সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

শিল্প ও স্বাধীনতা

 

স্বাধীনতা মানে উচ্ছৃঙ্খলতা নয়, তেমনি শৃঙ্খলা মানেও পায়ের শৃঙ্খল নয়। যথেচ্ছাচার যেমন কোন আচার নয়, তেমনি আচারে হস্ত-পদ বদ্ধ করে রাখাও সম্ভাব্য অনাচার আনয়নের ঔপচারিকতা মাত্র! বিরিয়ানিকে বিরিয়ানির স্বাদটা বাঁচিয়ে রেখে নিজের কায়দায় রাঁধলে সেটা স্বাধীনতা ও শৃঙ্খলা দুটোই রক্ষা করে, কিন্তু বিরিয়ানি রাঁধতে গিয়ে ওটাকে প্রায়-খিচুড়ি বানিয়ে ফেললে- তাকে স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে চালিয়ে দেয়া তাত্ব্বিকভাবে অন্তত সম্ভব নয়। তেমনি বিরিয়ানি যদি কেবল ভাতের তলায় মাংস বিছিয়ে দেবার রন্ধন কায়দা হয় তাহলে তা দিয়ে রাঁধুনীর মুখ-রক্ষার কাজও ঠিকমত রক্ষা হয় না! বক্তব্যের উদ্দেশ্য হল- বিরিয়ানিকে নিয়ে যত গবেষণাই হোক- পাতে তুললে, মুখে পুরলে যেন মনে হয়- হ্যাঁ এটাই বিরিয়ানি- হায়দ্রাবাদী হোক, কি করাচীর, কি কোলকেতার- দিস ইস ইট! এটা বোঝানো।

 

আমাদের কেবল জানতে হবে মসলাটি কি? মসলাই তো আসল জিনিস দাদা!

 

ধরুন রবি ঠাকুরের গান গাইছেন, স্বরলিপির এক মিলিমিটার এদিক ওদিক হয়ে গেলেই নরকে পতিত হবার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গাইতে হচ্ছে! ধরুন বিরিয়ানির ভাত সেদ্ধ হচ্ছে ঠিকটাক, মাংস সেদ্ধ হল ঠিকঠাক, সব হচ্ছে, মসলাটা ঠিক হচ্ছে না শুধু, সুগন্ধ আসছে না - এই মসলাটি হল ভাব! ভাব ব্যতিরেকে সঙ্গীত- কোন সঙ্গীতই তো নয়! আবার ধরুন সুগন্ধ হচ্ছে না দেখে বিরিয়ানির ওপর ম্যাগি-মসলা ছিটিয়ে দেয়াও তো ভাল বুদ্ধি নয়! রবীন্দ্রনাথের গানে রবীন্দ্রভাবনার নিজস্ব মসলা আছে। তাতে গজল-ঠুংরী-পপ-ব্লু’সের মসলা ছিটাতে হয় না! আবার রামপ্রসাদী গাইতে গিয়ে ওটা রবীন্দ্রসঙ্গীত বানিয়ে দিলেও বদখত লাগে! প্রতিটি সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এরকম একটা পরিমিত, মার্জিত তথা ভাবের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন লালিত্যপূর্ণ বোধ জাগিয়ে রাখা উচিত। নইলে গাইলেই হয়ত গান হবে- কিন্তু তাতে প্রাণ থাকবে না! মসলা ছাড়াও হয়ত দেখতে বিরিয়ানি হয়ে যাবে কিছু একটা, খেতে গেলে অমন মনে হবে না!

 

আমরা সবাই গাইতেই পারি। গাইবার স্বাধীনতা আমার আছে। গাইতে গেলেই আমাকে আগেই একজন সঙ্গীত-তত্ত্ব-বিশারদ হয়ে উঠতে হবে কেন? গান মানব-মনের একটা আদিম, অতি স্বচ্ছ্‌ল, সাবলীল অভিব্যক্তি। একটা গান গাইবার অধিকার শ্রীকান্ত আচার্য্যের যেমন আছে, একজন রিকশাচালকেরও ততটুকু আছে। এই অধিকারের প্রসঙ্গে আলোচনা কিন্তু করছি না। তাত্ত্বিক স্তরের আলোচনা যে সকলের জন্য নয় এই কথাটা বোঝার জন্য আরেকটি তত্ত্ব-বিশ্লেষণের দরকার হবে না আশা করি। ক্ষিদে পেলে খাই আমরা, খাবারের অধিকারী হবার জন্য রান্না জানা জরুরী? এটা কোন যুক্তি?

 

এক গাদা রাগ-রাগিনী শুদ্ধভাবে না জানলে গাইবার উপযুক্ত হলাম না! অমুক বাবুর গানের বইয়ের স্বরলিপির পান থেকে একটু চুন খসাচ্ছি বলে আমি জাতিচ্যুত হয়ে যাচ্ছি! অমুক খেয়াল গাইতে গিয়ে ওটা টপ্পা হয়ে গেল! ধ্রূপদ গাইছেন মনে হচ্ছে আগ্রার খেয়াল! হেন তেন শতপ্রকারেণ- বাতচিত বিতণ্ডার একটা মানসম্মত সমাধান খুঁজতে গেলে সঙ্গীতের গভীরতা, রসবোধ, সাধনের প্রণালী প্রভৃতি নিয়ে বিস্তৃত অধ্যয়ণ প্রয়োজন। নইলে ‘অন্ধের হস্তিদর্শন’ জাতীয় যত্তসব কাণ্ড হতেই থাকবে আর তা নিয়ে চলবে ঠোকাঠুকি অনন্তকাল। সর্বসাধারণের জন্য এইসব শিক্ষা স্ববিস্তারে প্রয়োজন তা নয়- কিন্তু তাঁদের মধ্যেও উচ্চতম আদর্শটি অন্তত প্রসারিত হওয়া উচিত। সকল লোকে সাধু হয় না, কিন্তু সাধুর চরণধুলি তো নিতে যায় প্রায় সকলে! আমরা যে আদর্শই মানি না কেন, অন্তত মহত্তম আদর্শটি যেন যোগ্য সম্মান লাভ করে তার জন্য সেই আদর্শের পরিচিতিও তো চাই!

 

আমার কথার সারমর্ম হল-

 

আমি স্বাধীনতার বিপক্ষে নই। মানুষ স্বভাবে স্বাধীনতাপ্রিয়, জীবনের অন্যতম লক্ষণ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, কিন্তু ‘স্বাধীনতা’ কেবল একটা শব্দ মাত্র নয়! দানবের কাছে স্বাধীনতা উন্মত্ততা! আত্মনিয়ন্ত্রনহীনতা কখনো শুভ-অর্থে স্বাধীনতা নয়। শিল্প প্রসঙ্গে বরাবরই এই কথা উঠে এসেছে যে -শিল্পী স্বাধীনতা সৃষ্টি করেন। এটা তো সত্যি বটেই। তার আগেই বুঝতে হবে আমি আদৌ শিল্পী-পদবাচ্য কি না! অপরের শিল্পের ওপর হাত চালানোর মেধাকে শিল্প বলে এমন কথা আমার জানা নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

গ্রাস

  বুঝি আর আমাকে দিয়ে হবে না কিছুই। অসময়ে, অনাহুত, অতি অনভিপ্রেত জানি, সমস্ত বিবাদী উষ্মার অন্তরালে হারিয়ে যাব আমার এ যাবৎ যতনে গড়া সুরের ...