বাবু
বাংলাদেশ তো বখতিয়ার খিলজীর! এখানে চন্দ্রগুপ্ত-ফুপ্ত, অশোক-টশোকের কথা
কেন পাড়? ১৭ জন সেনা নিয়ে বখতিয়ার সেন-রাজার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল এই
ইতিহাসহীন গপ্পিই তো এখানে মহানায়ককে অতূল্য মর্যাদায় সূচিত করে! কারো মনে
প্রশ্ন জাগে না নালন্দা আর বিক্রমশীলায় ধ্বংসলীলা চালানো, হাজারো বৌদ্ধ
সন্ন্যাসীদের কোতল করে অগ্রসরমান এই পরমবীর- তার সব সৈন্য পেছনে রেখে শুধু
১৭ জন নিয়ে কেন বাংলা আসতে গেল? তার কি মাথায় ঘিলু ছিল না! অথচ এই
সস্তাদরের গল্পটা বছরের পর বছর গেলানো হয়েছে! আর অপরদিকে যেখানে তার সমস্ত
নৃশংসতার কীর্তি এখনো পুরাকীর্তির তালিকায় যত্ন পায় সেসব কখনো বাংলাদেশের
ইতিহাসের বইতে পড়ানো হয় না! বাংলাদেশে ঔরঙ্গজেবের মত একজন ক্রুর পিশাচকেও
মহাণ করে দেখানো হয়! তাকে নিয়ে নাট্যদলেরা নাটকও করে! আর সারা উত্তর ভারত
তার নারকীয়তার ক্ষত আজ পর্যন্ত টেনে বেড়ায়! এদের এত মহত্ব দিয়ে দেখার কারণ
কি? কারণ এরা ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছেন- তবে বুদ্ধের মত প্রেমের
বাণী শুনিয়ে মোটেই নয়! আর এই কারণেই এরা মহানায়ক! আল-মাহমুদের মত ভণ্ড তো
বখতিয়ার খিলজী নিয়ে কাব্যগ্রন্থও লিখে ফেলে! বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের
ইতিহাস লেখা হয় ধর্মকে আগে রেখে! এই সুন্দর গুণটা অবশ্য সেমিটিকদের মধ্যে
স্বভাবসিদ্ধ! খ্রীষ্টধর্মের বিস্তারের পর তারাও পেগানদের ধ্বংসের
নমুনাগুলোর কথা আর ইতিহাসে আনেনি! আনতেও হয়নি তারা ধর্মান্তকরণে ১০০% সফল!
ইউরোপে আর কোন বলার মত পেগান ধর্ম নেই! সব শেষ! কিন্তু ভারতে আক্রমণকারীরা
সম্পূর্ণভাবে এটা করতে পারেনি! এখানে মানুষ প্রাণ ও ধর্মের মূল্য এক করে
নিয়েছে বহুবার!
এখানেই লেগে গেছে গন্ডগোল! যার সর্বশেষ পরিণতি
ভারতের ত্রিখণ্ড রূপ! এবং এটা অবশ্যম্ভাবী ছিল! যদিও আজও পাকিস্তানের সাথে
ভারতের ইতিহাস ভাগাভাগির অনেক অনেক কারণ আছে। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে একদমই
নেই! বাংলাদেশের শিশুকিশোররা ভারতবর্ষের ইতিহাস শিখে বড় হয় না! যা
একটু-আধটু পড়ে- তাও এইসব খিলজিওয়ালা বালখিল্য গল্প! আমার বাংলাদেশের
শিশু-কিশোরদের ইতিহাস পাঠ্যপুস্তক পড়লে পিত্তি জ্বলে ওঠে! পশ্চিমবঙ্গের
বামেদের সময় এখানের শিশু-কিশোরেরাও খুব ভাল কিছু পায়নি! পাকিস্তান মোহাম্মদ
ঘুরীকে নিজের বাপ মানুক- কিন্তু তক্ষশীলাকে তো উড়িয়ে দিতে পারছে না! পারছে
না আর্য্য সভ্যতার নিদর্শনগুলো নিজেদের দেশ থেকে মুছে দিতে! কিন্তু
বাংলাদেশের তেমন কোন অতিপ্রাচীন নিদর্শন নেই যা দিয়ে ভারতবর্ষের কোন বিরাট
শাসকের ঘনিষ্ট ইতিহাস লেগে আছে! তাই এখানের মানুষের এসব নিয়ে মাথা ব্যথাও
নেই! যে কয়েকটা অতিপ্রাচীন পুরাকীর্তি বাংলাদেশে লেগে আছে তার ম্যাজরিটি
বৌদ্ধদের! কিন্তু সেসব নিয়েও কোন সুস্পষ্ট পাঠদান শিশুদের জন্য থাকে না!
কারণ এসবের সাথে ইসলামাইজেশনের কোন যোগাযোগ নেই! একদম অকাট্য সত্য কথা
বললাম! বিশ্লেষণ করে দেখবেন।
বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে এই জেনারেশনের
স্টার্টিং পয়েন্ট খুব পেছনে গেলে ভাষা আন্দোলন পর্যন্তই যায়! (এর আগে
বঙ্গের ইতিহাস জানার কি প্রয়োজন?) তারপর একাত্তর! পঁচাত্তরে একাত্তরের
মহানায়ককে বেহেশতে পাঠিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে একাত্তরের ইতিহাস পর্যন্ত উল্টে
ফেলতে থাকে একটা খিলজি-ইউনিট! আর এরাই লিখেছে বাংলাদেশের অনুশাসন! এরাই
লিখেছে ইতিহাসের বই! এরাই করেছে গণতন্ত্র আর রাষ্ট্রধর্মের খাবার অযোগ্য
মিশ্রণ! এরাই এদেশের মস্তিষ্ক থেকে ভুলিয়ে দিয়েছে তার শেকড়ের কথা! এরা নতুন
বাংলাদেশ হয়েছে! এবং এই বাংলাদেশ হঠাত আসমান থেকে নিচে পড়ে সৃষ্টি!
আমার মনে আছে- চট্টগ্রামে একবার মতিউর রহমান নিজামী ভাষণ দিচ্ছিল-
বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি করেছিল সূর্য্যসেন! জনতা হর্ষিত! পুলকিত! আমি
নবম শ্রেণীর বইতে পড়েছিলাম- ক্ষুদিরাম সন্ত্রাসী! এখানে শুধু ঠারেঠোরে
একথা বোঝানো হত- ভারতের ইতিহাসে অতীতের সব হিন্দু রাজারা ছিল অত্যাচারী আর
মুসলিম শাসকেরা এখানকার মানুষদের দিয়েছিল মুক্তি! দারুণ! বছরের পর বছর এই
পড়ে পড়ে যে প্রজন্মটা শিক্ষিত হয় তার কাছে কি সুসংস্কার আশা করা যায়? হাজার
হাজার ধ্বংসস্তুপ, লুটপাট আর লক্ষ লক্ষ ধর্মান্তরিতকরণের ইতিহাস কে বলবে
বাবু?
বাবু, পুরনো কাসুন্দী কেন ঘাঁটছি? গোড়ায় যে পচন ধরেছিল সেটা
দেখাচ্ছি! এখন এসে মৌলবাদের আগা ধরে নাড়া মারলে কি হবে? গোড়া থেকেই তো কোন
ভাল কিছু আমরা শিখিনি। কোন সত্যকে নিরপেক্ষ ভাবে আমাদের জানতে দেয়া হয়নি!
ভারতবর্ষের ইতিহাসটা ভারতের একার নয়! বাংলাদেশ পাকিস্তানেরও। কিন্তু তারা
কি শিখিয়েছে তাদের সন্তানদের? ধর্মান্ধ মানসিকতার ইতিহাস? আর কি?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন