‘আপনারা আমাদের ভাই……’
৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেও
শেখ মুজিবর রহমান দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে পশ্চিম-পাকিস্তানীদের নিজের ভাই বলছেন, এতে তাঁর
কোন কুন্ঠাও ছিল না, থাকার কোন প্রেক্ষাপটও ছিল না, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও এই ভাতৃত্বের
আবাহন শেখ মুজিবর রহমান বন্ধ করেননি কোনদিন। রাজনৈতিক বিরোধ, অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ, দিনের
পর দিন শোষণ, তাচ্ছিল্য অবজ্ঞা পরিশেষে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের হোতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে
তিনিই হাস্যবদনে আলিঙ্গন তো করেছেন! এই আলিঙ্গনকে কি রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলবেন নাকি
ভাতৃত্বের বাহুবন্ধন? আততায়ীর সঙ্গে কোনটা সম্ভব? ভুট্টোকে তবু যদি বলি মানুষ, আর যদি
স্বীকৃত ‘বাংলার কসাই’ (Butcher of Bengal) খ্যাত টিক্কা খানের সাথে শেখ মুজিবরের করমর্দনের
কথা ওঠে? টিক্কার তো মানুষ নামটাই ঘুচে গেছে কবে!
সবই হয়েছিল ১৯৭৪ সালেই
পাকিস্তানের মাটিতেই OIC সম্মেলনে! এই ১৯৭৪ এ-ই ভুট্টো বাংলাদেশ সফরেও আসেন। যদিও কতিপয়
বাংলাদেশী দেশপ্রেমী সেদিন প্রতিবাদ জানাতে সোচ্চার ছিলেন, আজকে তেমন হয়ত হবার কথা
নয়! শেখ মুজিবর রহমান দেশনায়ক হিসেবে নিজের স্বাধীনচেতা মনোভাবকে বজায় রাখলেও অন্তর
থেকে ‘আপনারা আমাদের ভাই’- সেন্টিমেন্ট থেকে বেরুতে কতটা পেরেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর
মাটি খুঁড়ে বের করার প্রয়োজনীয়তাও বা ক’জন অনুভব করেন?
নাস্তিক্য ও ইসলাম অবমাননার
সেন্টিমেন্টকে তোয়াজ করতে শিখে গিয়েছিলেন তিনিও! “কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়”
লিখে সেই একই বছর ১৯৭৪ সালে দাউদ হায়দার গ্রেফতার হলেন! মুজিবের নির্দেশেই তাঁকে দেশান্তরীও
হতে হল! ইসলামপন্থীদের সেদিনও এত শক্তি ছিল! সেদিন কবি ও কবিতার মুণ্ডপাত হয়েছিল! তবুও
মুজিব দোষীই রয়ে গেলেন! আজ তেমনি হাসিনা দোষী! আর সে সময়ের অগোছালো রাজনৈতিক খুনোখুনির
চিত্রও ইতিহাসের পরতে পরতে রয়ে তো গেলই! এসব ৭১ এর স্বাধীনতার পরের কথা হচ্ছে!
শেখ মুজিবর রহমানের পাকিস্তান
বিরোধের সাথে ভাইয়ে-ভাইয়ে দ্বন্দ্বের একটা রক্তপ্লাবী নাটকীয়তা আছে। এই দ্বন্দ্ব যেমন
মিথ্যে নয়, আবার তেমনই যতই রক্ত ঝরুক রক্তের টানটাও মুছে ফেলার মত নয়! এটা এক ধরণের
পারিবারিক লড়াইয়ের মত ব্যাপার। তিনি লড়াইয়ের মধ্যে থেকেও ভাইকে ভাই বলে ডাকতে তো দ্বিধা
করেননি। ভাইয়ে ভাইয়ে কাঁধে কাঁধে মিলিয়েই তাঁরা একদিন স্বাধীন পাকিস্তান হাসিল করেছিলেন।
এটা কি ভোলার কথা? একটা ‘ডাইরেক্ট একশন’ স্লোগান আজও বাংলাদেশে হামেশা শোনা যায়! অনেকে
জানেনই না এই ‘ডাইরেক্ট একশন’ কোথা থেকে এল? ৪৭ এর ইতিহাস ক’জন পড়ে? ক’জন আর ‘ডাইরেক্ট
একশন ডে’ মনে রাখে?
আজ বাংলাদেশে কোন বাঙালী
পাকিস্তানীকে ভাই বললে কারো এত আপত্তি তবে কেন হচ্ছে? একজন পাকিস্তানী ঐতিহাসিকভাবেই
একজন বাংলাদেশীর (অমুসলমানের নয়) ‘ভাই’, একজন পাকিস্তানী ধর্মের নামেও ‘ভাই’! এতটুকু
কথা স্বচ্ছ নয়? শেখ মুজিবর রহমান ‘ভাই’ ডাকতে পারলে বাকীরা না ডাকার কে?
এই ভাতৃত্বের আবাহন বজায়
রেখেও মুজিব পাকিস্তানে ‘গাদ্দার’ আর ‘ভারতের চর’ হিসেবে টিকে গেলেন, আর স্বদেশী পাকিস্তানীদের
কাছেও তিনি তাই, উপরন্তু তিনি ইসলামেরও শত্রু! তিনি ভারতের দাস, সেইসাথে তিনি বাংলাদেশে
হিন্দুদের বাপ!
৭৫ এ মুজিব হত্যার পরের
ঘটনা, আমার এক আত্মীয়, তিনি তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েন- তাঁকে তার সহপাঠীরা বলছে-
‘কি রে তোদের হিন্দুদের বাপ তো মরে গেল, এখন তোরা কি করবি?’ ভাবুন তাঁর সহপাঠীদের বয়স
কত হবে তখন? যা-ই হোক, সত্যিই আমার সেই আত্মীয় আর দেশে বাস করতে পারেননি। তার পর হিন্দু
উৎখাতের নতুন কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তান কেবল মাত্র মুসলমানদের আবাসভূমি হবে!
এই দাবী কি অন্যায্য? আপনারাই বলুন? নোয়াখালীতে এত হিন্দু কেটেও কি এই ন্যায্য অধিকার
আদায় করা গেল না? এতদিন একটা ইসলামের শত্রু ছিল বলেই এটা কষ্টকর হচ্ছিল। এখন আর সমস্যা
তো নেই! ৪৭ এর পর, ৭১ এ পাকিস্তানীরা হিন্দু-নিধন শুরু করেছিল পুরোদমে, মুজিব ভারতের
সাথে হাত মিলিয়ে কিছুটা বাঁচালেন! কাজটা খুবই খারাপ হয়েছিল বটে! মুসলমানও যে মরেছে
এ নিয়ে রাজাকারদের বক্তব্য কি তা আর কার অজানা? মুক্তিকামী মানুষ মাত্রেই ইসলামের শত্রু
যে!
পাকিস্তানে অনেকে আফসোস
করেছিল, যারা সত্যিটা জেনেছিল, তারা বলেন- ‘ইয়া আল্লা! মুসলমান হোকে মুসলমানকি সাথ
এইসা বদ-সলুক!’ -গেহর মুসলামনের সাথে হলে একটা কথা ছিল তবুও! এরা মডারেট ধর্মপ্রাণ
বান্দা!- গেহর মুসলমান মাত্রেই মুসলমানের শত্রু! তাই তো? অমুসলমান মরলে এতটা বিচলিত
হবার কি আছে?
আজও বাংলাদেশে স্লোগান
ওঠে ‘ইসলামের শত্রুরা হুঁশিয়ার সাবধান!’ এই শত্রু কারা? আমেরিকা-ইজরায়েল? হাসি আটকাতে
পারলাম না আর! গোটা পৃথিবীটাই, পৃথিবীর যাবতীয় শিল্প-সাহিত্য-কৃষ্টি আজ তাদের শত্রু
হয়ে যাচ্ছে! সমস্যাটা কেবল হিন্দুর সাথে মুসলমানের সংকটে নেই! কেবল প্রতিমা ভাঙচুর
পর্যন্ত এতদিন জায়েজ ছিল, এখন হাত মুজিবের ভাস্কর্যেও লাগছে নির্দ্বিধায়! এবং এটাই
শুনছি ধর্মসঙ্গত! রাষ্টের যেহেতু একটা ধর্মও আছে কেন না তার বিধি-বিধান ধর্ম না মেনে
চলবে। তাই না?
মুজিব ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র
চেয়েছিলেন। জিন্নাও তেমন ভাবতে চেয়েছিলেন- মুসলিম ম্যাজোরিটি নিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র,
যা পৃথিবীতেও একটিও নেই! এটা সম্ভব নয়। কামাল আতার্তুকের তুরস্ককেও পরে গিয়ে এরদোয়ান-ই
জুটেছে। যা হোক এই প্রসঙ্গ নিয়ে ঘেঁটে লাভ নেই। আমাদের আশে পাশের প্রতিটি দেশ গণতান্ত্রিক
ও ধর্মনিরপেক্ষ হবে- কিন্তু আমাদের একটা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম চাই-ই চাই! এত সুন্দর যুক্তিশীল
মননের অধিকারীদের সাথে কি তর্ক?
ভাতৃত্ববোধের আলোচনায় আসি।
আমার কখনো মনে পড়ে না- মুজিব ‘ভারতীয়রা আমাদের ভাই’ কথাটা উচ্চস্বরে কোনদিন বলেছেন!
সেটা বলার মত প্রেক্ষাপট আসেনি। এবং ভুলক্রমে সেটা কোথাও বললে সেই উক্তি তাঁর রাজনৈতিক
ভাবমূর্তির জন্য হানিকারক হবারই কথা ছিল। ভাই না ডেকেও যে গোলামের তকমা নিয়ে ফেলেছিলেন
এমনিতেই! আর ভারতেরও কোন অর্থেই ওই আবাহন দরকার পড়ত না। মুজিবের সাথে ইন্দিরার সম্পর্ক,
৭১এর যুদ্ধ সবটাই ভূরাজনৈতিক কারণে সংঘটিত। দু’পাশে দুটো শত্রু আর লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর
বোঝা লাঘবের চেষ্টা- ৭১ এর যুদ্ধ। এটাই তো- বাংলাদেশের রাজাকাররা আরেকটু বাড়িয়ে বলে,
তারা বলে- স্বাধীনতার পর ভারত লুটপাট চালিয়েছে- যদিও এর পেছনে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ
নেই! এদের কাছে বর্তমানে যেমন ‘হাসিনা ভারতের কাছে দেশ বেচে দিচ্ছে’ তেমনি সেদিন ‘মুজিবও
ভারতের কাছে দেশ বেচে দিয়েছিল!’ প্রতিটি রক্তকোষে যাদের হিন্দু ও ভারতবিদ্বেষ তাদের
কাছে এই ডায়ালগ পরম্পরা। তারা নতুন নতুন হাস্যকর লজিক যদিও অহরহ আনে। তাদের উদ্দেশ্যে
স্পষ্ট করে বলা- ‘ভাই ভারত চিরকালই তোমাদের জাতশত্রু, অতীতে বন্ধু ছিল বলে মিথ্যে যুক্তি
টানার কাজ নেই- ৪৭-এই তো প্রমাণ হয়ে গেছে, বারেবারে একে প্রমাণ করার তাগিদ কেন এত?
কিসের এত জ্বালা?’ এই জ্বালা নিভবেই বা কি করে? বাংলাদেশ আগামী এক যুগের মধ্যে পুরোপুরি
তালেবানি শাসন কায়েম করে ফেলতে পারলেও কি এই জ্বালা নেভানো যাবে?
আমি অন্তত কখনো এই কথা
বলিনি ‘ভারত ও বাংলাদেশ ভাই-ভাই’! এসব ফালতু কথা। কেউ এসব ফালতু কথা বললে আমার খুব
বিরক্ত লাগে। ভূ-রাজনীতি তো জি-বাংলা সিরিয়াল নয় যে রাতদিন সেন্টিমেন্টের খেলা চলবে!
তবে একটা ছবি মনে পড়ে আমার-
১৬ ডিসেম্বরে যখন ঢাকার
রাস্তায় ভারতীয় বাহিনীর ট্যাংক ঘুরে বেড়াচ্ছে, সাধারণ মানুষের কি উচ্ছাস, ফুল ছুঁড়ে
স্বাগত জানানো, কেঁদে কেটে বুকে জড়ানোর চিত্রটা মনে আছে আপনাদের? এই চিত্রকে অমলিন
রাখা যায়নি! রাখা সম্ভবও নয়। এই চিত্রটা ভাইয়ে-ভাইয়ে মিলনের না হলেও তার চাইতেও বেশী
হৃদয়স্পর্শী হয়ে বেঁচে ছিল দীর্ঘদিন। এটা সাময়িক। শুনেছিলাম ফিল্ড মার্শাল মানেক-শ’
নাকি বলেছিলেন- গোটা যুদ্ধটাই ভুল ডিসিশন!
মুজিব-ভুট্টোর হাস্যোজ্জ্বল
চিত্র দিয়েও রাজাকারপন্থীদের নতুন কিছু বোঝানোর নেই। বাংলাদেশকে পরিপূর্ণভাবে পাকিস্তানের
মত করে ফেলতে না পারলে তাদের শান্তি হবে না। এখন তাদের লক্ষ্যমাত্রা পাকিস্তান হবার
চাইতেও উন্নততর! তাদের লক্ষ্য কাবুল-কান্দাহারে গিয়ে ঠেকেছে। কাবুল-কান্দাহার যদিও
লাহোর-পেশোয়ারকে সহ্য করে না আর! ভাইয়ে-ভাইয়ে প্রেম সেখানেও টেকেনি। এসব সংঘাত নিয়ে
পর্যালোচনাও আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।
আমি অতি সহজ কথায় বললাম-
মুজিব পাকিস্তানীদের ভাই ডাকতে কখনো কুণ্ঠিত হন’নি, তাই বর্তমানে কোন বাংলাদেশী পাকিস্তানীদের
ভাই বললে তাঁকে পাকিস্তান-প্রেমী রাজাকার ডাকা একেবারে অবান্তর! তেমনি পাকিস্তান ভাই
কি ভাই নয় এই আলোচনা আসলেই সেখানে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ করার চেষ্টাও
হীনমন্যতা। পাকিস্তান ভাই ছিল এবং ভাই হিসেবেই থাকবে। কতিপয় পশ্চিমবাংলার অতি-উদারতায়
রুগ্ন, ইতিহাস বিস্মৃতির আলঝাইমার রোগীর কাছে বাংলাদেশের বাঙালিরা ‘আমাদের ভাই’ জাতীয়
আবেগ উৎপন্ন হয়েছে এবং এর সুযোগ্য কোন ফিডব্যাক ওদিক থেকে কদাচিৎ আসেইনি! রাতারাতি
ঘর-দোর-জমিজমা-মন্দির আর জমিদারী হারিয়ে, প্রাণটা নিয়ে পালিয়ে এসে, এপাড়ে আধপেটা খেয়ে
শরণার্থী হিসেবে দিনাতিপাত করা ওপাড়ের হিন্দুর পরের প্রজন্ম বরাবরই অতীত-ভুলো হয়ে হোক,
বা কাল্পনিক মাটির টানে ওদেশ ভোলেনি, ভাই-ভাই মরা কান্নাকে জিঁইয়ে রেখেছে- এদের কি
বলা যায় জানি না!
আমার বাপের হত্যকারী, আমার
মায়ের সম্ভ্রমে হাত দেবার সাহসকারী দানবকে আমি কোন অর্থেই কোনকালে বুকে জড়াতে পারব
না! মুজিব ভুট্টোকে বুকে নিতে পেরেছেন! আচ্ছা এটা মুজিবের উদারতা বলে ভুলে যাই বরং!
কিন্তু আমি তো উদার নই! আমার অত বড় অন্তর নেই! আমি ভুলতে পারি না! আমি আততায়ীকে ভাই
বলার মত মহাপুরুষ নই! আমার ভাইয়ের দিকে যার ছুরি ওঠে সে আগামী সাত জন্মেও আমার ভাই
হবে না! কোনদিন হতেই পারে না! সে বাঙালি কি পাঠান, কি মুসলমান কি গেহর মুসলমান! আমি
তাকে আততায়ী বলেই আগামী সাতজন্ম চিহ্নিত করে রেখেছি!
কোন বাংলাদেশী কোন পাকিস্তানের
সাথে কি সূত্রে ভাই হচ্ছে এই বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ও আপত্তি নেই, সে যদি আমাকে
ভাই ডাকে তাতেও আমি খুশী, সে যদি আমার দিকে ছুরি উঁচিয়ে চলাকে ধর্ম ভাবে- তবে ভাই আমি
গদগদ প্রেমবাক্য বলতে পারি না, আমি সপাটে তলোয়ারটা চালাব!
ভাই-ভাইয়ের গল্প আমার ঢের
শোনা আছে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন