সোমবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১৭

দত্তকথা ৩

৩য় পর্ব
___________
'চট্টল মনীষা' নামে একটা বই পাওয়া যায় চট্টগ্রামে। সেখানে চট্টগ্রামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের বর্ণনা আছে। চট্টলার 'দৈনিক পূর্বকোণ'এ একদিন এই বইয়ের রেফারেন্স প্রয়োগ করে রামকিনু দত্তের ওপর একটা লেখা বের হয় যা আমি হুবহু লিখে দিচ্ছি। এই লেখার সূত্র ধরেই আমরা আমাদের শেকড়ে যাবার চেষ্টা করতে পারি।

"রামকিনু দত্ত (১৮০১-১৮৯২)
_____________________________
চট্টগ্রামের প্রথম অ্যাংলো-বাঙালি কবি ও ইংরেজ আমলে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ রচয়িতা রামকিনু দত্তের জন্ম ১৮০১ সালে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বিত্তবান ও অভিজাত দত্ত পরিবারে। তাঁর পিতা সদয়রাম দত্ত। এই পরিবার ১৬৬০ সালে হুগলী থেকে মুসলিম সেনাবাহিনীর সাথে চট্টগ্রামে আসেন ও আরাকানের সাথে মোগল বাহিনীর যুদ্ধে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। মোগল বিজয়ের পর এই পরিবার ভূর্ষি গ্রামের জায়গীর প্রাপ্ত হন। এখান থেকে পরবর্তী বংশধরেরা আনোয়ারায় এসে বসতি শুরু করেন।
রামকিনু দত্ত কর্মজীবনে সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগে যোগ দেন ও নেটিভ ডাক্তার হিসেবে পরিচিতি পান। তিনি উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন, এই দুই ভাষায় প্রচুর গান ও কবিতা লিখেন। তাঁর স্বদেশপ্রেম ও মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অনুরাগ ছিল। আত্মসম্মানবোধ ও স্বাধীন মনোভাব প্রদর্শনের জন্য রামকিনু দও ১৮৪৭ সালে এক বছর কারা দণ্ড ভোগ করেন। জানা যায় এসময় চট্টগ্রামের ভূমি জরিপ কাজে হার্ভে সাহেব নিয়োজিত ছিলেন, দেশের মানুষের ক্ষতির আশংকা করে ডাঃ রামকিনু দত্ত তাতে বাধা দিয়েছিলেন, ফলে অভিযুক্ত হয়ে তিনি কারাভোগ করেন। ডাঃ রামকিনুর কারাদণ্ডের জন্য আরেকটি কারণ জানা যায়। তা হল তিনি অশ্বারোহণে রোগী দেখতে যাবার সময় উচ্চপদস্থ শ্বেতাঙ্গ কর্মচারী সেটাকে বেয়াদবি মনে কক্রে রামকিনুকে আঘাত করেন বা যাত্রাবিঘ্ন করেন। আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ডাঃ রামকিনু সেই শ্বেতাঙ্গ সাহেবকে চাবুক মেরে ধরাশায়ী করেন। এই অপরাধে ডাঃ রামকিনুর এক বছর জেল হয়।
রামকিনু দত্ত Songs with Native tunes of Different sorts and Dances সংক্ষেপে Songs নামে কাব্যগ্রন্থ রচনা ও চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশ করেন। ১৮৮৬ সালে গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় তখন তিনি সরকারী চাকরী থেকে অবসরপ্রাপ্ত। মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের নাম CS Press এর পক্ষে CGK Chowdhury, ৪ ইঞ্চি ও ৮ ইঞ্চি সাইজের গ্রন্থটির পৃষ্ঠার সংখ্যা ৪২। ১৮৬৪ সালে জুনমাসে ইংলিশম্যান পত্রিকায় গ্রন্থটির বেশকিছু কবিতা ও গ্রন্থ সম্পর্কে আলোচনা ছাপা হয়। ১৮৯২ সালে ৯১ বছর বয়সে Manipur Tragedy নামে একটি ক্ষুদ্র ইংরেজি কাব্য প্রকাশ যাতে ইংরেজদের শোষণ নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরা হয়। Songs কাব্যগ্রন্থে শিরোনামযুক্ত ১৫টি ও শিরোনামহীন আরও বেশ কিছু কবিতা রয়েছে।
ডাঃ রামকিনু দত্ত তিন পুত্রসন্তানের জনক ছিলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র ডাক্তার নবীনচন্দ্র দত্ত (১৮৫২-১৯২০)ছিলেন চট্টগ্রামের সুবিখ্যাত চিকিৎসক ও সম্ভবত চট্টগ্রামের বাঙালিদের মধ্যে সর্বপ্রথম সিভিল সার্জন। তিনি ১৯১১ সালে স্থাপিত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ছিলেন। দ্বিতীয় পুত্র অনঙ্গচন্দ্র দত্ত (১৮৫৩-১৯১৪)। তাঁর পুত্র বিখ্যাত কবি জীবেন্দ্রকুমার দত্ত। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের বিখ্যাত কবি, সাহিত্য সংঘটক ও সংস্কৃতিকর্মী। তাঁর কন্যা হেমন্তবালাও ছিলেন কবি। অনঙ্গচন্দ্র দত্ত আত্মজীবনী রচনা করেন। কর্মজীবনে ছিলেন সরকারি চাকুরে। কনিষ্ঠপুত্র বিপিনচন্দ্র দত্ত (১৮৫৫-১৯৪৯) ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ও ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী। তিনি ছিলেন সুকণ্ঠের অধিকারী। আখ্যায়িত হন Young bird of Chittagong নামে।
ইংরেজ রাজত্বে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের পর অনেক বাঙালি ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে যশস্বী হন। তন্মধ্যে কবি কাশীপ্রসাদ ঘোষ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সরোজিনী নাইডু'র নাম শীর্ষস্থানীয়, সেই ধারাবাহিকতায় অ্যাংলো-বাঙালি কবি হিসেবে ডাঃ রামকিনু দত্তের নাম প্রাসঙ্গিক। তিনি ১৯২ সালের পরবর্তী কোন এক সালে পরলোক গমন করেন। তিনি নিজের জীবন এবং চট্টগ্রামের সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় যে, ডাঃ রামকিনু দত্ত ইংরেজি ভাষায় কবিতা রচনা করলেও মাতৃভাষা বাংলা কিম্বা মাতৃভূমির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করেননি। বরং ইংরেজ রাজত্বে বাস করে এবং সরকারি চাকরী করেও বৃটিশ রাজের সমালোচনা করেন 'মণিপুর ট্রাজেডি' কাব্যগ্রন্থে। তথ্যসূত্রঃ চট্টল মণীষা (আহমদ মমতাজ, রাইহান নাসরিন।)
___________________________________

এই লেখাটা পড়ে আমার মাথাতে প্রথম যে ভাবনাটা এসেছিল সেটা হল- এত দূর্বল বাংলা নিয়ে কেউ একজন একটা বাংলা সংবাদ পত্রিকায় লেখালেখির চাকরী কি করে পায়!!! যাই হোক ওপরের তথ্যগুলোর আলোকে কিছু কথা তুলি। প্রথমত দত্তবংশের গোড়াপত্তনের উল্লেখিত সণ ও অঞ্চল নিয়ে কার কি বক্তব্য? পটিয়ার ভূর্ষি থেকে আনোয়ারা আগমনের হেতু কি? ভূর্ষির দিকে দত্তদের কোন ইতিহাস আছে কিনা? রামকিনু দত্তের বই কোথায় গেল? কোথায় সংরক্ষিত আছে? চট্টগ্রামে একদম শুরুর দিকে যে কয়েকজন মানুষ বৃটিশের বিরুদ্ধে জনমত গড়েন তাদের মধ্যে রামকিনু দত্ত একজন। এটা আমি কোলকাতায় প্রকাশিত একটা লেখায় পেয়েছিলাম। কিন্তু বিশদাকারে কিছু পাচ্ছি না। হার্ভে সাহেবের সাথে তাঁর বিবাদের স্পষ্ট কারণ কি? নবীনচন্দ্র দত্ত নিয়ে আলোচনা অনেক বড় হবে। তিনি তাঁর বাবার চেয়েও অনেক বেশী প্রভাবশালী ছিলেন। আমাদের বাড়ির উঠোনের উত্তরকোনে যে কুলগাছটা ছিল সেখানেই ছিল অনঙ্গচন্দ্রের ভিটা। তাদের কি পরিণতি হয়েছিল আসলে? চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জীবেন্দ্রকুমারের ভূমিকা ছিল অনেক। কোলকাতা থেকে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হত যার একটা কপি আমরা সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম। চট্টগ্রামে 'আর্য্যসঙ্গীত' একাডেমি সৃষ্টির পেছনেও দত্তপরিবারের যোগ আছে। ১৯১৬ সালে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে কার ভূমিকা ছিল বেশী বিপিনচন্দ্রের নাকি জীবেন্দ্রকুমারের? ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন নিয়ে আমরা পর্ব থেকে অপ্ররবান্তরে আগাবো। এবং অনুভব করব আমাদের বিনাশের কারণ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

গ্রাস

  বুঝি আর আমাকে দিয়ে হবে না কিছুই। অসময়ে, অনাহুত, অতি অনভিপ্রেত জানি, সমস্ত বিবাদী উষ্মার অন্তরালে হারিয়ে যাব আমার এ যাবৎ যতনে গড়া সুরের ...