মঙ্গলবার, ৫ মে, ২০২০

পাখির গল্প


সারি সারি খাঁচাতে আমরা কতক পাখি ছিলাম। স্ম্রৃতির উন্মেষ অবধি আমরা জেনেছি এই খাঁচার নামই জীবন, এখানে থাকার নামই বাঁচা, ডানা মেলতে না পারাটাই একদেশিকতা, স্বদেশীকতা, অথবা বল স্বদেশপ্রেম- অথবা আর যা খুশী বলে ফেলো, যা ইচ্ছে ধরে নাও!

আমাদের মধ্যে কিছু পাখি বেশী ডানা ঝাপটাতো বলে ওদের হয়ত আরেকটু বড় খাঁচায় রাখা হত। যাদের ঝাপটানোর বেগ বেশী থাকত, লম্ফঝম্প থাকত- তাদের পায়ে শেকল পড়ানো হত! এই শেকলটিকে আমরা আইন-শৃঙ্ক্ষলা-নিয়ম-কানুন বলে সমীহ করতাম! কিছু পাখি এতেও দমে যেত না! কোনদিন ঘুম ভাঙলে দেখতাম সে পাখি আর খাঁচাতেই নেই! কোন পাখির না থাকা নিয়ে আমাদের প্রবল মনোকষ্ট হত না। পাখি হলেও আমাদের মধ্যে কিছু কিছু মানুষের চরিত্র তো থাকতেই পারে! এভাবে বললে মানুষেরা নিশ্চয় রাগ করবে না!

এভাবে কত পাখি হারিয়ে যায়, আর খাঁচায় ফেরে না! আমাদের তাতে কি! আমরা দিব্যি আছি! নিত্যকার খাবার খাই, কিচিরমিচির করি, (সাহিত্যিকেরা কলকাকলী বললে গর্বে পালক ০.০০১ ইঞ্চি ফুলে যায়!) শৌচকর্ম করে ভরিয়ে রাখি, কিন্তু ডানা স্তিমিত! আমাদের প্রায় সবারই ডানা এখন অকেজো! আমরা অনেকে ভুলেই গেছি যে আমাদের ডানা আছে, আমাদের মনেও পড়ে না ডানা কি কাজের জন্য বিধাতা আমাদের দিয়েছেন! কারো কারো মধ্যে, যাদের মধ্যে প্রাণীজ স্বভাবের প্রজাতিগত তাড়না প্রবল তাদের খুব সংকট। কেমন করে না চাইলেও যেন ডানা আকাশে উঠতে চায়! এটা কি ভাল? এটা অসংযম নয়? স্বেচ্ছাচারিতা নয়? যে খাঁচায় যে নিয়ম- সেখানে তেমন পালন করা কি উচিত নয়? কিন্তু সকলের দ্বারা হয়ে ওঠে না! হয়ত পাখির কাছ থেকে চিরতরে পাখিত্বটুকু মুছে ফেলা যায় না! সকল পাখির জীবন খামারের হতশ্রী মুরগীর মত হবে না; যেমনি উড়তে অকেজো হলেও সকল পাখি ময়ুরের মত রাজকীয়ও আবার নয়! আমরা পাখিদের মত মানুষের তো আর শতেক প্রজাতি নেই- থাকলে হয়তও ওরাও এক প্রজাতি অন্য প্রজাতির সাথে নিজেদের তুলনা দিয়ে কথা বলত! তারা তা করতে পারে না, খামোখা আমরা- মানে অন্য প্রাণীগুলোকে টেনে এনে অপদস্থ করে! মানুষের সাথে গরু, ছাগল, ভেড়া, কুকুর, হাতি, বাঘ, সিংহ, শুয়োর, গাধা, কাক, কোকিল, মুরগী- এসবের ন্যায্য তুলনা কি সম্ভব? কিছু মানুষ নিতান্ত মানুষের চরিত্র বিবেচনায় এদের চরিত্রের চেয়েও নিচে কি নয়?

আচ্ছা এসব কথা ছাড়ি! কিছু পাখি ডানা হারিয়ে এখন কেবল ভাবার শক্তি বাড়িয়ে নিয়েছে! এরা ভাবুক পাখি! যে কখনো ওড়েনি- আমরা তাঁর কাছে আকাশের গল্প, আকাশের হাওয়া, আকাশের দর্শন শুনতাম! কিছু পাখির জীবনে সুখ কেবল কল্পনা, এবং কল্পনা মাত্রেই সুখের! আমিও ভেবেছিলাম- আমারও হয়ত তাই হবে! ডানা না থাক, আকাশ যে আছে, তার কল্পনা করেই নিশ্চয় সুখী হওয়া যায়! কিন্তু হল না, অত্যন্ত বিশ্রী ভাবে আমার মধ্যেও একদিন জান্তব বৃত্তি চলে এলো- ডানা নড়তে শুরু করল থরথর করে, কি কদর্য এই দৃশ্য! আমি থামাতেই পারছি না, আমি কত চেষ্টা করছি, কিছুতেই থামতে চাইছে না! দুম করে ডানা সপাট খুলে গেল! বহু বছরের জমাট বাঁধা অচল ডানার সকল তন্ত্রে যেন বন্যাবেগে রক্ত ছুটেছে! জানি, সকলে বলছে- এ অন্যায়, এ উচ্ছৃঙ্ক্ষলতা, এ বিপজ্জনক- আমি নিজেকে রুখতে পারি না আর! ডানা মেলার যে শিহরণ, তার যে উত্তেজনা, তার যে উন্মাদনা- আমি তাতে বাকী সব ন্যায়-নীতি যেন বিস্মৃত হলাম, আমি ভুলে গেলাম- অতীতে যারা ডানা মেলতে চেয়েছিল- তারা আজ কোথায়! নিজেকে ভয়ে হোক, অথবা বহুদিনের কু-শিক্ষার সুফলে অথবা সু-শিক্ষার কুফলে সংযত করে নিলাম! সত্যিই তো এই উদ্দাম ডানা মেলা যে অশোভন! কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একবার যার ডানা মেলার স্বাদ মিলে গেছে- সে হয়ত দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, সহস্রবার ডানা মেলতে চাইবেই, চাইবেই অপ্রতিরোধ্যভাবে- যে চায় না সে হয়ত পাখি নয়, তার পাখিত্ব মরে গেছে, যে পাখির আকাশে ওড়ার ইচ্ছে জাগে না তাকে আর পাখি বলে মানতে মন চায় না! ডানা ঝাপটানোর তীব্র ইচ্ছেটুকু যেন কেমন ধাঁচের উগ্র বানিয়ে ফেলছে আমাকে, আমি অনুভব করছিলাম! একসময় আমিও অন্য পাখিদের বলতাম- বাইরের গাছের ডালে বাসা বুনে থাকা বুনো উড়ন্ত পাখিদের চাইতে আমরা সুখী, আমরা কত নিশ্চিন্ত জীবনে থাকি, খাবার খুঁজতে যেতেও হয় না, বাস্তুহারা হবার ভয় নেই, পরিযায়ী হতে হয় না- এই যে এত সুন্দর পরিচ্ছন্ন ও শান্তিপূর্ণ জীবন- এর জন্য আমরা কেন না আমাদের ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব? আমাদের মধ্যে যে শুভবুদ্ধির ভাব আছে, এই যে নিজেদের সংযত রাখার শক্তি আছে- এ নিশ্চয় ঈশ্বরের কৃপা! তাই নয় কি! সম্ভবপর সমস্ত অপযুক্তির আশ্রয়ে যে আমি নিজের খাঁচাটিকে অশেষ সৌভাগ্য বলতাম- আমার এখন এটি একটি সংকীর্ণ মৃত্যুর পথ ছাড়া আর কিছু মনে হয় না! নিজের ভেতরের এই আকস্মিক বিবর্তনে অপরের কথা কি বলব- নিজেই যেন আর নিজেকে চিনতে পারছি না আমি! বিবর্তন সুখের হয় না এটা অনুভব করতে পেরেছি! যদিও আমি লক্ষ অব্যর্থ যুক্তি এনেছি ডানার নিচে যা দিয়ে আমি উড়তে চাওয়াকে অনায়াসেই সমর্থন করতে পারি! কিন্তু আজও আমার উড়তে দ্বিধা, উড়তে দ্বন্দ্ব- কেন না আমি জানি আমার ওড়ার স্বাধীনতা নেই- সেখানে এত কথার মূল্য- অর্বাচীনতা ছাড়া আর কি!
আমি আমার ছোট্ট খাঁচাটিতে গুমরে মরে গেছি! আমার প্রাণের সকল স্পন্দন আমার ডানার মধ্যে গিয়ে ভীড় করত! ক্রমে ক্রমে আমি যেন উন্মাদ হয়ে যাচ্ছিলাম! পাশের খাঁচার পাখিরা এসে আগে কত কি বোঝাতো, কত সান্ত্বনা দিত, প্রবোধ দিত- তারা এখন আমি পাগল হয়েছি ভেবে তফাতে আছে! আমার তাতেও আর আপত্তি লাগে না- আমি একটি আলাদা পাখি হয়ে যাচ্ছি- আমার ভীষণ ওড়ার ইচ্ছে! আমি জানি ডানা ঝাপটালে এই খাঁচায় আমি আর ফিরব না, আমি জানি না অতীতের ডানা ঝাপটানো উচ্ছল পাখিরা কোথায়- আমি বুঝতে পারি- বুনো পাখির জীবন কত অনিশ্চিত, তবুও বুনো বাসনার বুনো আবেগে আমি ভেসে যাচ্ছি- আমি ভুলে যাচ্ছি- আমি যে খাঁচার পাখি নই- আমার মনে এ দৃঢ় বিশ্বাস এসেছে- আমি কেবল মাত্র পাখি- খাঁচাটি আমার নয়, আকাশটি আমার- ডানা দুটি আমার নিজের, আমার অপত্য অঙ্গ, ধার করে জুড়ে দিইনি কারো কাছ থেকে এনে- ডানা দুটি উড়ব বলেই আমার গায়ে আছে- এই যে উড়তে পারি না- এর নাম সংযম নয়, এর নাম পরাধীনতা, এর নাম স্ব-বিরোধ! আমি যে উড়বার জন্য জন্মেছি- এ চেতনাটুকুতেই কি উৎকট স্বাধীনতার গন্ধ!


মুক্তির জন্য যে কখনো একটি শব্দ করেনি- সে আমাকে বুঝিয়েছে- খাঁচার প্রতি প্রেম থাকাটা আমার কর্তব্য ও ধর্মের মধ্যে পড়ে! অথচ- আমি উড়তে চেয়ে বুঝলাম- পাখির ওড়ার ধর্মটিকে বাদ দিয়ে, পাখির আকাশের প্রেমটিকে বাদ দিয়ে আর সকল ধর্ম, সকল প্রেম- মন্ত্রমুগ্ধতার মত মিথ্যে!

শেষের গল্পটুকু না-ই বা লিখি! আপনারা তো মানুষ! নিজেকে আমার মত একটা পাখির সাথে তূলনা করতে তো দ্বিধা আপনাদের হয় না! ভেবে দেখুন তো নিজেকে পাখি হয়ে- এর পরের গল্প আপনি কেমন করে ভাবতেন!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

গ্রাস

  বুঝি আর আমাকে দিয়ে হবে না কিছুই। অসময়ে, অনাহুত, অতি অনভিপ্রেত জানি, সমস্ত বিবাদী উষ্মার অন্তরালে হারিয়ে যাব আমার এ যাবৎ যতনে গড়া সুরের ...