মাঝে
মাঝে কিছু একটা লিখিব ভাবিয়া বসিয়া পড়ি, তারপর আকুল হইয়া মস্তিষ্কের তন্ত্রগুলিতে ঘা
মারিয়া বেড়াই! কোন ধ্বনি নাই, কোন শব্দ নাই, কোন চিত্র নাই; যাহার স্বরূপ বিশ্লেষণ
করিয়া আপনার সাহিত্যিক-চিত্তটিকে তৃপ্ত করিব অথবা প্রশংসকের দু’টি স্তোকবাক্য কিম্বা
সহৃদয় সাধুবাদ মাথায় তুলিয়া নিজেকে ধন্য করিব! বহুকাল ধরিয়া এমন হইতেছে! নক্ষত্রও শুনিয়াছি
একদা নিষ্প্রভ হইয়া পড়ে! আমি আপনারে নক্ষত্র বলিবার অসৎ-সাহস করিতে পারি না, তবে নিজের
ভেতর একটি দীন-প্রদীপ মিটিমিটি করিয়া জ্বলে নাই এই কথা বলিলে তাহা বিনয়ের ছলে অত্যন্ত
মিথ্যা ঘোষণা হইবে! অদ্য দেখিতেছি সেই প্রদীপের শিখাও যেন ক্ষীণ হইয়া যায়! অযুত-নিযুত
বৈদ্যুতিক আলো, বর্তনী টিপিলেই যাহারা অনায়াসে আলোকবিকীর্ণ করে, তাহাদের সমুখে মাটির
প্রদীপ ম্রিয়মান হইবে ইহাতে আশ্চর্য্যেরই বা কি আছে! মাটির ঘরের দহলিজে প্রদোষকালে
গৃহলক্ষ্মী মাটির প্রদীপটি যখন আনিয়া রাখেন তখন তাহার দুর্বল আলোক-শিখাটিরও একটি মাধুর্য্য
প্রকটিত হয় এ সংসারে- এইরূপ ভাবনা বর্তমানে সকলে ভাবিতে পারেন না! বিশেষত যাহাদের সে
দৃশ্য বহিঃজগতে কি অন্তর্জগতে কোথাও দেখিবার অবকাশ হয় নাই- তাহাদের কাছে প্রদীপের মাহাত্ম্য
কি বলিব? কিই বা বলিব কেমন সে মানসপটচিত্রটির রূপ?
অধুনাকালে
হাজার ওয়াট বৈদ্যুতিক বাতির নীচে দেবী আনীত হ’ন! মুখপানে পুরোহিত পঞ্চপ্রদীপ তুলিয়া
ধরেন, ঘণ্টা বাজিয়া ওঠে টিনিটিনিটিনি- সে এক আচার হইয়া টিকিয়া গেল কেবল! পঞ্চপ্রদীপের
আভায় সে প্রতিমা কেমন আপনারে ব্যক্ত করিবে, সে অভিব্যক্তিতে কতটা দিব্যমায়া অবলোকিত
হয়- এইসকল ভাবনা ভাবিবার মত সেকেলে লোক আজ আর কোথায় মিলিবে যত্রতত্র! আঁখি মুদিয়া তেমন
কল্পনা করিবার শক্তিটিও আমরা হারাইয়া ফেলিয়াছি! আমাদের আড়ম্বরের আধিক্যে এহেন কয়েকটি
সেকেলে সামগ্রী শুধু আপনার নামটি বাঁচাইতে পড়িয়া থাকে! আমাদের সমস্ত কিছুই অদ্ভুত ভাবেই
কৃত্রিম ও যান্ত্রিক হইয়া উঠিয়াছে! আমাদের সমস্ত সাহিত্য-শিল্প, সমস্ত কথা কেবল মাত্র
নিজেকে কেন্দ্র করিয়া নহে, নিজেকে একটি কেন্দ্রান্তর্গত করিয়া তাহার মধ্যে আপনারে আপনার
মত করিয়া নানা সঙে সাজাইয়া অপরের সমুখে উপস্থাপিত করিবার আত্যন্তিক প্রয়াস-সাধনের নামান্তর!
নিজেকে একটি বৃত্তে বাঁধিয়া সেই বৃত্তকে মহিমান্বিত করিবার অক্লান্ত প্রচেষ্টা করিতেছি
কতভাবে! আমি হয়ত বহুকাল এইরূপে ছিলাম! সমস্ত নিরলস, আপাত-অক্লান্ত শ্রমশক্তিও একদিন
ক্ষয়প্রাপ্ত হইবে! তাই কখনো নিজেকে এই ‘হারাইয়া ফেলিলাম’ ধারণাটির ভেতর বাঁধিতে আমার
দ্বিধাও হয় না! মাটির প্রদীপ হইয়া মরিব ভাবিয়াছি! আমার যেন হাজার-ওয়াটের বাতি হইতে
না হয়! যদি এই বিশ্বের কোন বিধাত্রী আছেন- তবে তিনি আমায় তাঁহার আরতির একটি দীপশিখা
হইবার আশিস দিন! মিছে লিখিয়া, মিছে বকিয়া, মিছে গাহিয়া ‘আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া
ঘুরে মরি পলে পলে’!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন