রবিবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০২১

ফেলে কি সে যাবে চলে

 


রাত্রি ঘনিয়ে এলে, হৃদয়ের অলিগলি-

অচেনা লাগে, কোন চিলেকোঠা ঘরে

কোথাও ছিন্ন তারে বাগেশ্রী স্বরগুলি,

মীড়ে ঘুম ভেঙে দিয়ে বেদনায় ঝরে!

 

জনান্তিকে দেখা হলে জ্যোছনার সাথে,

সেও পরবাসিনী সাজে মুছে দিয়ে আলো,

কবিতার ছাই মেখে ঘুরি সারা গায়,

যদি কোন গানের তরী, থমকে দাঁড়ালো-

 

মাঝনদী, উজান রোলে, বানবাসী দেখে

ফেলে কি সে যাবে চলে, এভাবেই রেখে? 

শ্যামাসঙ্গীতের সংক্ষিপ্ত ধারা বিবরণ

 

১। পরব্রহ্মে মাতৃসত্ত্বা উপলব্ধির বিকাশ সনাতন সংস্কৃতিতে লক্ষ্যনীয় যদিও কিঞ্চিৎ বৈদিক যুগ থেকেই কিন্তু এর বিস্তৃত প্রভাব দেখা যায় ভারতবর্ষে তন্ত্রসাধনার প্রসার-পরবর্তী কালে। বিশেষত উত্তর-পূর্ব ভারতে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে বাংলায়। পুরাণ উপাখ্যান বর্ণিত দেবীর ৫১ শক্তিপীঠের অধিকাংশই বঙ্গে এবং দশমহাবিদ্যার উপাসনাও বিধৃত এখানেই। ঈশ্বরের মাতৃভাব আরাধনার এই ধারাকে শক্তি-উপসনা বলা হয়। এবং যারা এই ধারার সাধক ও এই ধারাকেই মানেন তাদের শাক্ত বলা হয়। যেমন বিষ্ণুর উপাসকগণ বৈষ্ণব, শিবের উপাসকগণ শাক্ত, তেমনি গণেশ পূজারীরা গাণপত্য, সূর্য্যদেবতার পূজারীরা সৌর। প্রথমোক্ত তিনটি ধারা আজও প্রচলিত ও সমাদৃত। তার মধ্যে শাক্তধারা কেবলমাত্র উত্তর-পুর্ব ভারতেই বেশী প্রবাহিত হচ্ছে।

 

২। তন্ত্রের দেবী, মাতৃশক্তি ভগবতী দুর্গা ও তাঁর নানাবিধ রূপবিগ্রহ অবলম্বনে শাক্তসাহিত্য, পুরাণ আদি আগে থেকেই আছে। তবে তা নিয়ে সঙ্গীতের আবির্ভাব অতি প্রাচীন কিছু নয়। যেমন বৈষ্ণব পদাবলীর সুদীর্ঘ ও গৌরবময় অতীত রয়েছে। রয়েছে কীর্তনের ৫টি স্বতন্ত্র ঘরানাও। শাক্ত-ধারার গানের তেমন বড় ইতিহাস নেই।

 

৩। পদাবলী কীর্তনের মত করেই কালীকীর্তনের উদয় হচ্ছে, এ পর্যন্ত যে ইতিহাস নথিভুক্ত তা অনুযায়ী- সপ্তদশ শতকেই। মূলত রামপ্রসাদ সেনকেই এই নতুন সংস্কৃতির বাহক মেনে নিলেও আমাদের বিশ্বাস শাক্তদের গান তারও প্রাচীন। রামপ্রসাদ তাতে অভিনবত্ব এনেছেন। রামপ্রসাদের সুর প্রাচীন বাংলা কীর্তনেরই অপভ্রংশ। এ ছাড়াও তিনি ধ্রুপদ শৈলীতে গান রচনা করেছেন। রামপ্রসাদের প্রসাদী-সুরে গানে বদ্ধ বাণীর ভাব-ভাষা ও ধ্রুপদরীতিতে লেখা গানের ভাব-ভাষার স্বাতন্ত্র্য সহজেই দৃষ্টি কাড়ে। সম্ভবত রামপ্রসাদের আগে সহজ ভাষায় এমন গান কেউ লেখেননি, তবে ধ্রুপদী ঢঙ্গের কালীকীর্তন তাঁর আগেরও হতে পারে! নদীয়ার রাজবাড়িতে এই ধারার সঙ্গীতের চল ছিল। আমরা নাটোরের রাজবাড়িতেও এমন গান হবার হদিশ পাচ্ছি।

 

৪। শক্তি-সাধনার প্রাণসঞ্চার দেবী দুর্গা থেকে হলেও এখানে আরাধ্যা হয়েছেন দশমহাবিদ্যা এবং মূখ্যরূপে দেবী কালিকা। ঘোররূপা সংহারমুরতি শ্মশানচারিণী দেবীকে ঘরের মেয়ে এবং শিশুর একান্ত আশ্রয় মা হিসেবে আধার করেছেন রামপ্রসাদ এবং পরবর্তী শাক্ত-সাধক গীতিকারেরা। রামপ্রসাদের পূর্বে এই ভাবনা প্রতিষ্ঠিত ছিল বলে মনে হয় না। রামপ্রসাদের গানই ভয়ংকরী মাতৃশক্তিকে ঘরের মেয়ে করে ঘরে ঘরে ঠাঁই দিয়েছে বললে অতিশয়োক্তি হবে না। অনেকে মনে করেন শক্তিসাধনার এই জাগরণের পেছনে তদানীন্তন সমাজ-জীবনের প্রেক্ষাপটও দায়ী। পরাধীন ভারতের জরাগ্রস্ত দীন হিন্দু সমাজ, তার ওপর অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা, দুর্ভিক্ষ, মড়ক প্রভৃতিতে কাতর একটি জনপদের হাহাকার নিবারণে একজন পরমচৈতন্যকারিণী মায়ের আবির্ভাব ফুটে বেরিয়েছে সাধকের কণ্ঠ থেকে। আমরা ভাবীকালের বৃটিশ-পদানত ভারতেও দেখেছি, আধুনিক কালের শ্যামাসঙ্গীতেও দেবীকে দেশের সাথে মিশিয়ে নিতে, দেশোদ্ধারে মাকে ডাকতে! এই ধারার লেখায় নজরুল অগ্রগণ্য। আছেন মুকুন্দ দাস থেকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও।

৫। কালীকীর্তনে কয়েকটি ভাগ দেখা যায়। প্রথম ভাগে আমরা দেখব আগমনী গান, পরের ভাগটিকে আমরা বলব মাতৃবন্দনা, আরেকটি কিছুটা গৌণ ভাগ- তা হল বিজয়ার গান। এ ছাড়াও শাক্তপদে শ্রীকৃষ্ণের বাললীলার মত করে ‘মায়ের বাললীলা’ও দেখানোর প্রয়াস হয়েছে। তবে তা প্রসিদ্ধি পেল না। রামপ্রসাদের রচনায় আগমনী কিছুটা এসেছে, বিজয়া নেই বললেই চলে। বাকী সকল গান মায়ের আবাহণ, রূপ-গুণ বর্ণনা, নিবেদন ও আর্তি, এবং অভিমান-গাঁথা। রামপ্রসাদ পরবর্তী যুগেও এমন ধারা বজায় রেখেছেন কমলাকান্ত থেকে দাশরথি রায়ের প্রজন্মও কিন্তু কোথাও রামপ্রসাদের মত সাবলীলতা দেখা যায় না।

 

৬। অষ্টাদশ শতকের কবিদের শ্যামাসঙ্গীতে ভাষার জমক দারুণ। দাশরথি রায়ের নাম না নিলে আলোচনাটাই অসম্পূর্ন। অষ্টাদশ শতকে বাংলা গানের ভাষাও রামপ্রসাদ-কমলাকান্ত যুগের ভাষার চাইতে অনেক এগিয়ে এসেছে। শুধু ভাষা নয়, সুরের উপস্থাপনাও বদলেছে অনেকভাবে। আগে যেখানে সুরে কীর্তন ও ধ্রুপদের ঢঙ লক্ষ্য করছি আমরা, পরে গিয়ে তাতে খেয়াল-ঠুমরি-টপ্পার আবহও জুড়ে যাচ্ছে। আখড়াই গান, কিম্বা নিধুবাবু, সাতুবাবু, দানীবাবু, কালীমির্জার যুগের শ্যামাগান দেখতে পারি আমরা।

 

৭। দাশরথি রায়ের গান আমরা মাতৃসাধক রামকৃষ্ণ পরমহংসের কন্ঠে শুনতে পাচ্ছি। রামকৃষ্ণ পরমহংস মাতা ভবতারিণীকে কেন্দ্র করে যেন মাতৃনামের প্রবাহ এনেছিলেন, তাতে নববিধান ব্রাহ্মসমাজের ত্রৈলোক্যনাথ স্যান্নালকেও দেখছি মাতৃভাবের ব্রহ্মোপাসনার গান লিখে যেতে। এও এক নতুন সংযোজন বলা যেতে পারে। আরেকটি কথাও বলতে হবে- শ্রীরামকৃষ্ণ মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, যিনি প্রেমিক মহারাজ নামে প্রখ্যাত ছিলেন তাঁর গানও গাইতেন, দুজনই সমসাময়িক কালের। প্রেমিক মহারাজ ধ্রুপদে কালীকীর্তন বেঁধে কালীকীর্তনকে পূর্বতন ধারায় সমৃদ্ধ করে গেছেন।

 

৮। কালীকীর্তন উনবিংশ শতকে এসে আধুনিক অবয়ব পেয়ে শ্যামাসঙ্গীত হয়ে গেল। তার পর আমরা শ্যামাসঙ্গীত নিয়ে বাঙালীর উচ্ছাস দেখতে পাচ্ছি। শ্যামাসঙ্গীতের জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে গ্রামাফোন রেকর্ড কোম্পানিগুলো শ্যামাসঙ্গীত রচয়িতা খুঁজতে মরীয়া হয়েছেন। এই যুগেই আমরা নজরুলের আগমন দেখতে পাচ্ছি। যাঁর হাতে শ্যামাসঙ্গীত একটি নিজস্ব মাত্রা পেয়েছে।

 

৯। ওপরের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মাতৃ-আরাধনার এই গানের ধারাটিও অন্তত ৩০০ বছর ধরে বাঙালীর সঙ্গীত-জগতে অনন্য স্থান নিয়ে জাগরুক ছিল যদিও আজ কিছুটা ম্লান। বাঙালীর ঘরে যত দিগগজ গায়ক-গীতিকার-সুরকার জন্মেছেন কেউই তাঁদের সঙ্গীত-জীবনে এই ধারার অস্তিত্বকে না টেনে থাকতে পারেননি। রবীন্দ্র-রজনী-অতুল-দ্বিজেন-নজরুল কেউ-ই পারেননি!

 


বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২১

আমায় রাখো

 

হরি হে!

আমায় রাখো নত তৃণের মত পথের পাশে,

যেথায় তোমার চরণচিহ্ন নিত্য লাগে, নিত্য আসে-

নূপুরধ্বনি কর্ণে আমার, মর্মে আমার নিত্য রাজো-

গভীর মনে লুকিয়ে হরি, ব্রজের বনে অমনি বাজো-

মোহনবেণু; লুটিয়ে রই চরণরেণু- মাথায় ধরে,

এবার ম’লে উরগ হব, কালীয় রাজার ফণার পরে-

যেমনি তোমার নাচন লাগে, তেমনি আমার চিত্ত মাগে,

নয়নডোরে- বাঁধব বলে কৃষ্ণশশী, মন উদাসী, যেমন জাগে-

প্রভাতবেলা অনাঘ্রাত ফুলের কলি,

যেমনতর- পুষ্পরসে মাতাল ঘোরে ভৃঙ্গগুলি,

অমন করে কাঙাল হলেম, দরশ তোমার পাবার আশে!

হরি হে! আমায় রাখো নত তৃণের মত পথের পাশে!

 

ছয়দিকে ছয় কংসচরে, অহর্নিশা- তাড়িয়ে মারে,

না পাই দিশা, মরছি কেঁদে করাল ঘোর অন্ধকারে!

যদি উদয় হতে সূর্য্যসম, কংসাসুরের কারায় মম-

অমন আশার বাসা বইছি যেন জন্ম-মৃত্যু-জন্ম ধরে,

লোকে লোকে আকুল হয়ে লোকান্তরে,

পাইনে দেখা, ললাট-লেখা তুমিই জানি লিখলে বটে,

নিদয় তুমি নন্দিত তায়, সাধে কি আর তেমন রটে!

মা যশোদার বুক ভাসালে, একটিবারও চাওনি ফিরে,

তবুও আমার সাধ হয়েছে, সাধেই ডুবি নেত্র-নীরে!

আমি দু’হাত তুলে আকাশপানে, ক্ষীণস্বরে, কাতর প্রাণে

ডাকছি আমার পাষাণ-কৃষ্ণ, বধির কেন হলে?

লোকে তোমায় বলবে কি গো, এমনি আমি ম’লে?

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


বুধবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২১

অপহ্নব

 

অনেক ব্যহৃত পঙক্তি-ভীড়ে

আমার কিছু গোপন বর্ণমালা,

কিছু অভিমান, কিছু পরিত্যাজ্য গান,

ক্রন্দসীর মধ্যে গেছে মরে!

 

এখানে এত কথা, এখানে এত উছল প্রাণ

সর্বস্ব আমার বিপরীতে বিরাজমান

বিমূর্ত শ’খানেক অর্থহীন কবিতার মত,

দ্ব্যর্থহীন, গৌরবাভিলাষী হয়ে-

তবুও শেষবেলার ফুলের মত ঝরে!

 

বৃন্তচ্যুত হয় না যদিও সকল স্বর-গ্রাম

হামেশা সকল বুকভাঙ্গা রাগিণীর পকড় থেকে,

মূক-মরমে লাগে না সকল তান-

সকল বাঁকিয়ে চলা মীড়, কোন তটিনী তীর রেখে

আমার অঙ্গে অঙ্গে ঢেউ ভেঙে!

 

আমি কত সহস্রাব্দ বসে আছি নিশ্চল,

নিশব্দে ব্যোমপানে নয়ন করেছি স্থির,

আমার ভেতর অধীর, কি এক কালাতীত কবির-

বধির ছন্দ-রোল ঘনিয়ে ঘনিয়ে আসে রাত্রির-

মত, কত সুর প্রহৃত, কত বেদনা বিনা-ঋত

কত সত্য অপহ্নব, নব নব মিথ্যের হাত ধরে,

আমি দেখে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছি!

 

 

 


শুক্রবার, ৮ জানুয়ারী, ২০২১

চন্দ্রকোঁষ


 

প্রথমেশ্বর প্রমথেশ্বর ত্রিলোচন ত্রিপুরারি।

পতিতপাবন পার্বতীপতি প্রভু শম্ভু পিণাকধারী।।

ভস্মভূষণ শিরে জটাজাল, গলে পন্নগ, কপালমাল,
কটিতটপর শার্দুলছাল, যোগীজন মনোহারী।।
কিশোরচন্দ্র-শোভিত-ভাল, ধ্যানমুরতি মহাকাল
চন্দ্রকোঁষে বাঁধি একতাল, চন্দ্রচূড় রূপ নেহারি।
বিশ্বনাথ বিশ্ববিধাতা, সুর-সঙ্গীত, মুক্তি-প্রদাতা
বিশাখ ভনে ব্যকুল পরাণে, দরশন দাও দয়াধারী।।

রচনা ও সুর - ৭/১/২১

সোমবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২১

লিখব কি আরো?

 

কিয়দংশ যন্ত্রণার ভাগ নিতে পারো?

কীটদষ্ট, ফিরেছে যে ফুল, পরাগায়নের শেষে;

ফিরে গেছে নীল জল, সাগরের কূল,

অস্তিত্বের গভীরতম দেশে, খোঁজ নেই কারো!

 

তুমি কিছু ভাগ নিতে পারো?

 

খান-কতক কবিতার মিথ্যা-ভাষণের মত

কত কথা অক্লান্ত তলে তলে বয়ে গেছে!

স্রোতহীনা, নাম তার স্রোতস্বিনী দিয়ে-

এক মূক রাত্রির বুকে নির্বিকার মুখ গুঁজে থাকা

জনান্তিকে, এমন বৈকল্য ধরে বৈরাগ্য ছুতায়,

মুখের ছদ্মবেশে মুখোশকে ঢাকা-

 

আমি লিখব কি আরো?

 

 

 

 

 

 

গ্রাস

  বুঝি আর আমাকে দিয়ে হবে না কিছুই। অসময়ে, অনাহুত, অতি অনভিপ্রেত জানি, সমস্ত বিবাদী উষ্মার অন্তরালে হারিয়ে যাব আমার এ যাবৎ যতনে গড়া সুরের ...