বুধবার, ২২ জুন, ২০২২

স্রোত

 

সদা স্রোতের বিপরীতে বলিতে হইবে এইরূপ তত্ত্বকে আধুনিকতা মনে করি নাই। সর্বদা স্রোতে ভাসিতে হইবে এইরূপ ভাবনাকেও আমি গর্বের বিষয় ভাবিয়া প্রশ্রয় দিই নাই। পুরাতন পুঁথি নির্বিচারে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া কপট প্রগতি দেখাইবার গতি আমার হইল না। পুঁথি আঁকড়াইয়া আমার ন্যায় দীন মানবের জীবনকে অলীকতায় বিপন্ন করিতেও আমার প্রবল দ্বিধা! আমি কেবল স্রোতে হাত পা ছুঁড়িতেছি। আকুল পরাণে নাসারন্ধ্র উর্দ্ধে রাখিয়া চাহিতেছে প্রাণবায়ু!  


সাঁতরাইয়া পাড়ে উঠিতে হইবে এইটুকু আমি জানি। ইহাই চরম সত্য। সত্যভাষণ কাহার পক্ষে গিয়াছে বা কাহার বিরুদ্ধে ইহা লইয়া চিন্তিয়া মরিবার সময় কোথা আমার? সত্যকে কহিতে আপোষ করি নাই। যেটুকু বলিতে হয় সেটুকু বলিয়াছি নিত্য। যেটুকু না লিখিলে আপনারে দায়হীন মনে করি সেটুকু বিনা দ্বিধায় লিখিয়াছি। যেটুকু না ভাবিলে নিজেরে প্রস্তরখণ্ডবৎ বোধ করি সেটুকু নিরন্তর ভাবিয়া চলি। আমার লক্ষ্য পারে যাইবার। এপাড়ে দাঁড়াইয়া ওপাড়ের মহিমা ক্ষ্যাপনে আমার অনুরাগ নাই। আমি বিপুল খরস্রোতে নিজ ক্ষীণতেজ দেহখানি লইয়া সংগ্রামে নামিলাম। দোসর জুটিল কি জুটিল না ইহা ভাবিতে চাহি নাই। কেবা আমার স্তব করিতেছে আর কেবা মুণ্ডুপাত- এ নিয়া পড়িয়া থাকিলে আমার চলে না! 


একদা অন্ধকারে সিদ্ধার্থের মহানিষ্ক্রমণের পথ চলিতে শুরু করিয়াছিলাম। আমি জানিলাম- বুদ্ধ সাজিয়া ওঠা সহজ, হইয়া ওঠা আমায় সাজে না! অনেকে সাজিতে জানে, আমার সে গুণ নাই! আমি দিকে দিকে কুম্ভীরাশ্রু দেখিয়াছি। আমি ধূর্ত শৃগালগণে দেখিয়াছি সিংহচর্মাবৃত বেশে রাজত্ব করিতে। আমি ভাবিলাম কপিধ্বজ-রথ-সারথীর আবাহণে এইবার মসীকে অসী কিবা গাণ্ডীব করিয়া মরিব, দেখিলাম এই কৌরবনিগড় সমাজে এইরূপ কর্মে বিফল মৃত্যুই সার! নিজেরে প্রচণ্ড একা হেরিলাম! আমি একা চণ্ড-মুণ্ড-শুম্ভ-নিশুম্ভদ্বিগের সহিত লড়িয়া পারিব না! সংসার রৌরবতুল্য জ্ঞানে আপনা আপনি জ্বলিয়া মরি। কতক জ্বালা উগরাইয়া দিবার তুচ্ছ বাসনারে অবদমিত করিয়া আত্মপ্রবঞ্চনায় ক্ষয় হইতেছি। চিন্তা চিতাগ্নির ন্যায় রাত্রিগভীরে আমারে দক্ষভবনে অনাহূত কালভৈরবের প্রায় হানা দেয়। আমি ভাবিয়া কূলহারা, আমি স্রোতের টানে কোথা যে চলিতেছি জানিতে না পারি। পাড় যেন দেখিয়া দেখিয়া হারাই, চোখে জলের তোড়, ঝাপটা আসিয়া ঝাঁপসা করিতেছে সম্মুখের দৃষ্টি আমার! 


যাহারা ভাবিতে জানে তাহারা দুখী! যাহারা কহিতে জানে তাহারা সহিতে পারে কম! যাহারা সহিতে শিখিয়াছে তাহারা ক্রমশ হইয়াছে মূক! যাহারা অন্তরলোকে প্রখর আলোকে স্নাত তাহাদের বহিঃদৃষ্টি অন্ধ! যাহারা হৃদয়ে পাতিয়াছে কান তাহারা বধির হইতে চাহে! আমি নিজেরে কোথায় বাঁধিয়া বাঁচি জানি নাই! আমি ভাবিয়াছি আমাকে কহিতে হইবে- এদিকে কথা ক্রমে কোলাহলে আসিলে আমার সহিতে ব্যথা লাগে বড়! অন্তরে আলোর তরঙ্গ খুঁজিতে গিয়া বাহিরের অন্ধকারকে অস্বীকার করিতে আমি পারি না! হৃদয়ে মধুরবাণীর অভিলাষে নিমগ্ন যতই আমি রহি- বাহিরের ক্রুর গর্জন আমার খিড়কি ভাঙিয়া ফেলে যেন! আমি ভাবি- আমি প্রাণপণে ধ্যানস্ত হইব। কে যেন বুকের ভেতর শাবল দিয়া খুঁড়িয়া চলে প্রাণ। কে যেন কাঁদিয়া কহে- ওরে ওরে, চোখ খোল, এখনই থামাবি কি রে গান! যে গান মূমুর্ষের শান্তি, সে নহে, যে গান মরণোন্মুখে দেয় বীরদর্পে মরার ঝংকার- সেই গান হউক! সুখে বাঁচিবার গানও যে রসিকতা লাগে! 


আমি মুক্তি জানি না, আমি মোক্ষ চিনি না, আমার অভিপ্রায় নাই স্বর্গ কিবা সালোক্যের, আমি এই মরতভূমে একটি একক জীবন লইয়া বাঁচিতে কুণ্ঠিত নহি, আমি শুধু চাহিয়াছি জীবনটিকে অর্থবহ করিতে, বোঝাবহ না করিতে! দিকে দিকে ভ্রমিত হইয়াছি! দিকে দিকে সুন্দরকে দেখিয়াছি কেবল সাজসজ্জার সামগ্রী হইতে! সুন্দর সাজাইয়া রাখিবার হয়, সুন্দর হইয়া উঠিবার যেন কিছু নহে! ক্লান্ত হইয়াছি। আশা-নিরাশা-দূরাশা সকলে সরাইলাম দূরে। আমি কেবল বর্তমানে জীবিত রহি। যে মুহূর্ত চলিয়া গেল, যে মূহুর্তটি আসিবে তাহা লইয়া আমার ভাবনা মরিয়াছে ক্রমে! আমি বুঝি যে মূহুর্তে এই ‘আমি’ আছি- সেই মূহুর্তটি জীবন্ত হউক! ইহার অধিক কোন দর্শনের মাহাত্ম্য আমার কাছে নাই! ইহা জড়বাদ নহে, ইহা বাস্তবাদব! ইহা অধ্যাত্মবিরোধীও নহে- ইহা বরং অধ্যাত্মকে জীবনে আনিবার পথ!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

গ্রাস

  বুঝি আর আমাকে দিয়ে হবে না কিছুই। অসময়ে, অনাহুত, অতি অনভিপ্রেত জানি, সমস্ত বিবাদী উষ্মার অন্তরালে হারিয়ে যাব আমার এ যাবৎ যতনে গড়া সুরের ...