বৃহস্পতিবার, ২০ মে, ২০২১

পিছিয়ে থাকা বিজ্ঞানের কথা

 

এই যে ল্যাপটপ থেকে আমি লিখছি, আর যে ডিভাইস থেকে থেকে আপনি দেখছেন ফেসবুকে, হতে পারে সেটা ডেস্কটপ পিসি, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট বা একটা ফোন; এর কোনটা আপনার পূর্বপুরুষের উদ্ভাবন? গরমের দিনে লকডাউন, ঘরে বসে আছেন, আঁধার হলে পিদিম জ্বালাতে হচ্ছে না, বৈদ্যুতিক বাতির ফকফকা আলো জ্বলছে, স্বেদক্লান্তি মেটাতে ফ্যান নয়ত এসি চলছে- এর কোনটা আপনার পূর্বপুরুষদের অবদান? ঘরে বসে বাইরে কি হচ্ছে দেখতে পাচ্ছেন- টিভিতে খবর খুললেই চলছে, ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুক্ষেত্র বোঝানোর জন্য কোন সঞ্জয়ের দিব্যচক্ষু লাগছে না, ঘরে বসে নিমিষেই জেনে যাচ্ছেন মিডল-ইস্টে কি কুরুক্ষেত্র চলছে, তাই না? চোখ না বুজেই যে এই মূহুর্তে হাজার মাইল দূরে কি মহাকাণ্ড হচ্ছে তা জানতে পারছেন- এই বিদ্যা কে আনল? দৈনন্দিন জীবনে নিত্য প্রয়োজনীয় হাজার সামগ্রী লাগছে- সব কিছুর mass-production হচ্ছে- বিরাট বিরাট টেকনোলজি, সিংহভাগ কাজ যন্ত্রচালিত- ক’টা যন্ত্র আপনার ঠাকুরদার আমলে আপনার ঠাকুরদার দল বানিয়েছেন? বাসে চড়েন, অটোতে চড়েন, ট্রেনে চাপেন, প্লেনে ওড়েন, আগে বাড়ি থেকে কালীঘাট যেতে সকালে বেরুলে বিকেলে পৌঁছুতেন, এখন মেট্রো চড়লে আধঘন্টা লাগে- মশাই কত সুবিধে- কে করে দিল এসব? কাছের মানুষটিকে চিঠি লিখে একমাস-দুমাস উত্তরের জন্য হা করে বসে থাকতে হত, এখন ভিডিও কল ছাড়া মূহুর্ত কাটে না! তাই না? আগে প্রতিরক্ষায় বল্লম ছুঁড়তেন, এখন রিমোট টিপে মহাশূণ্যে মিসাইল ছোঁড়া হচ্ছে! কার বন্দোবস্ত এসব? কাঠ কুড়িয়ে মাটির চুলোয় রান্না করতেন, এখন গ্যাস আছে, ইনডাকশন আছে! একবার ভেবে দেখুন ২৪ ঘন্টায় চোখের সামনে বা পেছনে যার মধ্যে আপনি নিত্য বসবাস করনে সেই ভুবনের ক’খানা জিনিস আপনার গড়া, আপনার বাবার জেনারেশনে গড়া, আপনার দাদার জেনারেশনে গড়া? কোনটিতে হাত রেখে আপনি বলতে পারেন- this is purely indigenous? আমরাই এর জনক? ক’টা তেমন জিনিস আছে? নিত্যদিন প্রযুক্তির খাঁচায় বসবাস করে যারা anti-materialistic ভাববাদে মজে থাকেন তাঁদের হুঁশ নেই! বস্তুবাদ-পরিপূর্ণ জড়বাদী পাশ্চাত্য ভাবের চরম বিরোধী লোকেদের ধারণা নেই- জড়বাদের অবদান বাদ দিয়ে তাদের একটা দিনও কাটছে না!  ঈশ্বরতত্ত্ব, ভাববাদী দর্শন, পূজা-পাঠ আরাধনায় তুষ্ট হয়ে ঈশ্বর আপনার হাতে একটা এন্ড্রয়েড ফোন আশির্বাদস্বরূপ নিশ্চয় দিয়ে যাননি কোনদিন- যা দিয়ে আপনি এখন দু কথা আমার বিরুদ্ধে লিখতেও হয়ত প্রবৃত্ত হবেন! এই একটি ফোন বড় সহজলভ্য জিনিস- অথচ এর আভ্যন্তরীণ মেকানিজম নিয়ে হয়ত একপাল বিজ্ঞানীকে যুগ যুগ অক্লান্ত ভাবে মেধা খাটাতে হয়েছে! একটি এন্ড্রয়েড ফোন আপনার চারহাজার টাকায় জুটতে পারে- কিন্তু ওই মেধাশক্তি ট্রিলিয়ন ডলার খরচেও আসে না! ওর জন্য সাধনা লাগে!

 

সাধনা শব্দটি শুনলেই আমাদের একটা ধ্যানস্থ অবয়ব ভেসে ওঠে! সাধনা কেবল ঈশ্বরেরই হতে পারে যেন! এখানেই তো ঘেঁটে গেলাম! একটি জাতি নীতিবাক্য হিসেবে ‘রামভরসা’ নয়ত ‘ভগবান যা করেন ভালর জন্য করেন’ ধরে সর্বস্ব ভগবানে অর্পণ করে ক্রমশ অকর্মা হল! সবত্র তো এই দশা! আমাকে এক মুসলমান লোক বললেন- ‘জানেন মুসলমানদের মধ্যে কত বিজ্ঞানী ছিলেন আগে, কত কেমিস্ট, কত মেথমেটিশিয়ান ছিলেন’, আমার সোজা উত্তর- ‘Look at yourself’! তুমি কি হতে পেরেছ? তিনি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছাড়া বর্তমানে কিছুই নন! কেমিস্ট-ফেমিস্ট হওয়া তো দূর-অস্ত! ওই ধর্মপ্রাণ-হিন্দু-বৌদ্ধ-কেরেস্তান- সকলের এক কথা এখানে, মানে এই দেশে! ভগবানই যা করার করে দেবেন! আমরা কি ছিলাম, কি করেছিলাম সেটা গলা ফাটিয়ে বললে বর্তমান আলোকোজ্জ্বল হয়ে যাচ্ছে কি? প্রতিনিয়ত বিজ্ঞানের ছত্রছায়ায় জীবন যাবন করে বিজ্ঞানকে আরাধ্য না করা, প্রতিনিয়ত পাশ্চাত্যের উদ্ভাবনী শক্তির কাছে অসহায় হয়ে চেয়ে থাকা, সামর্থ্যে যা কুলাবে কিনে নেব- এই চিন্তায় ব্যকুল হয়ে মরা জাত আমরা! আর পরানুকরণে মজে থাকা! ব্যাঘ্রচর্মাবৃত ভেড়ার দল হয়েই আমাদের কি আভিজাত্যবোধ! এই যে আমাদের পাশের চীনাগুলোকে এত গাল দিচ্ছি! ওদের দেখেও কিছু শেখা যায়! ৫০ বছর আগেও চীন আহামরি কিছু ছিল না! এখন বিশ্ব-অর্থনীতির বিরাট অংশ তারা নিয়ন্ত্রণ করে! টেকনোলোজিতে চীনের সাথে পাল্লা দেবার কথা তো আমি এক ছটাক গাঁজা খেয়েও ভাবতে পারব না! তাদের এত সাফল্যের পেছনে রহস্য কি? শাস্ত্রাধ্যয়ণ? পূজা-পাঠ? জপ-তপ? নামাজ-দোয়া?

 

এখন কেউ কেউ এটাও বলবেন- আমাদের সাংস্কৃতিক আবহটা অন্তমূর্খীনতার! এই ভূমি বেদান্তের, সাংখ্যের, যোগের, বুদ্ধের, নানকের! আলবাৎ! তবে আর কি জঙ্গলে কুটীর বানিয়ে ঘি এর পিদিম জালিয়ে শাস্ত্র লিখতে বসে পড়ুন! অন্তর্জগতের দর্শনও তো মরেছে সেই কবে! ধরুন যেই বুদ্ধদেব ‘ভগবান আছেন’ এই কথা খোলাসা করলেন না- এই দেশে তিনিই ভগবান হয়ে উঠলেন! কেন না- আমাদের দর্শনের গভীরতার চাইতেও আঁকড়ে ধরে বাঁচার মত একটা বিশ্বাস চাই! বিশ্বাসের বলয় ভাঙার শক্তি হয় না বলেই এই দেশে গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস, ব্রুনো জন্মায় না! তবে আমার উদ্দেশ্যে বিশ্বাসকে আহত করা নয়- শুধু এটুকু বলা বিশ্বাস যদি জাগতিক উন্নতির পথে অন্তরায়- তবে সে বিশ্বাস অরণ্যচারী সাধকের জন্যই ভাল! সাধারণ লোকের বাঁচতে গেলে শুধু বিশ্বাস ধরে বসে থাকলেই হয় না! কাজ চাই, উদ্দীপনা চাই, উদ্ভাবনের শক্তি চাই- সেটা কোন স্বর্গীয় কিতাব দিচ্ছে কি? আর কোন স্বর্গীয় কিতাবেই বা এমন লেখা আছে- ‘হে মনুষ্যগণ তোমরা সদা বিজ্ঞানবিমুখী হইবে!’

 

দুঃখজনক সত্য আমাদের দেশে বিজ্ঞান ধর্মের সাথে সদা-সাংঘর্ষিক! আমি দুটোকে একপাতে রাখার কথাও বলছি না! বস্তুবাদ-ভাববাদ তেল আর জলের মত! বিজ্ঞানের তাত্ত্বিকতা আর ধর্মবিশ্বাস মিশে যাবার জিনিস নয়ই! বিজ্ঞান মানেই সেটা এস্ট্রোফিজিক্স তা নয় গো দাদা! যে কোন ধরণের উদ্ভাবনের পেছনে একটা বৈজ্ঞানিক অভিসন্ধি কাজ করে! আমরা অতীতে তাতে পিছিয়ে থাকিনি। ভারতবর্ষ চিরকাল তার গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, ইঞ্জিনিয়ারিং (দর্শন, সঙ্গীত প্রভৃতি লিখলাম না) এর জন্যও দূরের জাতিগুলোতেও পরিচিত ছিল সহস্রাধিক বছর আগেও! কতটা ধনপ্রাচুর্য্য আমাদের ছিল, এমনকি কতটা ভোগবাদ আমাদেরও ছিল- সেসবের ইতিহাসও আছে- আমরা সেখান থেকে সরে গেলাম কোথায়? কেন? আমরা কি ভোগবাদী হয়ে বাঁচতে চাই না তাই? স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন- এই জাতটা ভোগ করতেই শিখল না তো ত্যাগ করবে কি? এতো সেই শেয়াল বলছে দ্রাক্ষাফল টক জাতীয় বক্তব্য হয়ে গেল! আমরা কালের প্রবাহে পিছিয়েছি, আমাদের ভোগ-ঐশ্বর্য্য আততায়ীর হাতে লুন্ঠিত হয়েছে, আমরা আত্মাভিমান বর্জিত হয়েছি, আমরা হাজার বছরের দাসত্বে থেকে নিজেদেরই চিনতে পারছি না, এদিকে pseudo-spiritual হবার লেকচার দিয়ে ভাগাড়ে মরছি! দর্শন, যুক্তি, বিজ্ঞান সব হাস্যকর লাগে! বিরাট বিরাট প্রবচন হয়, মোল্লা-পুরুতের দল মাইকে মাইকে বিজ্ঞানের বক্তব্য নিয়ে খিল্লি করে, অনুভবও করে না যে মাউথস্পিকারটা ধরে আছে- ওটা শ্রীহরি বা আল্লাপাক হাতে তুলে দেননি! ওটাও বিজ্ঞানেরই ফসল! দুর্ভাগ্যজনক হল এটাই এই সভ্যতার সত্য! শয়ে শয়ে সায়েন্স পাশ করে ছেলে মেয়ে বের হয়! তারপর একটা চাকরীর জন্য গাধার মত ছুটে মরা! বিদ্যা চাই- চাকরী লক্ষ্য! বিজ্ঞানচর্চা করার জন্য এই দেশে বিজ্ঞানশিক্ষা হয় না! হাজার হাজার স্কুল কলেজে বিজ্ঞান পড়ানো হয় যেখানে একটা সাধারণ মানের ল্যাবরেটরি পর্যন্ত থাকে না! কেবল বই পড়ে মুখস্ত করা পর্যন্তই চলে! এমন পরিবেশে বিজ্ঞানের অগ্রগতি আশা করা পাগলামি ভিন্ন আর কি হতে পারে?

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

গ্রাস

  বুঝি আর আমাকে দিয়ে হবে না কিছুই। অসময়ে, অনাহুত, অতি অনভিপ্রেত জানি, সমস্ত বিবাদী উষ্মার অন্তরালে হারিয়ে যাব আমার এ যাবৎ যতনে গড়া সুরের ...