রোজ
এই পোড়া ফেসবুকে পড়ে থাকি। পড়ে থাকার দায় নেই, তবে ঠেকা আছে- ঠেকায় পড়ে থাকা যাকে বলে।
বাঁচার দায়ে কিছু যোগাযোগ রক্ষা আর কিছু যোগাযোগ বৃদ্ধির ঠেকা আছে! ফেসবুক তাতে কিছুটা
সহায়তা করে। দু’চার জন মানুষের সাথে একেবারে বার্তালাপ না রাখলেও মানুষ হিসেবে ‘সামাজিক-যোগাযোগ-মাধ্যম’-সর্বস্ব
যুগে একেবারে অসামাজিক হয়ে পড়ব! নিজের ঢাকও একটু পেটাতে গেলে শূণ্য ময়দানে পিটিয়ে কি
লাভ হবে? নিজেকে বা নিজের আহৃত সম্পদের ভাগ বেচব ভাবলেও- এই বাজারে তো নামতেই হয়! সেদিক
বিবেচনা করেও আছি। আমার তো কদাপি শতাধিক বন্ধুর দরকার নেই! লোকজন সব আমাকে ‘ফ্রেণ্ড-রিকোয়েস্ট’
পাঠিয়ে আমায় গৌরবান্বিত করেছেন, আর আমি প্রত্যহ ফেসবুকে এসে সকলের কিচিরমিচির দেখি!
ভাল-মন্দের কথা বলি না, তবে আমার নিভৃতচারী অন্তরাত্মা মাঝেমাঝেই খিন্ন হয়ে ওঠে! আমার
স্ব-সৃজিত একাকীত্ব, স্বেচ্ছাকল্প নির্বাসন, আমৃত্যু নিঃসঙ্গপ্রিয় থাকার উদগ্র বাসনার
সাথে এই গোটা ফেসবুকীয় ব্যাপারটা একেবারে বেমানান! শুধু ফেসবুক বলে নয়, আমি বাস্তবিক
জগতেও তেমন। মুখচোরা নই, তবে মুখটি সর্বদা দেখিয়ে বেড়াতে হবে এমন অভিপ্রায় আমার মনে
জাগে না! বরাবরই এমন ছিলাম। চিরদিন আমারই মতন। লোকে হয়ত গোঁয়ার ভাবে, হয়ত ভাবে সমাজবিমুখ,
সুহৃদেরা ভাবেন হয়ত আমি উদাসীন! সে যার যা ইচ্ছে ভাবুক- এই আমি বেশ আছি হয়ত বা। নিজেও
অতটা নিশ্চিত নই- কোন অবস্থাকে যথার্থ ভাল থাকা বলে! গোটা ব্রহ্মাণ্ডই যেখানে আপেক্ষিত
সত্য! কিন্তু আপাতত আমার জীবনে এই ভাবনাটা বেশ যুৎসই ঠেকে! অন্তর্দ্বন্দ্ব কিছু জিঁইয়ে
রাখতে নেই। তবু থাকে। যেখানে দ্বন্দ্ব নেই, যেখানে ঘা’ লাগে না, সেখানে সৃষ্টির দ্যোতনা
জাগে না! কোন অনুরণন ওঠে না ভেতরে। থমকে যাব। ভেতরে নিজেকে কয়েকভাগ করে ঠোকাঠুকি চলে
হয়ত, কখনো মনে হয় আমি স্ববিরোধে মেতে যাচ্ছি- আমার বহিঃপ্রকাশ অস্বচ্ছ, অথবা তা একেবারে
নেই। যেটুকু হয়- আমি চাই তাতে শিল্প হোক। কেবল কথা বলার ইচ্ছে, বলার শক্তি আছে বলেই
কথা- কথা হয়ে বেরুক, অমন নয়, কথা হোক সুরে ও ছন্দে! আমি যে সেখানেও একা। গাইলেই সকলে
গায়ক গায়িকা হয়ে ওঠেন, কিন্তু গাইতে পারার সাথে কবিত্বের দূর দূর তক সংযোগ নেই। লালনের
গান গাইতে পারা, আর লালনের মত ভাবতে পারাতে যে আসমান-জমিন ফারাক! আমি যে সেখানেও দূরে
সরে গেলাম! দূরে পড়ে রইলাম! আমার দুটো তানপুরা, একজোড়া তবলা, দশটা হারমোনিয়াম, হেনতেন
যন্ত্রপ্রকরণ, আর দু একটা জ্বলজ্বলে খেতাবের সঙে মন টানে না! স্বস্নেহে আমাকে অযোগ্যও
বলতে পারেন। আমি কষ্ট পাই না। ভরসা টুটতে টুটতে তাতে অভ্যস্ততা জন্মেছে। আমি মাঝে মাঝে
জানালার বাইরে নয়নস্থির করে ভাবি- আমি একটা একতারা হাতে মেঠো পথে ঘুরে ঘুরে মরছি! আমার
কাউকে কিছু শোনানোর নেই, কাউকে কিছু জানানোর নেই, কিছু বোঝানোর নেই। আমি নিজেকে নিজে
শোনাই-
‘বড়
আশার বাসা এ ঘর
পড়ে
রবে কোথা রে কার
ঠিক
নাই তারি!’
কত
কথা, কত কচকচ করে চোখের ওপর বালি, ক্লান্ত হয়ে যাই রগড়ে রগড়ে, একঘেঁয়ে, দৃষ্টি ধূসর
হয়ে যাবে! এর মধ্যেই নিয়ত বেঁচে থাকার নিত্য-নতুন প্রচেষ্টা অসহনীয় লাগে আমার। আমাকে
কেন এখানেই বাঁচতে হবে? আমি সুখ ও স্বর্গে আস্থা রাখি না, মানুষের আয়োজনে সেজে উঠে
শান্তি পাব এমন তত্ত্বেও আমি বিতৃষ্ণ, আমি একেবারে শতবর্ষজীবি মহাবৃক্ষের ন্যায় এক
ভূমিতে শেকড় গেঁড়ে শাখাপ্রশাখা প্রসারিত করে বেঁচে থাকব- তেমন প্রাণসম্পদে পূর্ণও নই।
আমি একটি অতিশয় ক্ষুদ্র মানব, আমার অভীপ্সা কেবল এই ক্ষুদ্রতাকে আরও শৃঙ্ক্ষলিত না
করার। সোনায় গড়া শেকল, যত উজ্জ্বলই হোক- ওর কাজ তো বেঁধে রাখা!
আমি
এই বেশ আছি। সুখে আছি, দুঃখে আছি- বেশ আছি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন