একটি তত্ত্ব, কি একটি মতবাদ, কি একটি শিল্পভাব যতই উচ্চ হোক, যতই নিগুঢ় হোক- যখন আমরা চাই এটি সর্বজনীন হোক, যখন আমরা চাই এটি সবার মধ্যে বিকশিত হোক- তখন আমরা যেন এটা মেনে নিতে উদার থাকি যে- সর্বসাধারণে সম্প্রসারণ মাত্রেই সংমিশ্রণের দ্বার অবারিত করা। আজ যে গানটি আমি গাইলাম- আমি যদি চাই এই গান গোটা পাড়া গাইবে- তবে আমার বোঝা উচিত গোটা পাড়া আমার কণ্ঠের অনুকরণ করে গাইবে না, কারো নিজস্বতা আসবে, কারো অক্ষমতার দরুন তাতে বিকৃতি ঘটবে, কেউ ইচ্ছে করেই হয়ত বিকৃত করবে- ইত্যাদি ইত্যাদি ব্যাপার তাতে অবধারিত। তবে কোনটি রূপান্তর আর কোনটি রূপের আত্যন্তিক বিপর্যয় এটা কে ঠিক করে দেবে এ নিয়েই দ্বন্দ্ব চলছে!
একদল আদিবাসীকে দেখেছিলাম খোল-করতাল নিয়ে যীশুর নামগান করতে। ধর্মান্তরিত হবার আগে তাঁদের পূর্বপুরুষ খোল-করতাল নিয়ে কৃষ্ণনাম গাইত। যীশুর ধর্ম এসে কৃষ্ণের নামটি তুলে নিলেও খোল-করতালটি তুলে নিতে পারেনি। যারা যীশুর নাম প্রচারে নেমেছিলেন- তাঁদের এটা মানতেই হবে যে যীশুর নামটার প্রচারই উদ্দেশ্য, খোল-করতাল দূরীকরণ নয়। যারা তত্ত্ব সম্প্রসারণের সাথে সাথে প্রাগ-ভাবটিও বিনষ্ট করতে চাইবেন, তাঁদের পথে শতেক বাধা। এখানে অবশ্য এ কথারও স্পষ্টীকরণ দরকার- প্রাগ-ভাবটি সর্বৈব অর্থে সঠিক ছিল কি? যে মসুর ডাল রান্না জানে, তাকে বিউলির ডাল রান্না করতে গেলে কি মসুর ডাল রান্না ভুলে যেতে হবে?
আবার একটা সাধারণ বিপরীত যুক্তি দিই। যেমন গান শেখাতে গিয়ে দেখেছি ছাত্র হারমোনিয়াম না টিপলে নিজের ‘সা’টিও গাইতে পারে না! আমি বলি ‘বাছা এ তো আমাদের দেশী যন্ত্র নয়, যখন হারমোনিয়াম ছিল না, তখন লোকে গান কি করে করত? তারা সরগম কি করত না?’ প্রশ্ন শুনে ছাত্র মাথা চুলকায়। তবে এতকাল কি করে এলাম? একটা যন্ত্র আমার কন্ঠ পরিচালনা করছে, অথচ উচিত ছিল আমিই যন্ত্রটিকে আমার আজ্ঞাধীন করব! তা-তো হল না। এই হল উদাহরণস্বরূপ আমার ছাত্রের প্রাগভাব। এখন তাকে শুদ্ধরূপে স্বরগ্রাম শিক্ষা দিতে গেলে আমাকে প্রথমেই এই ধারণা সৃষ্টি করে দিতে হচ্ছে যে – তোমার পূর্ব প্রক্রিয়াটি একটি প্রমাদ! তখন সকলের পক্ষে একটি নবারম্ভ দুষ্কর হয়ে ওঠে। এবং প্রত্যেকে এরকম আরম্ভের পক্ষেও নেই। অর্থাৎ যে মসুর ডালটিও ভুল-ভাল রাঁধে, তাকে বিউলির ডাল রাঁধতে দেয়ার আগে, মসুর ডালটি ঠিকঠাক শেখালে তো ভাল! মন্দ কি? কিন্তু ভুলটিতেই যখন আমরা এতটা অভ্যস্ত, এতটা আশ্বস্ত- তখন নতুন করে আরেকটি ‘শুদ্ধ’ হাজির করলে সেটাই বরং বিরক্তিকর লাগে!
অতএব আমরা চেয়েছি, সকলে সু-শিক্ষার্থী না হলেও সঙ্গীতের উচ্চরূপ সকলের কাছে পৌঁছাক। তারপর অধিকারীভেদে যে যেমন পারবে সে তেমন প্রচেষ্টায় কিছু শিখবে। অনেকে শিক্ষার মাধ্যমটিকে সহজতর করার জন্য নতুন নতুন রূপরেখা আবিষ্কার করতে কৃতসংকল্প হয়েছেন। কিন্তু সহজে লভ্য হলেই অনেক জিনিসের গুণমানে লঘুত্ব যে আসে- এ কথা প্রকাশ্যে ক’জনে স্বীকার করে? সর্বজনমধ্যে সম্প্রসারণের বড় সংকটটি এই যে- গুরুতত্ত্বও ক্রমে লঘুতত্ত্ব হয়ে আসে, এবং সেই লঘুত্ত্বের গুরুভাব দর্শানোর জন্য তারপর আর কয়েকটি নতুন তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটিয়ে একটি হজবরল বিষয় বানিয়ে নিতে হয়। সঙ্গীতকে কেবল একটি রূপক হিসেবেই ধরে দেখুন। সঙ্গীতের জায়গায় সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্ম এসবও বসান- দেখবেন সব এক তরীতেই উঠে গেছে ডুববে বলে।
কেউ বিরিয়ানি রান্নার চেষ্টা করে দেখল, তারপর ওটা খিচুড়িতুল্য কিছু হল- এবার একে একটা আলাদা নামকরণ করে লোকের পাতে ও জাতে তোলার দায় পাচকের, এবং স্বাধীনতা ও সর্বজনীনতার দোহাই দিয়ে এ কার্য্যও সম্ভবপর হচ্ছে। যারা শিল্প ও মতবাদের স্বাধীনতা ও সর্বজনীনতা কামনা করেন- তাদের সিংহভাগকে দেখেছি- নিজের অপারগতাটিকে বৈধতা দেবার প্রয়াস করে যাচ্ছেন। যখন আমার আদর্শটি উচ্চ, অথচ আমি তাতে পৌঁছুতে পারছি না, অতএব একে টেনে হেঁচড়ে নিচে নামিয়ে এই দাবী করা- একটি নতুন আদর্শ আমরা তৈরি করলাম। নবকলেবরের নব নাম দেয়া যেতেই পারে, তবে অজ্ঞ পাচক খিচুড়ি রেঁধে বিরিয়ানি বলে খাওয়াতে গেলে সে খাবার সবার মুখে হয়ত রোচবে না! কিন্তু তাও লোকে খাবে। লোকের খাদ্য আগে চাই, বিশ্লেষণে কিছু যায় আসে না। আপামর জনগণ গান শুনবে- গানের ব্যকরণ জানা তাদের কাজ নয়! কিন্তু তারাই ভাল-মন্দের নির্ণায়ক হয়ে যদি ওঠেন?
সুন্দর মাত্রেই সর্বজনীন, সুন্দরের চর্চার অধিকার সকলের আছে- এই কথাতে আমার কোন আপত্তিই নেই, কিন্তু অধিকার থাকলেই সকলে চর্চার ‘অধিকারী’ হন না। ‘অধিকারী’ হবারও একটি সাধন-প্রণালী আছে। অনধিকারীর হাতে উত্তম কিছু গেলেও অবশেষে ‘শিব গড়তে বানর গড়া’র মতন কিছু হয়ে যায়। এতে অনধিকারীকে আমি দোষ দিচ্ছি না, তার শিল্পচেতনাকেও দিচ্ছি না, তার সমর্থকদেরও দিচ্ছি না, আমরা সবাই উচ্চ তত্ত্বের রসজ্ঞ হব না, তাই এমনটাই বরাবর হয়। সাঁওতালী গানে যে মাদলের তালে নাচে, সে দ্রুত-খেয়ালের তবলার ঠেকাতেও নড়বে- তার কাছে শরীরে দুলুনি লাগাটাই মূখ্য। এ কথা অনস্বীকার্য্য যে -আমরা প্রায় সকলেই বিষয়ের মূল্য নির্ধারণ করি আমার ওপর তার প্রভাব বিচার করেই, আমাদের ভাল লাগাটাই যেন শিল্পের সার্থকতা- এরকম একটা কথাও আমরা প্রায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছি। অর্থাৎ ‘লোকে যারে বড় বলে সেই বড় হয়’! কিন্তু আজকের সমাজ এই কথার বিপরীত মেরুতে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে না? অথবা চিরকালই ‘লোক’ কি খুব সমঝদার ছিল?
একটা কিছু লোকের মধ্যে ছড়িয়ে দেব ভাবলেই সেই একটা কিছুর খুব উন্নতি হয় না- যদি একটা কিছু ছড়িয়ে দেবার জন্য একটা সুন্দর পরিকাঠামো না তৈরি হয় আগে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন