সোমবার, ২৩ মার্চ, ২০২০

১৯-২০ এর মড়ক


হঠাৎ করে আমরা খুব অসহায় হয়ে গেলাম! আমরা ভাবিনি এমনও হতে পারে! আমরা ভাবিনি এই ২০২০ সালের কথিত সমৃদ্ধির মরসুমে আমাদের একটা প্রাগৈতিহাসিক মড়কের সামনে এসে দাঁড়াতে হবে! আমরা ভাবিনি আমরা ঘরে বসে ভাবব ঠিক কতদিনের খাবার আমরা আপাতত ঘরে সঞ্চয় করে রাখলাম আজ, কতদিন এ দিয়ে চলবে, কোন আসু দুর্ভিক্ষের হাতিছানি আমরা দেখছি কি না, বাজার তো একদিনের মধ্যেই কালোবাজারিদের খপ্পরে- রেশনকার্ড আছে তো আলমারির সুরক্ষিত স্থানে রাখা! বাইরে বেরুনো বারণ। সরকার বলছে, পুলিশ ধরবে আমাদের বাইরে বেরুলে। জরিমানা ও হাজতবাস দুটোই জুটতে পারে! আমরা কোন ভয়ংকর যুদ্ধের মুখে দাঁড়িয়ে পড়িনি! আমাদের বাতাসে আতংক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাতাসে যমদূতেদের দেখা যাচ্ছে! তারা কখন যে কাকে যমপুরীতে নিয়ে যাচ্ছে তার কোন পূর্বানুমাণও সম্ভব নয়! হাজার তিনেক চীনা মরে গেল। আমরা অ-চীনারা ভাবলাম চীন দেশের ওই সব আমাদের অচেনাই হয়ত থেকে যাবে। কিন্তু তা হল কই? দেশে দেশে উড়ে গেল মড়ক! একটা একটা করে খাঁচা নড়েচড়ে ওঠে! এমন চৈনিক উদ্ভাবনী শক্তির সামনে নানান অ-চীন নগরের ‘খাঁচার ভেতর অচীন পাখি’র দল বেশীক্ষণ টিকতেই পারছে না! ইউরোপ ছারখারে যাচ্ছে! আমেরিকা যাচ্ছে জ্বলে। আমরা সারা ভারতে বসে ভাবছি এখন- আমাদের কপালে কি দেখা বাকী! আমরা কি মহাকালের এক বিরাট লোকক্ষয়ী করাল বিবরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছি, আমরা কি সকলেই স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি, নাকি আমরা সব্বাই স্তব্ধ হব  না, আমাদের কেউ কেউ রয়ে যাবে স্বাক্ষী হয়ে? এসব কথার আপাতত কোন উত্তর নেই! দুশ্চিন্তা রোধের কোন ভ্যাক্সিন আসেনি! ভ্যাক্সিন আসেনি মড়ক থামানোর! আমরা জানি না আমাদের মধ্যে কাকে কখন চলে যেতে হবে! না মরলেও অন্তত কোরান্টাইনে! [কোরান্টাইন দীঘার কোন হোটেলের নাম নয়!]

সব্বাইকে ছুটি দেয়া হল! বলা হল ঘরে থাকুন- সব্বাই ভাবল এ এক অন্যরকমের ছুটি! দীঘা-ফিগায় দলে দলে মরতে চলে গেল! একদিন ‘জনতা কার্ফিউ’ হেঁকে দিলেন ঊজির-এ-আলম, ছোকরার দল ভাবল এ-ও তো মজা, ফাঁকা রাস্তায় ব্যাটম্বল চলল কিছুক্ষণ! লোককে আর বোঝানো যাচ্ছে না! বোঝানো কি চাট্টিখানি কথা দাদা? এখন ২০২০ সাল! আমরা তো বছর বিশেক পরপর মন্বন্তর দেখে বড় হইনি! আমরা তো এটা বুঝতেই পারছি না যে বার্ড-ফ্লুতে যেমন শয়ে শয়ে হাঁস-মুরগী মরে, তেমনি আগের দিনের পেটের ব্যামোতেও গ্রাম-কে-গ্রাম মানুষ উজার হয়ে যেত! সভ্যতার দারুন উন্নতির সাথে সাথে আমাদের এই একটা বিশেষ অবনতি হয়েছে যে- আমরা নানান প্রয়োজনীয় দৃষ্টান্তের অভাব বোধ করছি আজকের দিনে, আমরা শিক্ষাহীন হয়ে গেছি! এসব এপিডেমিক কি প্যান্ডেমিক, অতিমারী কি মহামারী- এসব নিয়ে আমাদের কোন ভ্যাবাচ্যাকা খাবার আর জোগাড় নেই! বিদেশ থেকে প্যান্ডেমিক বইয়ে এনে দিব্যি নিজের পাড়া-মহল্লা, ময়রার দোকান, বাসে-ট্রেনে সব চষে বেড়াতে ক্ষতি কি? তারপর রোগশয্যায়! পাশে কেউ নেই! যাদের থাকার কথা তারা আর কোন রোগশয্যায় দিন কাটাচ্ছেন! সুশুষ্রাকারীটিও অনিরাপদ! এস্থেটোস্কপভূষিত কবিরাজের দল বিপদাপন্ন! কারো সুরক্ষার নিশ্চয়তা আমাদের হাতে রইল না! আমরা এমন একটা মড়কের মুখে দাঁড়িয়ে আছি! এখন আমরা চাইছি একটা যুদ্ধকালীন কার্ফিউ অন্তত!

লোক মরছে- এতেই কত লোকের আনন্দ ধরে না আর! ভুয়ো খবর দিনে দু’চার বার রটাতে না পারলে কারো কারো রাতের ঘুমে ব্যাঘাত হয়ে যাচ্ছে! মানুষও মাইরি! ভূয়ো খবরে আজকাল আমাদের যত দ্রুত বিশ্বাস জন্মে, সত্যিটা চোখের সামনে তুলে ধরলেও অত সহজে তা সত্যি বলে মানতে মন চায় না! এব্বাবা, ফেসবুকে দিয়েছে, মিথ্যে হবার জো নেই! ফেসবুক একাউন্ট তো সব যুধিষ্ঠিরেরা খুলে বসে আছেন- তাই কেউ মিথ্যে কইবে না! যে যা পারছে লিখে দিচ্ছে, গুজবের সীমাসীমান্ত নেই- গুজবের নিচে- ‘হু’ লেখা আবার! বলিহারি- বিশ্বাস না করলে বিশ্বাসঘাতকতার দন্ড পাব না! কি কি যে আরো বিশ্বাস করতে হতে পারে জানি না! গোমূত্রপান থেকে হুজুরের ফু, থানকুনি পাতার রস, রসুনের কোঁয়া জাতীয় নানান অব্যর্থ সঞ্জীবনী দাওয়াইয়ের প্রতিবিধান আসছে! ঘোড়ার ডিম হচ্ছে এসব খেয়ে! হুজুরেরা গলা ফাটিয়ে বলছেন- কেয়ামতের আলামত, এঁরা বলছেন- ভগবানের লীলা, প্রকৃতিবাদীরা বলছেন – প্রকৃতির প্রতিশোধ, কতশত ব্যাখ্যা, আমাদের মন তো গলছে না। ব্যখ্যা যেমন হোক, হাইপোথিসিস যেমন পাকা-ই হোক, বাঁচাটা তো জরুরী! আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, আমাদের মধ্যে কে কে বাঁচবে এসব কথা মনে রাখার জন্য!

আমরা একটা মড়কের সামনে জড়ো হয়েছি! এটা কোন ইয়ার্কির কথা নয়! আমাদের লাশের স্তুপ দেখার অভিজ্ঞতা নেই! আমরা কোন বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি! আমরা কোন জম্বি-সিনেমার জীবন্ত চিত্রায়ণ দেখিনি! আমরা এলিয়েন আর মানুষের সঙ্ঘাত নিয়ে অনেক কল্পকাহিনী ভেবে থাকতে পারি- আমাদের ভাবনার বহর যা-ই ছিল না কেন, আমাদের সামনে নিশ্চিতভাবে তেমন ভয়াবহ কিছু একটা এসে গেছে, এখন যখন আমাদের কাজ করার সময়, তখন আমরা কতটা অকর্মণ্য হচ্ছি, বা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কতটা অসহায় হচ্ছি তা একটু ভেবে দেখলেই আমাদের মঙ্গল! এই দেশটার কোটি কোটি লোক কোন মড়কে বেঘোরে মরে যেতে পারে, রোগে না হলেও একটা মারত্মকভাবে কোমরভাঙা অর্থনীতির ব্যারাম আমাদের মারতে উদ্যত এখন- আমাদের বোধোদয় নেই! যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বালাই নেই তাদের প্রসঙ্গ না-ই বা তুললাম, যাদেরকে আমরা তথাকথিতভাবে শিক্ষিত বলে মেনে নিই, তাদের আচরণেও বিরাট ফারাক কিছু আমরা সর্বক্ষেত্রে দেখি না! দেখাটা প্রয়োজন! খুব প্রয়োজন ছিল! আর ক’দিন এভাবে চললে আমরা খাব কি? আর কিছুদিন এমন করে শেয়ার বাজারে ধ্বস নামলে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো? ২০ টাকার মাস্ক ২০০ টাকা দামে বেচেছে গায়ে লাগেনি দাদা, ২০ টাকার চাল ২০০ টাকায় উঠে গেলে সইতে পারেবেন?

শুধু আমাদের একটা পাড়া, গ্রাম, শহরের কথা বলছি না; অবস্থাটা গোটা মানব সভ্যতার সামনে এসে গেছে! রোগ নির্ণয়ের সরঞ্জাম নেই, পথ্য নেই, নিরাময় নেই, হাসপাতালে ঠাঁই নেই, রোগী ভর্তি হলে ভাবতে হচ্ছে কোনটাকে মারব আর কোনটাকে বাঁচাব, জীবন সবার জন্য যেন অপরিহার্য্য নয়, খাবারের দোকানপাট শুণ্য, রেশন সমাপ্তির দিকে, নগরের পর নগর স্তব্ধ করে দেয়া হচ্ছে, মানুষ ঘরবন্দী, বাতাসে যমদূতের চলাফেরা- কখন চুলের মুঠি ধরে ওপরে টান দেবে কেউ জানে না, আমরা খুবই অনিরাপদ! আমাদের সামনে আপাতত কোন আলো নেই! আমরা এই মূহুর্তে যা করতে পারি তা হল- আপন ঘরটিকে দূর্গ বানিয়ে তাতে বসে থাকা! কেমন কাপুরুষোচিত কথা শোনালেও আমাদের এই মড়কের যুদ্ধের বিজয়ের কৌশল সম্ভবত এই একটাই!



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

গ্রাস

  বুঝি আর আমাকে দিয়ে হবে না কিছুই। অসময়ে, অনাহুত, অতি অনভিপ্রেত জানি, সমস্ত বিবাদী উষ্মার অন্তরালে হারিয়ে যাব আমার এ যাবৎ যতনে গড়া সুরের ...