড় করিয়ে একজন বলেছিলেন তর্জনী নির্দেশ করে-
'বাবু এখান থেকে যতদূর দেখতে পাচ্ছেন সব একদিন আপনাদের জমি ছিল।' এখন আছে কি নেই
সে প্রশ্ন জাগার মত বয়স আমার ছিল না। মেইন রোডের ধারঘেঁষা তিনটে পুকুরের হিসেব আমি
দেখেছি। একদিন একজন বলল ঘোষদের বড় দীঘিটা আমাদের কেউ একজন কোন আমলে ৯০০ টাকায়
বিক্রী করেছিলেন। রক্ষাকালী মন্দির ও তার সংলগ্ন দামপুকুর ও একটা ছোট পুকুর আমাদের
ছিল! রক্ষাকালী মন্দিরের বর্তমান মালিকেরা এটা অস্বীকারও করে না আজও। কিন্তু এগুলো
আমাদের নেই কেন? প্রায় এক একর জায়গার ওপর গড়া, চারপাশে পরিখা কাটা আমাদের বাড়ির
সীমানা। উঠানের পূবে একটা উঁচু ঢিপির মত জায়গা ছিল। এখনো আছে। আমার বাবা সেখানে
একটা মন্দির গড়তে চান। সেখানেই ছিল আমাদের আদি মন্দির। এই বাড়িটা ছিল দত্তদের
কুঠিবাড়ি। কোন এক বন্যার সময় নাকি এই মন্দিরের গোপালের গা থেকে চুরি যায় অনেক
অলংকার। সেবায়েতরাই কাজটা করে। চুরি যায় চারটে সুন্দর রূপার প্রলেপ দেয়া খড়গ। আমি
দেখেছি ওগুলো কাদের কাছে আছে এখনো।
কিছুমাস আগে এক জমির ধারে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ফুঁকছিলাম। এক ভদ্রলোক এসে
বকতে আরম্ভ করলেন- 'হাড়িপাড়ার সব ভূমি তো আপনাদের। এখনো দু'চার ঘর গরীব আছে। ওদের
জায়গাটা আপনার কাকু বিক্রি করে দিলে ওরা কোথায় যাবে? আপনার বাবা ছেড়ে দিয়েছেন। আপনার
কাকুকে একটু বলুন।' আমি এই কথাগুলোর কোন ক্লু পাইনি। কারণ আমি এসবের ভেতর কোনদিনই
ছিলাম না। তবে জানি ওই হাড়িপাড়াটার সব ভূমি আমাদের দানকৃত ছিল এবং এখনো এই দান করা
ট্র্যাডিশন নিয়ে কিছু একটা উৎপাত শুরু হয়েছে। 'বাবু আপনাদের তো অনেক আছে। এটুকু
ছেড়ে দিলে কি ক্ষতি হবে?' আমি জানি না বাপু। এই 'অনেক আছে' শব্দদুটো আমি হাজার বার
শুনেছি। কিন্তু কি আছে তা স্পষ্ট নয়। তিনি আরও অনেক বলে গেলেন- আমাদের শহরের বাড়ির
কথা, ব্যবসার কথা, একটা মেডিসিন ফ্যাক্টরীর কথা- যা আমার বাবা আমাকে কখনো বলেননি।
কিন্তু আমি জেনেছি এসব। সমস্ত কিছু হারানোর করুণ ইতিহাস আমি জেনেছি। আমি সম্পদ
হারানোতে ব্যথিত নই। আমি কষ্ট পেয়েছিলাম এমন একটা বিরাট পরিবারের এত দ্রুত বিনাশের
কারণ চিন্তা করে।
অমরেন্দ্র দত্ত সেই বৃটিশ সময়ে ৯০০০০ টাকা নিয়ে লণ্ডন চলে গেলেন। আর ফেরেননি।
ওখানে এখনো তাঁর বাড়িটা আছে। সেই অমরেন্দ্র দত্তের জমিজমা নিয়ে ৫ মাস আগে কেস
ঠুকেছে ধলঘাটের দত্তরা! ১৯৪৩ সনের ঘটনার জের এখনো! অমর দত্তের অংশের দিকের জমি
দেখিয়ে একজন বলেছিলেন- 'এই জমি আমি তোমার ছোটকাকুর কাছ থেকে ২০,০০০ টাকায় কিনেছি!'
কথাটা যে কি বিষম বিদ্রুপের তা বলে বোঝাতে পারব না। তখনকার দিনের হিসেব করলেও এই
জমির দাম ২ লাখ টাকা হত! আমার সুরাপায়ী খুল্লতাতের মাথায় কি করে হাত বোলানো হত
তিনি তা টের পেতেন না। অবশ্য তিনি জমির দলিল নিয়েই জুয়ার আসরে বসতেন। আমার বাবার
ভাষ্যমতে তার এই কনিষ্ঠ ভ্রাতা সেই সময়ে প্রায় ৩ কোটি টাকার সম্পদ উড়িয়ে দেন। এই
কনিষ্ঠ সন্তান তাঁর সর্ববিধ অপকলাপের ভেতরও প্রবল মাতৃস্নেহ পেয়েছেন এবং এটাই
হয়েছে আমাদের বংশের কফিনে শেষ পেরেক! আমাদের পিতামহীর কল্যানেই আমরা ক্রমশ অধোগতি
লাভ করেছিলাম।
(লেখাটা বিরাট আকারের হবে। ৩০০ বছরের পারিবারিক গাঁথা ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হবার
বিশ্লেষণ। তোমরা একটু হেল্প করবে।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন