(১)
১৯৮২ সনের কথা! টাকলা চ্যাটার্জি বয়সকালে কখনো ধর্মকর্ম করে নাই! তার
ঈশ্বর-আল্লা কিছুতেই বিশ্বাস করত না! চীনপন্থী বাম ছিল! ভারতে বসে চীনের জন্য
গলাবাজি করত আর ভাবত ভারত একদিন তেরো টুকরো হবে! তারপর একচেটিয়া সমাজতন্ত্র! চীনের
দাসত্ত্ব কি জৈবিক চাহিদা মেটে? গ্যালন গ্যালন মদ খেয়েও টাকলার অন্তরে শান্তি নাই!
কোথাও সমাজতন্ত্র নাই! জীবনে আর কিচ্ছু নাই! বাপ-মা চেয়েছিল বিয়ে দিতে! কোন
পতীনিষ্ঠ হিন্দু মেয়ে টাকলার মত সমাজতন্ত্রী-মদ্যপ বিয়ে করবে? আর সমাজতান্ত্রিক
মেয়েগুলোও যা সিগারেট ফোঁকা কাঠখোট্টা টাইপের এদের বিয়ে করে কি সুখ? অন্য কিছু পর্যন্ত
ঠিক আছে! কিন্তু যৌবনের জ্বালা তো মরে নারে মাও সে-তুং! ইয়ের অবস্থা যখন তুঙ্গে
তখন মাও মাও করে কি সুখ পাওয়া যায়?
টাকলা ভাবে আর ঝাড়ে! ভাবে আর ঝাড়ে! ভারতবর্ষের ধর্ম আর সংস্কৃতিতে যে সব সংযম,
পবিত্রতা ইত্যাদির কথা আছে ওসব বুর্জোয়াবাদী বামুনদের গড়া! ওসব ঝেড়ে ফেলতে হবে! ঝেড়ে
সব লাল করে দিতে হবে! দিকে দিকে লাল পতাকা পতপত করবে! ইন্ডিয়ানদের আবার কালচার কি?
সব নষ্ট! একমাত্র চীনা নীতিতেই রক্ষা হবে! আহ! এসব দিনভর চিন্তা করেও কি ক্ষুধা
মেটে টাকলা! টাকলা ভাবে আর ঝাড়ে! ভাবে আর ঝাড়ে!
অবশেষে একদিন টাকলার জীবনেও প্রেম এসেছিল! চরম-গরম প্রেম! এক পর্দাশীলা
বোরখাওয়ালীর মুখ দেখতে পেয়েছিল একবার! তাতেই কুপোকাৎ! নিজেকে আর আটকাতে পারে না
টাকলা! বুকের ভেতরটা কেঁচরমেচর করে! পোস্টার লেখা, ব্যানার লেখাতে আর মাথা নেই!
দিনরাত বোরখাওয়ালীর মুখ দেখতে পায়! একদিন বোরখাওয়ালীকে বলেই ফেলে প্রাণের কথা!
বোরখাওয়ালী শুধায়- 'আমি মুসলমান, তুমি হিন্দু! ক্যামনে কি?' টাকলা বলে, 'ওসব কোন
সমস্যা নেই! আমি হিন্দুও না! I hate religions! আমার ওসবে কোন
বিশ্বাস নেই!' বোরখাওয়ালী বলে- 'কিন্তু আমাদের ধর্মে আছে কেউ কোন মুসলমান বিয়ে
করতে চাইলে তাকেও মুসলমান হতে হবে!'
এই তো ফ্যাঁকড়া লেগে গেল! কি হবে এখন? টাকলা ভাবে আর মদ গেলে! ভাবে আর গেলে! কখনো
গাঁজা কখনো বিড়ি টেনে দাঁড়ি গোঁফ বাড়ায়! কিন্তু কোন সমাধান নেই! মাও-ফাও, চে-ফে
চিন্তা করে তো এই মনোবিকার থামানো যাচ্ছে না! তাছাড়া তাদের মন্ত্র তো এসব
প্রেম-টেম নিয়ে কোন কিছু নেই! কি হবে এখন! ধুসসালা! যা হয় হোক! ওই মেয়েকেই চাই!
নকশালী মাল-টাল কিছু আনব নাকি! সমাজতন্ত্রের নাম করে বুর্জোয়ার মেয়ের এবডাকশন-
মন্দ নয়! কিন্তু এসব অলীক চিন্তা! কি করা যায়! দিন কাটে, রাত কাটে দাঁড়ি-গোঁফ
বাড়ে- টাকলার শান্তি নাই! ওই মেয়েকেই চাই!
(২)
ভাল একটা দিন দেখে রুখসানার বিয়ে হয়ে গেল টাকলার সাথে। রুখসানার বাপের মুদীর
দোকান! টাকলা যাদবপুর ভার্সিটির ছাত্র! তারওপর নিজে যেচে মেয়ে বিয়ে করতে চায়-
মুসলমান হতেও আপত্তি নেই- এমন সুপাত্র পাওয়া যাবে আর? এটা সোয়াবেরও কাজ- একটা
হিন্দু, তাও আবার বামুন- তাকে মুসলমান বানানো গেল! আলহামদুলিল্লাহ! টাকলা ভেবেছিল এমনিতেই
তো তার ধর্ম-ফর্মতে কোন শ্রদ্ধা নেই- ভালবাসার মান রাখতে এটুকু ধর্মান্তরিত হবার
হিপোক্রেসি করাই যায়! এতে সমাজতন্ত্র ব্যহত হয় না! কিন্তু যত দিন যায় তত সমস্যা
বাড়ছে! বাপ-মা তো এমনিতেই খেদিয়ে দিয়েছে! এদিকে আল্লা-টাল্লা না মানলে শ্বশুড়বাড়িও
মন্দ বলে! এখন ঈদে-টিদে ওখানে যেতে হয়! শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীকে কদম্বুচি করে, বাপ-মাকে
অবশ্য করত না, এঁদের না করলে রুখসানা মাইন্ড করে! রুখসানা মাইন্ড করলে রাতের
কাজকর্ম সুবিধার হয় না! গোশত খায়- মাজারে যায়, দোয়া-দরুদও কিছু শিখে ফেলেছে
রুখসানার রূপের ক্যালমায়! সমাজতন্ত্র ল্যাট্রিনের ট্যাংকে বাস করছে আজকাল! 'ধর্ম
আফিম' বলা না-জায়েজ! কিন্তু হিঁদুদের ধর্মকে সব বলা যাবে! সেটা জায়েজ!
পার্টি অফিস-টপিস অবশ্য যাতায়াত আছে টাকলার আজও। আজও সমাজতান্ত্রিক চুলকানিটা
আছে! আজও আছে ধর্ম নিয়ে ব্যাপক এলার্জি! তবে নবীর ধর্ম নিয়ে নয়! সেটা তার বৌয়ের
ধর্ম যে! এটা মানাতে কষ্ট হয়েছিল কিন্তু এখন টাকলার চামড়ার নিচে সেঁটে গেছে!
হিন্দুদের যাবতীয় রীতিনীতি প্রথা পূজা আচ্চা সব কুসংস্ককার, কিন্তু ইসলামের কোন
কুসংস্কার নেই! থাকলেও বলার দরকার নেই! অথবা বলার জন্য যে জোর দরকার হয় ঝাড়তে
ঝাড়তে টাকলার বিচি শুকিয়ে সে জোর আর ওপরে উঠে আসতে পারে না! সেসব থেকে ট্র্যাক
একটু অন্যদিকে ঘুরিয়ে বরং টাকলা এখন ভাষণ দেয় 'অবহেলিত মুসলমান' জনগোষ্টীর জন্য-
যারা নাকি ক্রমাগত হিন্দুদের হাতে নিষ্পেশিত হয়েছে! যেখানে মুসলমানরা সংখ্যায় বেশী
সেসব জায়গাতে গিয়ে টাকলা এসব বলে আর পপুলার হয়ে ওঠে দিনদিন! আগে শুধু মাত্র
বামনেতা হবার সুযোগ ছিল আর এখন টাকলা হয়ে গেছে বামৈস্লামিক নেতা! যেখানে সর্বদা
শান্তি ছিল সেখানেও একটু অশান্তির বাতাস ছড়িয়ে না দিলে এ দেশে কেউ কখনো নেতা হতে
পেরেছে? টাকলাও রাজনীতির এই খেলা ভালই খেলতে শিখে গেছে সময়ের ঘূর্ণনে!
(৩)
২০১৭ সাল। টাকলা বামৈস্লামিক হলেও টাকলার ছেলেমেয়েরা হয়েছেন
নবী করিম (সাঃ) এর প্রকৃত উম্মত! রুখসানা অনেক কষ্টে তাদের দোজখের আগুন থেকে
বাঁচিয়ে রেখেছে এতকাল! টাকলার বড় ছেলে এখন পশ্চিমবঙ্গে একটা ইসলামিক মুভমেন্ট এর
ভাল কর্মী! নেতা-টেতাও হয়ে যেতে পারে! টুপি-দাড়ি রাখে! ইসলামিক সমাবেশে বক্তৃতা
দেয়! কালিয়াচকে যে নবীজিকে নিয়ে বিদ্রুপ করার প্রতিবাদে ভাঙচুর-জ্বালাও-পোড়াওয়ের
ইসলামিক প্রতিবাদ হয়েছিল তার অন্যতম সংগঠক ছিল টাকলার বড় ছেলে! টাকলা বলে- এরকম হতেই
পারে! হিন্দুরা চিরকাল বড় অসহিষ্ণু! কি দরকার ছিল নবীকে নিয়ে বিদ্রুপ করে ফেসবুকে
যা-তা লেখার! লিখলে তো মুসলমানদের প্রতিবাদ করতেই হবে! এটা কি অন্যায্য?
কোন ছেলে কি লিখেছে তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে! তার একমাস পর
মুসল্লীরা জমায়েত হয়ে এত কান্ড করল! ছেলেটাকে যে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল তাতেও
মুসল্লীদের সন্তুষ্টি হল না! ভাঙচুর চালাতেই হবে! তাও একমাস ধরে বড়সড় প্ল্যানিং
করার পর! টাকলারা এতে কোনরকম ষড়যন্ত্র, আইন-অমান্যতা, রাইওট করার টেন্ডেন্সি দেখতে
পেল না! টাকলা বলে- এটা একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া শুধু! Terrorizing show-down জাতীয় কিছু নয়! বাংলার মুসলমানেরা বরাবরই
শান্তিপ্রিয় ছিল! তাদের ওপর মিথ্যা আরোপ দিয়ে একদল হিন্দু চিরদিন তাদের ডাউন করে
রাখার চেষ্টা চালিয়েছে। এসব তার বিপরীত প্রতিক্রিয়া শুধু!
(৪)
টাকলার হাঁপানির ব্যামো আর সারছে না! এত মদ-গাঁজার আধুনিকতা
ও প্রগতিশীলতা তাকেই তলেতলে গিলে ফেলেছে! টাকলার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেয়া নিয়ে
রুখসানা দিনরাত ঘ্যানঘ্যান করে চলেছেই! কিন্তু সুপাত্র কোথায়? মসজিদের দেয়ালের
পাশে মোটরবাইক নিয়ে চোখে সুরমা লাগানো কোন ছেলে একটা রোজ বসে থাকে! মেয়েটাকে বড্ড
জ্বালায়। রুখসানার চিন্তায় ঘুম নেই! ছেলেটা মাস্তান-টস্তান জাতীয়! দেখেই ডর লাগে!
আবার সরকার পার্টি করেও শুনেছে রুখসানা! কি যে হবে ভেবে রুখসানার প্রাণ আঁকুপাঁকু
করে!
এদিকে মেয়েটা করেছে কি একদিন কোন এক হিন্দু ছেলের সাথে মিলে
ঘর ছেলে পালাল! বাপ-মা, সমাজ-সংসার কিছুই মানল না! মুখ দেখানোর জো নেই! চিঠি রেখে
গেল- 'আব্বা যদি আম্মিকে ভালবেসে সব ছেড়ে দিয়ে আসতে পারে, তবে আমি কেন ভালবাসার
জন্য এতটুকু করতে পারব না?' বোকা মেয়ে! আরে তোর আব্বা তো ভালবাসার জন্য ওসব
ছাড়েনি! ওর তো কিছু ছিলই না ছাড়ার মত! ওতো শুধু চামড়াটা সুযোগ বুঝে বদলেছে! সে আর
তুই কি এক? তুই তো মানুষ! গিরগিটি তো না!
টাকলার বড় ছেলে তো রেগে খুন! ওই দুটোকে সামনে পেলে নিজের
হাতে জাহান্নামে পাঠাবে! ওর বোনকে রেহাই দিলেও ছেলেটাকে স্ট্রেইট জবাই করে ফেলবে!
দরকার হলে একটা মুসলমান মেয়ের সাথে এই করার ফলাফল হিন্দুদের দশটা মেয়েকে ইয়ে করে
বুঝিয়ে দেয়া হবে! রুখসানা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে! টাকলা কি বলবে ভেবে পায় না!
এজাতীয় সমস্যায় বামৈস্লামিক চেতনাতে কি সমাধান দেয়া যায় তার মাথায় আসছে না এখন!
হিন্দুদের তো পুলিশের কাছে যেতে হয়- আর মুসলিমদের জন্য আজকাল পুলিশ অকার্যকরী!
তারা নিজেরাই নিজেদের বিচার করতে সক্ষম! কথায় কথায় ধূলাগড় বানিয়ে দেয়া যায় যেকোন
যায়গাকে! অন্তত এই সরকার বাংলায় যতদিন আছে ততদিন যেকোন ইস্যুতে জেহাদ ডিক্লেয়ার
করাতে কোন বাধা নেই!
টাকলা ভাবে- কিন্তু আমার মেয়েটা? মেয়েটার কি হবে? ওকে এরা
ছেড়ে দেবে তো? হিন্দু বাম বামিস্লাম, ইসলাম কোনটাই পিতার হৃদয়ের চেয়ে যেন বড় হতে
চায় না! টাকলা ভাবে আর কপাল কুঁচকে যায় ব্যাথায়! সারাজীবন কি করে গেল ভাবে- যদি
কার্লমার্ক্স, মাও, লেলিনের চেয়ে শরৎ ও রবীন্দ্রনাথকে আরও আগে ধরা যেত তাহলে সেও
হয়ত একদিন মানুষ হয়ে যেত! হিপোক্রেটরাও মানুষ! তবে 'মানুষ'এর আগে 'অ' প্রযোজ্য হয়ে
যায়!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন