১। পরব্রহ্মে মাতৃসত্ত্বা উপলব্ধির বিকাশ সনাতন সংস্কৃতিতে
লক্ষ্যনীয় যদিও কিঞ্চিৎ বৈদিক যুগ থেকেই কিন্তু এর বিস্তৃত প্রভাব দেখা যায় ভারতবর্ষে
তন্ত্রসাধনার প্রসার-পরবর্তী কালে। বিশেষত উত্তর-পূর্ব ভারতে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে বাংলায়।
পুরাণ উপাখ্যান বর্ণিত দেবীর ৫১ শক্তিপীঠের অধিকাংশই বঙ্গে এবং দশমহাবিদ্যার উপাসনাও
বিধৃত এখানেই। ঈশ্বরের মাতৃভাব আরাধনার এই ধারাকে শক্তি-উপসনা বলা হয়। এবং যারা এই
ধারার সাধক ও এই ধারাকেই মানেন তাদের শাক্ত বলা হয়। যেমন বিষ্ণুর উপাসকগণ বৈষ্ণব, শিবের
উপাসকগণ শাক্ত, তেমনি গণেশ পূজারীরা গাণপত্য, সূর্য্যদেবতার পূজারীরা সৌর। প্রথমোক্ত
তিনটি ধারা আজও প্রচলিত ও সমাদৃত। তার মধ্যে শাক্তধারা কেবলমাত্র উত্তর-পুর্ব ভারতেই
বেশী প্রবাহিত হচ্ছে।
২। তন্ত্রের দেবী, মাতৃশক্তি ভগবতী দুর্গা ও তাঁর নানাবিধ
রূপবিগ্রহ অবলম্বনে শাক্তসাহিত্য, পুরাণ আদি আগে থেকেই আছে। তবে তা নিয়ে সঙ্গীতের আবির্ভাব
অতি প্রাচীন কিছু নয়। যেমন বৈষ্ণব পদাবলীর সুদীর্ঘ ও গৌরবময় অতীত রয়েছে। রয়েছে কীর্তনের
৫টি স্বতন্ত্র ঘরানাও। শাক্ত-ধারার গানের তেমন বড় ইতিহাস নেই।
৩। পদাবলী কীর্তনের মত করেই কালীকীর্তনের উদয় হচ্ছে, এ পর্যন্ত
যে ইতিহাস নথিভুক্ত তা অনুযায়ী- সপ্তদশ শতকেই। মূলত রামপ্রসাদ সেনকেই এই নতুন সংস্কৃতির
বাহক মেনে নিলেও আমাদের বিশ্বাস শাক্তদের গান তারও প্রাচীন। রামপ্রসাদ তাতে অভিনবত্ব
এনেছেন। রামপ্রসাদের সুর প্রাচীন বাংলা কীর্তনেরই অপভ্রংশ। এ ছাড়াও তিনি ধ্রুপদ শৈলীতে
গান রচনা করেছেন। রামপ্রসাদের প্রসাদী-সুরে গানে বদ্ধ বাণীর ভাব-ভাষা ও ধ্রুপদরীতিতে
লেখা গানের ভাব-ভাষার স্বাতন্ত্র্য সহজেই দৃষ্টি কাড়ে। সম্ভবত রামপ্রসাদের আগে সহজ
ভাষায় এমন গান কেউ লেখেননি, তবে ধ্রুপদী ঢঙ্গের কালীকীর্তন তাঁর আগেরও হতে পারে! নদীয়ার
রাজবাড়িতে এই ধারার সঙ্গীতের চল ছিল। আমরা নাটোরের রাজবাড়িতেও এমন গান হবার হদিশ পাচ্ছি।
৪। শক্তি-সাধনার প্রাণসঞ্চার দেবী দুর্গা থেকে হলেও এখানে
আরাধ্যা হয়েছেন দশমহাবিদ্যা এবং মূখ্যরূপে দেবী কালিকা। ঘোররূপা সংহারমুরতি শ্মশানচারিণী
দেবীকে ঘরের মেয়ে এবং শিশুর একান্ত আশ্রয় মা হিসেবে আধার করেছেন রামপ্রসাদ এবং পরবর্তী
শাক্ত-সাধক গীতিকারেরা। রামপ্রসাদের পূর্বে এই ভাবনা প্রতিষ্ঠিত ছিল বলে মনে হয় না।
রামপ্রসাদের গানই ভয়ংকরী মাতৃশক্তিকে ঘরের মেয়ে করে ঘরে ঘরে ঠাঁই দিয়েছে বললে অতিশয়োক্তি
হবে না। অনেকে মনে করেন শক্তিসাধনার এই জাগরণের পেছনে তদানীন্তন সমাজ-জীবনের প্রেক্ষাপটও
দায়ী। পরাধীন ভারতের জরাগ্রস্ত দীন হিন্দু সমাজ, তার ওপর অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা,
দুর্ভিক্ষ, মড়ক প্রভৃতিতে কাতর একটি জনপদের হাহাকার নিবারণে একজন পরমচৈতন্যকারিণী মায়ের
আবির্ভাব ফুটে বেরিয়েছে সাধকের কণ্ঠ থেকে। আমরা ভাবীকালের বৃটিশ-পদানত ভারতেও দেখেছি,
আধুনিক কালের শ্যামাসঙ্গীতেও দেবীকে দেশের সাথে মিশিয়ে নিতে, দেশোদ্ধারে মাকে ডাকতে!
এই ধারার লেখায় নজরুল অগ্রগণ্য। আছেন মুকুন্দ দাস থেকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও।
৫। কালীকীর্তনে কয়েকটি ভাগ দেখা যায়। প্রথম ভাগে আমরা দেখব
আগমনী গান, পরের ভাগটিকে আমরা বলব মাতৃবন্দনা, আরেকটি কিছুটা গৌণ ভাগ- তা হল বিজয়ার
গান। এ ছাড়াও শাক্তপদে শ্রীকৃষ্ণের বাললীলার মত করে ‘মায়ের বাললীলা’ও দেখানোর প্রয়াস
হয়েছে। তবে তা প্রসিদ্ধি পেল না। রামপ্রসাদের রচনায় আগমনী কিছুটা এসেছে, বিজয়া নেই
বললেই চলে। বাকী সকল গান মায়ের আবাহণ, রূপ-গুণ বর্ণনা, নিবেদন ও আর্তি, এবং অভিমান-গাঁথা।
রামপ্রসাদ পরবর্তী যুগেও এমন ধারা বজায় রেখেছেন কমলাকান্ত থেকে দাশরথি রায়ের প্রজন্মও
কিন্তু কোথাও রামপ্রসাদের মত সাবলীলতা দেখা যায় না।
৬। অষ্টাদশ শতকের কবিদের শ্যামাসঙ্গীতে ভাষার জমক দারুণ।
দাশরথি রায়ের নাম না নিলে আলোচনাটাই অসম্পূর্ন। অষ্টাদশ শতকে বাংলা গানের ভাষাও রামপ্রসাদ-কমলাকান্ত
যুগের ভাষার চাইতে অনেক এগিয়ে এসেছে। শুধু ভাষা নয়, সুরের উপস্থাপনাও বদলেছে অনেকভাবে।
আগে যেখানে সুরে কীর্তন ও ধ্রুপদের ঢঙ লক্ষ্য করছি আমরা, পরে গিয়ে তাতে খেয়াল-ঠুমরি-টপ্পার
আবহও জুড়ে যাচ্ছে। আখড়াই গান, কিম্বা নিধুবাবু, সাতুবাবু, দানীবাবু, কালীমির্জার যুগের
শ্যামাগান দেখতে পারি আমরা।
৭। দাশরথি রায়ের গান আমরা মাতৃসাধক রামকৃষ্ণ পরমহংসের কন্ঠে
শুনতে পাচ্ছি। রামকৃষ্ণ পরমহংস মাতা ভবতারিণীকে কেন্দ্র করে যেন মাতৃনামের প্রবাহ এনেছিলেন,
তাতে নববিধান ব্রাহ্মসমাজের ত্রৈলোক্যনাথ স্যান্নালকেও দেখছি মাতৃভাবের ব্রহ্মোপাসনার
গান লিখে যেতে। এও এক নতুন সংযোজন বলা যেতে পারে। আরেকটি কথাও বলতে হবে- শ্রীরামকৃষ্ণ
মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, যিনি প্রেমিক মহারাজ নামে প্রখ্যাত ছিলেন তাঁর গানও গাইতেন,
দুজনই সমসাময়িক কালের। প্রেমিক মহারাজ ধ্রুপদে কালীকীর্তন বেঁধে কালীকীর্তনকে পূর্বতন
ধারায় সমৃদ্ধ করে গেছেন।
৮। কালীকীর্তন উনবিংশ শতকে এসে আধুনিক অবয়ব পেয়ে শ্যামাসঙ্গীত
হয়ে গেল। তার পর আমরা শ্যামাসঙ্গীত নিয়ে বাঙালীর উচ্ছাস দেখতে পাচ্ছি। শ্যামাসঙ্গীতের
জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে গ্রামাফোন রেকর্ড কোম্পানিগুলো শ্যামাসঙ্গীত রচয়িতা
খুঁজতে মরীয়া হয়েছেন। এই যুগেই আমরা নজরুলের আগমন দেখতে পাচ্ছি। যাঁর হাতে শ্যামাসঙ্গীত
একটি নিজস্ব মাত্রা পেয়েছে।
৯। ওপরের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মাতৃ-আরাধনার
এই গানের ধারাটিও অন্তত ৩০০ বছর ধরে বাঙালীর সঙ্গীত-জগতে অনন্য স্থান নিয়ে জাগরুক ছিল
যদিও আজ কিছুটা ম্লান। বাঙালীর ঘরে যত দিগগজ গায়ক-গীতিকার-সুরকার জন্মেছেন কেউই তাঁদের
সঙ্গীত-জীবনে এই ধারার অস্তিত্বকে না টেনে থাকতে পারেননি। রবীন্দ্র-রজনী-অতুল-দ্বিজেন-নজরুল
কেউ-ই পারেননি!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন