বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২০

নিভৃত ছাই

 

একেলা বাঁধি, একেলা গাই

একেলা কাঁদি, একেলা ধাই

একেলা পথে, একেলা স্রোতে

একেলা চলা বিরাম নাই!

 

নয়ন অন্ধ, শ্রবণ বন্ধ,

মূক-মরমে মরণ ছন্দ

দুলে দুলে ওঠে দুর্বার স্রোত

মথনের শেষ, গরল খাই!

 

তিমির প্রকট, ভগ্ন শকট

বন্ধুর পথ, ঘোর সংকট,

পরাণের তলে আগুন আলোক

প্রভাত বেলায়, নিভৃতে ছাই!  

 

 

বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০

পদে গো রাখো পতিতে

 

পদে গো রাখো পতিতে, বিপদে বিপথে ধাই!

মা বিনে কে রাখে কোলে, নিরাশ্রয়, কোথা যাই?

 

হলাহলে ভাবি সুধা, লোভ-মোহ-কাম-ক্ষুধা,

নিবারি কি দিয়ে ভেবে, যা-ই জোটে তা-ই খাই!

 

ভাবি কি আনন্দে আছি, ধনাদি সম্পদ যাচি,

দু’কড়ি দু’দিন রবে, তা নিয়ে কত বড়াই!

 

দেখে হাসে রবি-সুত, মোর দশা হল মনঃপূত,

নিমেষে গো কালপাশে, দেহযন্ত্র হবে ছাই!

 

 

 

 

 

 

বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০

জাগ্রত মহাকাল


 

মহীমণ্ডল ব্যাপৃত তব মৃত্যুর মায়াজাল

গভীর শান্ত ধীর অনন্ত জাগ্রত মহাকাল!

মদন-দমন রিপুদল প্রতিহারী,

অরিমর্দন শমননাশন ত্রিশূল-পিণাকধারী,

ধর ভস্মভূষণ, পন্নগ-শোভা,

কটিবাসে বাঘছাল!

 

নটনায়ক ডমরু ডক্কে,

নৃত্যরঙ্গে দর্প বিনাশ শতেক দক্ষে,

মহাভৈরব, চন্দ্রহাসের ঘায়ে!

রক্তে বাজুক ঘোর-নিনাদে

রুদ্রবীণার ঝংকার,

শশী নিভে যাক মুক্ত জটার ছায়ে!

 

থরথর কাঁপি,

অন্তরে জ্বলে জরা-ব্যাধি-শোক-শঙ্কা!

শঙ্কর হে,

আমি যে একেলা অবেলায় ভাঙা রথে,

বাজে পথে পথে তপন-তনয়-ডঙ্কা!

 

পরাণে আমার জাগো নটরাজ,

ভোলো তান্ডব, তোলো সৃষ্টির কোন তাল!

গভীর শান্ত ধীর অনন্ত জাগ্রত মহাকাল!

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

'আপনারা আমাদের ভাই'

 


‘আপনারা আমাদের ভাই……

 

৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেও শেখ মুজিবর রহমান দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে পশ্চিম-পাকিস্তানীদের নিজের ভাই বলছেন, এতে তাঁর কোন কুন্ঠাও ছিল না, থাকার কোন প্রেক্ষাপটও ছিল না, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও এই ভাতৃত্বের আবাহন শেখ মুজিবর রহমান বন্ধ করেননি কোনদিন। রাজনৈতিক বিরোধ, অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ, দিনের পর দিন শোষণ, তাচ্ছিল্য অবজ্ঞা পরিশেষে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের হোতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে তিনিই হাস্যবদনে আলিঙ্গন তো করেছেন! এই আলিঙ্গনকে কি রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলবেন নাকি ভাতৃত্বের বাহুবন্ধন? আততায়ীর সঙ্গে কোনটা সম্ভব? ভুট্টোকে তবু যদি বলি মানুষ, আর যদি স্বীকৃত ‘বাংলার কসাই’ (Butcher of Bengal) খ্যাত টিক্কা খানের সাথে শেখ মুজিবরের করমর্দনের কথা ওঠে? টিক্কার তো মানুষ নামটাই ঘুচে গেছে কবে!  

 

সবই হয়েছিল ১৯৭৪ সালেই পাকিস্তানের মাটিতেই OIC সম্মেলনে! এই ১৯৭৪ এ-ই ভুট্টো বাংলাদেশ সফরেও আসেন। যদিও কতিপয় বাংলাদেশী দেশপ্রেমী সেদিন প্রতিবাদ জানাতে সোচ্চার ছিলেন, আজকে তেমন হয়ত হবার কথা নয়! শেখ মুজিবর রহমান দেশনায়ক হিসেবে নিজের স্বাধীনচেতা মনোভাবকে বজায় রাখলেও অন্তর থেকে ‘আপনারা আমাদের ভাই’- সেন্টিমেন্ট থেকে বেরুতে কতটা পেরেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর মাটি খুঁড়ে বের করার প্রয়োজনীয়তাও বা ক’জন অনুভব করেন?

 

নাস্তিক্য ও ইসলাম অবমাননার সেন্টিমেন্টকে তোয়াজ করতে শিখে গিয়েছিলেন তিনিও! “কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়” লিখে সেই একই বছর ১৯৭৪ সালে দাউদ হায়দার গ্রেফতার হলেন! মুজিবের নির্দেশেই তাঁকে দেশান্তরীও হতে হল! ইসলামপন্থীদের সেদিনও এত শক্তি ছিল! সেদিন কবি ও কবিতার মুণ্ডপাত হয়েছিল! তবুও মুজিব দোষীই রয়ে গেলেন! আজ তেমনি হাসিনা দোষী! আর সে সময়ের অগোছালো রাজনৈতিক খুনোখুনির চিত্রও ইতিহাসের পরতে পরতে রয়ে তো গেলই! এসব ৭১ এর স্বাধীনতার পরের কথা হচ্ছে!

 

শেখ মুজিবর রহমানের পাকিস্তান বিরোধের সাথে ভাইয়ে-ভাইয়ে দ্বন্দ্বের একটা রক্তপ্লাবী নাটকীয়তা আছে। এই দ্বন্দ্ব যেমন মিথ্যে নয়, আবার তেমনই যতই রক্ত ঝরুক রক্তের টানটাও মুছে ফেলার মত নয়! এটা এক ধরণের পারিবারিক লড়াইয়ের মত ব্যাপার। তিনি লড়াইয়ের মধ্যে থেকেও ভাইকে ভাই বলে ডাকতে তো দ্বিধা করেননি। ভাইয়ে ভাইয়ে কাঁধে কাঁধে মিলিয়েই তাঁরা একদিন স্বাধীন পাকিস্তান হাসিল করেছিলেন। এটা কি ভোলার কথা? একটা ‘ডাইরেক্ট একশন’ স্লোগান আজও বাংলাদেশে হামেশা শোনা যায়! অনেকে জানেনই না এই ‘ডাইরেক্ট একশন’ কোথা থেকে এল? ৪৭ এর ইতিহাস ক’জন পড়ে? ক’জন আর ‘ডাইরেক্ট একশন ডে’ মনে রাখে?

 

আজ বাংলাদেশে কোন বাঙালী পাকিস্তানীকে ভাই বললে কারো এত আপত্তি তবে কেন হচ্ছে? একজন পাকিস্তানী ঐতিহাসিকভাবেই একজন বাংলাদেশীর (অমুসলমানের নয়) ‘ভাই’, একজন পাকিস্তানী ধর্মের নামেও ‘ভাই’! এতটুকু কথা স্বচ্ছ নয়? শেখ মুজিবর রহমান ‘ভাই’ ডাকতে পারলে বাকীরা না ডাকার কে?

 

এই ভাতৃত্বের আবাহন বজায় রেখেও মুজিব পাকিস্তানে ‘গাদ্দার’ আর ‘ভারতের চর’ হিসেবে টিকে গেলেন, আর স্বদেশী পাকিস্তানীদের কাছেও তিনি তাই, উপরন্তু তিনি ইসলামেরও শত্রু! তিনি ভারতের দাস, সেইসাথে তিনি বাংলাদেশে হিন্দুদের বাপ!

 

৭৫ এ মুজিব হত্যার পরের ঘটনা, আমার এক আত্মীয়, তিনি তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েন- তাঁকে তার সহপাঠীরা বলছে- ‘কি রে তোদের হিন্দুদের বাপ তো মরে গেল, এখন তোরা কি করবি?’ ভাবুন তাঁর সহপাঠীদের বয়স কত হবে তখন? যা-ই হোক, সত্যিই আমার সেই আত্মীয় আর দেশে বাস করতে পারেননি। তার পর হিন্দু উৎখাতের নতুন কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তান কেবল মাত্র মুসলমানদের আবাসভূমি হবে! এই দাবী কি অন্যায্য? আপনারাই বলুন? নোয়াখালীতে এত হিন্দু কেটেও কি এই ন্যায্য অধিকার আদায় করা গেল না? এতদিন একটা ইসলামের শত্রু ছিল বলেই এটা কষ্টকর হচ্ছিল। এখন আর সমস্যা তো নেই! ৪৭ এর পর, ৭১ এ পাকিস্তানীরা হিন্দু-নিধন শুরু করেছিল পুরোদমে, মুজিব ভারতের সাথে হাত মিলিয়ে কিছুটা বাঁচালেন! কাজটা খুবই খারাপ হয়েছিল বটে! মুসলমানও যে মরেছে এ নিয়ে রাজাকারদের বক্তব্য কি তা আর কার অজানা? মুক্তিকামী মানুষ মাত্রেই ইসলামের শত্রু যে!

 

পাকিস্তানে অনেকে আফসোস করেছিল, যারা সত্যিটা জেনেছিল, তারা বলেন- ‘ইয়া আল্লা! মুসলমান হোকে মুসলমানকি সাথ এইসা বদ-সলুক!’ -গেহর মুসলামনের সাথে হলে একটা কথা ছিল তবুও! এরা মডারেট ধর্মপ্রাণ বান্দা!- গেহর মুসলমান মাত্রেই মুসলমানের শত্রু! তাই তো? অমুসলমান মরলে এতটা বিচলিত হবার কি আছে?

 

আজও বাংলাদেশে স্লোগান ওঠে ‘ইসলামের শত্রুরা হুঁশিয়ার সাবধান!’ এই শত্রু কারা? আমেরিকা-ইজরায়েল? হাসি আটকাতে পারলাম না আর! গোটা পৃথিবীটাই, পৃথিবীর যাবতীয় শিল্প-সাহিত্য-কৃষ্টি আজ তাদের শত্রু হয়ে যাচ্ছে! সমস্যাটা কেবল হিন্দুর সাথে মুসলমানের সংকটে নেই! কেবল প্রতিমা ভাঙচুর পর্যন্ত এতদিন জায়েজ ছিল, এখন হাত মুজিবের ভাস্কর্যেও লাগছে নির্দ্বিধায়! এবং এটাই শুনছি ধর্মসঙ্গত! রাষ্টের যেহেতু একটা ধর্মও আছে কেন না তার বিধি-বিধান ধর্ম না মেনে চলবে। তাই না?

 

মুজিব ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চেয়েছিলেন। জিন্নাও তেমন ভাবতে চেয়েছিলেন- মুসলিম ম্যাজোরিটি নিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যা পৃথিবীতেও একটিও নেই! এটা সম্ভব নয়। কামাল আতার্তুকের তুরস্ককেও পরে গিয়ে এরদোয়ান-ই জুটেছে। যা হোক এই প্রসঙ্গ নিয়ে ঘেঁটে লাভ নেই। আমাদের আশে পাশের প্রতিটি দেশ গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ হবে- কিন্তু আমাদের একটা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম চাই-ই চাই! এত সুন্দর যুক্তিশীল মননের অধিকারীদের সাথে কি তর্ক?

 

ভাতৃত্ববোধের আলোচনায় আসি। আমার কখনো মনে পড়ে না- মুজিব ‘ভারতীয়রা আমাদের ভাই’ কথাটা উচ্চস্বরে কোনদিন বলেছেন! সেটা বলার মত প্রেক্ষাপট আসেনি। এবং ভুলক্রমে সেটা কোথাও বললে সেই উক্তি তাঁর রাজনৈতিক ভাবমূর্তির জন্য হানিকারক হবারই কথা ছিল। ভাই না ডেকেও যে গোলামের তকমা নিয়ে ফেলেছিলেন এমনিতেই! আর ভারতেরও কোন অর্থেই ওই আবাহন দরকার পড়ত না। মুজিবের সাথে ইন্দিরার সম্পর্ক, ৭১এর যুদ্ধ সবটাই ভূরাজনৈতিক কারণে সংঘটিত। দু’পাশে দুটো শত্রু আর লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর বোঝা লাঘবের চেষ্টা- ৭১ এর যুদ্ধ। এটাই তো- বাংলাদেশের রাজাকাররা আরেকটু বাড়িয়ে বলে, তারা বলে- স্বাধীনতার পর ভারত লুটপাট চালিয়েছে- যদিও এর পেছনে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই! এদের কাছে বর্তমানে যেমন ‘হাসিনা ভারতের কাছে দেশ বেচে দিচ্ছে’ তেমনি সেদিন ‘মুজিবও ভারতের কাছে দেশ বেচে দিয়েছিল!’ প্রতিটি রক্তকোষে যাদের হিন্দু ও ভারতবিদ্বেষ তাদের কাছে এই ডায়ালগ পরম্পরা। তারা নতুন নতুন হাস্যকর লজিক যদিও অহরহ আনে। তাদের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট করে বলা- ‘ভাই ভারত চিরকালই তোমাদের জাতশত্রু, অতীতে বন্ধু ছিল বলে মিথ্যে যুক্তি টানার কাজ নেই- ৪৭-এই তো প্রমাণ হয়ে গেছে, বারেবারে একে প্রমাণ করার তাগিদ কেন এত? কিসের এত জ্বালা?’ এই জ্বালা নিভবেই বা কি করে? বাংলাদেশ আগামী এক যুগের মধ্যে পুরোপুরি তালেবানি শাসন কায়েম করে ফেলতে পারলেও কি এই জ্বালা নেভানো যাবে?

 

আমি অন্তত কখনো এই কথা বলিনি ‘ভারত ও বাংলাদেশ ভাই-ভাই’! এসব ফালতু কথা। কেউ এসব ফালতু কথা বললে আমার খুব বিরক্ত লাগে। ভূ-রাজনীতি তো জি-বাংলা সিরিয়াল নয় যে রাতদিন সেন্টিমেন্টের খেলা চলবে! তবে একটা ছবি মনে পড়ে আমার-

 

১৬ ডিসেম্বরে যখন ঢাকার রাস্তায় ভারতীয় বাহিনীর ট্যাংক ঘুরে বেড়াচ্ছে, সাধারণ মানুষের কি উচ্ছাস, ফুল ছুঁড়ে স্বাগত জানানো, কেঁদে কেটে বুকে জড়ানোর চিত্রটা মনে আছে আপনাদের? এই চিত্রকে অমলিন রাখা যায়নি! রাখা সম্ভবও নয়। এই চিত্রটা ভাইয়ে-ভাইয়ে মিলনের না হলেও তার চাইতেও বেশী হৃদয়স্পর্শী হয়ে বেঁচে ছিল দীর্ঘদিন। এটা সাময়িক। শুনেছিলাম ফিল্ড মার্শাল মানেক-শ’ নাকি বলেছিলেন- গোটা যুদ্ধটাই ভুল ডিসিশন!

 

মুজিব-ভুট্টোর হাস্যোজ্জ্বল চিত্র দিয়েও রাজাকারপন্থীদের নতুন কিছু বোঝানোর নেই। বাংলাদেশকে পরিপূর্ণভাবে পাকিস্তানের মত করে ফেলতে না পারলে তাদের শান্তি হবে না। এখন তাদের লক্ষ্যমাত্রা পাকিস্তান হবার চাইতেও উন্নততর! তাদের লক্ষ্য কাবুল-কান্দাহারে গিয়ে ঠেকেছে। কাবুল-কান্দাহার যদিও লাহোর-পেশোয়ারকে সহ্য করে না আর! ভাইয়ে-ভাইয়ে প্রেম সেখানেও টেকেনি। এসব সংঘাত নিয়ে পর্যালোচনাও আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।

 

আমি অতি সহজ কথায় বললাম- মুজিব পাকিস্তানীদের ভাই ডাকতে কখনো কুণ্ঠিত হন’নি, তাই বর্তমানে কোন বাংলাদেশী পাকিস্তানীদের ভাই বললে তাঁকে পাকিস্তান-প্রেমী রাজাকার ডাকা একেবারে অবান্তর! তেমনি পাকিস্তান ভাই কি ভাই নয় এই আলোচনা আসলেই সেখানে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ করার চেষ্টাও হীনমন্যতা। পাকিস্তান ভাই ছিল এবং ভাই হিসেবেই থাকবে। কতিপয় পশ্চিমবাংলার অতি-উদারতায় রুগ্ন, ইতিহাস বিস্মৃতির আলঝাইমার রোগীর কাছে বাংলাদেশের বাঙালিরা ‘আমাদের ভাই’ জাতীয় আবেগ উৎপন্ন হয়েছে এবং এর সুযোগ্য কোন ফিডব্যাক ওদিক থেকে কদাচিৎ আসেইনি! রাতারাতি ঘর-দোর-জমিজমা-মন্দির আর জমিদারী হারিয়ে, প্রাণটা নিয়ে পালিয়ে এসে, এপাড়ে আধপেটা খেয়ে শরণার্থী হিসেবে দিনাতিপাত করা ওপাড়ের হিন্দুর পরের প্রজন্ম বরাবরই অতীত-ভুলো হয়ে হোক, বা কাল্পনিক মাটির টানে ওদেশ ভোলেনি, ভাই-ভাই মরা কান্নাকে জিঁইয়ে রেখেছে- এদের কি বলা যায় জানি না!

 

আমার বাপের হত্যকারী, আমার মায়ের সম্ভ্রমে হাত দেবার সাহসকারী দানবকে আমি কোন অর্থেই কোনকালে বুকে জড়াতে পারব না! মুজিব ভুট্টোকে বুকে নিতে পেরেছেন! আচ্ছা এটা মুজিবের উদারতা বলে ভুলে যাই বরং! কিন্তু আমি তো উদার নই! আমার অত বড় অন্তর নেই! আমি ভুলতে পারি না! আমি আততায়ীকে ভাই বলার মত মহাপুরুষ নই! আমার ভাইয়ের দিকে যার ছুরি ওঠে সে আগামী সাত জন্মেও আমার ভাই হবে না! কোনদিন হতেই পারে না! সে বাঙালি কি পাঠান, কি মুসলমান কি গেহর মুসলমান! আমি তাকে আততায়ী বলেই আগামী সাতজন্ম চিহ্নিত করে রেখেছি!

 

কোন বাংলাদেশী কোন পাকিস্তানের সাথে কি সূত্রে ভাই হচ্ছে এই বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ও আপত্তি নেই, সে যদি আমাকে ভাই ডাকে তাতেও আমি খুশী, সে যদি আমার দিকে ছুরি উঁচিয়ে চলাকে ধর্ম ভাবে- তবে ভাই আমি গদগদ প্রেমবাক্য বলতে পারি না, আমি সপাটে তলোয়ারটা চালাব!

 

ভাই-ভাইয়ের গল্প আমার ঢের শোনা আছে!

 

 

রবিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২০

মাতলামি

 

চোখ মেলেছি, কান খুলেছি- ভণ্ডামি আর আঁতলামি,

হাঁচা কথা শুনতে লাগে, দিন-দুপুরে মাতলামি!

 

মুখোশ পড়া ভাঁড়ের দলে বিদ্যাভূষণ রাজার সভায়,

রন্তভাণ্ড পূর্ণ যতেক ন্যাকা-পাকা-বোকা-হাবায়!

ফুটেজ পেলেই সেলিব্রেটি, তাদের কথা-ই মানবে লোকে,

আমার কোন ফুটেজ তো নেই, মরব বটে ফুটেজ-শোকে!

মরলে তবে কেঁদেই কি লাভ,

কে আমার আর কার আমি!

হাঁচা কথা শুনতে লাগে, দিন-দুপুরে মাতলামি!

 

 

 


বুধবার, ১১ নভেম্বর, ২০২০

নয়নসমুখে দাঁড়া (বাউল)

 

কেমনে বল পারে যাব, কোথা গো তরণী তারা?

ঘাটে এসে বসে আছি, ডেকে কারো পাইনে সাড়া!

 

সাজিয়ে শতেক মোহ, সংসারে সঙ-সমারোহ

দিনশেষে সার বুঝেছি, তাই ধর্মাধর্ম হল সারা!

 

বলি তোরে হরজায়া, সুত-প্রতি নাই কি মায়া,

মায়াতীতা জানি বটে, (তবু) কেমনে রই মাতৃহারা?

 

ষড়-যন্ত্রে পঞ্চতত্ত্ব, প্রপঞ্চে সদা প্রমত্ত,

কেঁদে বলে বিশাখদত্ত, মাগো নয়নসমুখে দাঁড়া!

 


রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০২০

অপরিপাটি

কারা কি কি বলে কি তাতে পরোয়া!

কেউ বলে ‘ব্যাটা উড়নচণ্ডী’

কেউ ভাবে ‘না না গণ্ডিবদ্ধ,

নয়কো মদ্দ, হদ্দ ঘরোয়া!’

 

কারা কারা ভাবে ভালবাসে বলে

আমি ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা ক’ব!

ঢল ঢল মধু পিরিতি আলাপে

যত বিচুটি পাতার জ্বলুনি স’ব!

 

দাসখত আমি দিয়েছি বা কাকে

মনোমত তার বদলাতে হবে?

কার কাছে ঋণী রয়েছি এমনি

অনাদায়ে ঋণ গালাগালি দেবে!

 

কারো কাছে ভুলে বিকাইনি মাথা,

এর চেয়ে ভাল মাথা কাটি!

গুছিয়ে মিথ্যা কইতে পারিনে

আমি একচুলও নই পরিপাটি!

 

 

 

 

 

 

 


মঙ্গলবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২০

অপেক্ষার গান



সংসার-মাঝে হলাহল-স্রোত জাগ্রত কোলাহলে,
সমুখে দাঁড়াও অমৃতের তরী, দুখের উজান ঠেলে!
সংশয় ঘোর ব্যথার আকাশে একেলা বিহগ-ডানা-
আমি ঘুরে মরি, চোখের কোটরে মরণ অশনি-হানা,
এসো তমোহারী বিজয়ধ্বজে ধ্রুবজ্যোতি তব জ্বেলে!
সংসার-মাঝে হলাহল-স্রোত জাগ্রত কোলাহলে.........
নিবিড় মোহের কুহক আড়ালে, নীরবে নিভে গো যাই,
ব্যর্থ পরাণ-প্রদীপের শিখা, অপলাপে কত রাগিনী গাই!
সাধ করে বাঁধি তার ছেঁড়া গান, সুর কাটে বাঁধা তাল-লয়ে
উদাস জনম নদীতীর যেন, ভাঙে গড়ে আর যায় বয়ে,
কেউ কি রবে না দিনশেষে আর অভাগার তরে দোর খুলে?
সংসার-মাঝে হলাহল-স্রোত জাগ্রত কোলাহলে.........
_______________
রচনাকাল- ২৭ অক্টোবর, ২০২০। রাত ১০ঃ৪৯

সোমবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২০

গিরির প্রবোধ

 


 

কেঁদো না কেঁদো না রাণী, উমা আমার কোথা যায়?

মুদিলে দু নয়নে হেরো, অন্তরে যে দেখা পায়!

সায়ুধবাহনা তারা, নিত্যা, চৈতন্যধারা,

গুণত্রয়ে সালংকারা, প্রেমডোরে ধরে কায়!

অথচ সে নির্গুণা, প্রপঞ্চে বিরাজমানা,

লীলারূপে কন্যা হল, পুণ্য কত ভাব তা’য়!

বলি গো মেনকারাণী, দুয়ারে যে শূলপাণি,

দাঁড়ায়ে রয়েছে দেখি, ডাক গো আমার উমায়!

 

 

 

 

 

 

 

 

শনিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২০

খেলা-ভঙ্গ


শত জনমের অচল বরষা, আমি যে মেঘের আড়ালে,
সাঁঝের বাতির শিখাটি উঁচিয়ে, হাতটি কে যেন বাড়ালে!
জলভরা বুকে মরে না পিয়াস, নদী হয়ে তীরে ভাঙা নিশ্বাস-
ঢেউ খেলে চলি জনম জনম, কে তুমি সহসা দাঁড়ালে?
জানি না কোথায় ছুটেছি একেলা, পথজুড়ে কত ভাঙাগড়া খেলা,
ক্ষণিক প্রাণের পুতুলের মেলা, যারে খুঁজি, ভিড়ে হারালে!
তার সাথে আজ নিতি লুকোচুরি, এই মনে হল, এই যেন ধরি-
হাত ধরে বলি 'খুব খেলা হল- খেলাছলে খেলা ভাঙালে'!

বৃহস্পতিবার, ৮ অক্টোবর, ২০২০

হাথরস

 

অন্ধকারের কোন খবরারবর রাখি না আর,

অন্ধকারই সমস্ত খবরের উৎস হয়ে গেছে!

 

নিঃশ্বাসের হাওয়া লাগে, এমন দূরত্বে আছি,

তবু দৃশ্যত সে নেই বলে আমার নিয়ত অস্বীকার-

তারও গা-সওয়া হয়ে গেছে।

 

‘তমঃ’ মন্ত্রের লক্ষ পুরশ্চরণ শেষে, একটিবার-

ভেবেছি আলোকদয় হবে, দুরাশা ধুয়ে মুছে

চোখের নীচে আধ-ইঞ্চি- তার জন্য মেপেছি স্থান,

 

দেখি

 

আরও কত ‘হাথরস’ হাতছানি দেয়,

আরও কত হাত কাঁপে হতশ্রী হয়ে,

হাত গলে ঝরে যায় হাত-ধরা গান!  

 

 

 

 

সোমবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০

লাইট-মিউজিক

 

অনেকে কিছু গানকে ‘Light-Music’! Anything apart from Classical Music is ‘Light Music’! এই সংজ্ঞাটিকে ইংরেজীতে প্রশস্তি করলে বলা যেতে পারে ‘Bullshit’! এর চেয়ে ভদ্রস্থ কিছু আসছে না! প্রত্যেক Genre এর গানের একটা নির্দিষ্ট বিশেষত্ব ও আলাদা সাধনার পদ্ধতি আছে! বিশুদ্ধ মার্গসঙ্গীত গাইতে শুদ্ধ বৈয়াকরণিক হতে হচ্ছে, সাথে ভাবের মাহাত্ম্যটিকেও অক্ষুন্ন রাখতে হয়- দুদিক রক্ষা কষ্টকর বটেই! কিন্তু ঠুমরীর আবেগ, ঠুমরীতে স্বজ্ঞানে কয়েকটা এদিক-ওদিক স্বরের মিশ্রণের যাদু দেখানো খুব light-weighted কাজ নাকি? ধরুন গজলের কথা, পূজনীয় ভীমসেন যোশী যদি ওস্তাদ মেহেদি হাসানের গজল গাইবার চেষ্টা করতেন সেটা কেমনতর শোনাত? And the vice-versa! একজন বাউলকে সঙ্গীত-সিদ্ধ হতে গেলে ৩০ বছর ব্যাকরণ শিখতে হয়? হয় না তো! সঙ্গীতের ছোট-বড় জাত কি আবার? সঙ্গীত আদ্যোপান্ত ভাবের বিষয়- এটা এর প্রথম শর্ত, দ্বিতীয় শর্ত- একে আত্মস্থ করা স্ব-বশে রাখার জন্য সাধনা চাই! সব রকম গানের বেলায় খাটে! ৫০ বছর খেয়াল গাইলে, ২০০ রাগ রাগিনী কণ্ঠস্থ করে ফেললেও কারো একটি প্রাণস্পর্শী শ্যামাসঙ্গীত গাইবার যোগ্যতা জন্মে যাবে না! তাতে সুরের সাথে সাথে ভাব ও বাণীর সাধনাও লাগে! এ বড় বাজ্ঞেয়কারী কাজ! তেমনি লালন গাওয়াও যেন আজকাল পান্তাভাত?

 

মার্গসঙ্গীতে ব্যাকরণের শুদ্ধতা প্রয়োজন, ব্যাকরণ দেখানোর জন্য নয়, ব্যাকরণ-সর্বস্ব হবার জন্য নয়; ব্যাকরণের ভেতর দিয়েই রাগের ছবিটিকে ভাবরঞ্জিত করে ফোটানোর জন্য! আজকাল যারা ভাব-ব্যঞ্জনা বাদ দিয়ে কেবল ব্যাকরণের অলঙ্কারটির উপস্থাপনটিকেই শাস্ত্রীয়-সঙ্গীত বলে জাহির করে বেড়াতে সদা তৎপর, যারা রাগের ভাব-শরীরটি বাদ দিয়ে ব্যাকরণ-কঙ্কালটিই কেবল আরাধ্য করেন- তাদের মনে হচ্ছে বাকী সব গান ‘Light-Music’! দুর্ভাগ্য-বশতঃ আর্য্যাবর্তের সঙ্গীতের বিবর্তনের রূপরেখা এদের কাছে স্বচ্ছ নয়! (বস্তুত সঙ্গীতের concept-টাই অপক্ক দেখায়!) কত লোকজ-সঙ্গীতের স্বরের-কাঠামোটি কালে কালে শুদ্ধ রাগ-রাগিনী হয়ে উঠে এল তারা দেখেন না তা! মনে প্রশ্নও জাগে না- ‘ব্যাকরণ আগে এলো, নাকি সঙ্গীত?’

 

সঙ্গীতটিই যদি আদি হয়, তবে সকল সঙ্গীতের ভেতর ব্যকরণ খোঁজাটা তো মূর্খতা! সকল সঙ্গীত তো ব্যাকরণের আলোতে বিচার্য্য হবে না!

 

 

সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

শিল্প ও স্বাধীনতা

 

স্বাধীনতা মানে উচ্ছৃঙ্খলতা নয়, তেমনি শৃঙ্খলা মানেও পায়ের শৃঙ্খল নয়। যথেচ্ছাচার যেমন কোন আচার নয়, তেমনি আচারে হস্ত-পদ বদ্ধ করে রাখাও সম্ভাব্য অনাচার আনয়নের ঔপচারিকতা মাত্র! বিরিয়ানিকে বিরিয়ানির স্বাদটা বাঁচিয়ে রেখে নিজের কায়দায় রাঁধলে সেটা স্বাধীনতা ও শৃঙ্খলা দুটোই রক্ষা করে, কিন্তু বিরিয়ানি রাঁধতে গিয়ে ওটাকে প্রায়-খিচুড়ি বানিয়ে ফেললে- তাকে স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে চালিয়ে দেয়া তাত্ব্বিকভাবে অন্তত সম্ভব নয়। তেমনি বিরিয়ানি যদি কেবল ভাতের তলায় মাংস বিছিয়ে দেবার রন্ধন কায়দা হয় তাহলে তা দিয়ে রাঁধুনীর মুখ-রক্ষার কাজও ঠিকমত রক্ষা হয় না! বক্তব্যের উদ্দেশ্য হল- বিরিয়ানিকে নিয়ে যত গবেষণাই হোক- পাতে তুললে, মুখে পুরলে যেন মনে হয়- হ্যাঁ এটাই বিরিয়ানি- হায়দ্রাবাদী হোক, কি করাচীর, কি কোলকেতার- দিস ইস ইট! এটা বোঝানো।

 

আমাদের কেবল জানতে হবে মসলাটি কি? মসলাই তো আসল জিনিস দাদা!

 

ধরুন রবি ঠাকুরের গান গাইছেন, স্বরলিপির এক মিলিমিটার এদিক ওদিক হয়ে গেলেই নরকে পতিত হবার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গাইতে হচ্ছে! ধরুন বিরিয়ানির ভাত সেদ্ধ হচ্ছে ঠিকটাক, মাংস সেদ্ধ হল ঠিকঠাক, সব হচ্ছে, মসলাটা ঠিক হচ্ছে না শুধু, সুগন্ধ আসছে না - এই মসলাটি হল ভাব! ভাব ব্যতিরেকে সঙ্গীত- কোন সঙ্গীতই তো নয়! আবার ধরুন সুগন্ধ হচ্ছে না দেখে বিরিয়ানির ওপর ম্যাগি-মসলা ছিটিয়ে দেয়াও তো ভাল বুদ্ধি নয়! রবীন্দ্রনাথের গানে রবীন্দ্রভাবনার নিজস্ব মসলা আছে। তাতে গজল-ঠুংরী-পপ-ব্লু’সের মসলা ছিটাতে হয় না! আবার রামপ্রসাদী গাইতে গিয়ে ওটা রবীন্দ্রসঙ্গীত বানিয়ে দিলেও বদখত লাগে! প্রতিটি সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এরকম একটা পরিমিত, মার্জিত তথা ভাবের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন লালিত্যপূর্ণ বোধ জাগিয়ে রাখা উচিত। নইলে গাইলেই হয়ত গান হবে- কিন্তু তাতে প্রাণ থাকবে না! মসলা ছাড়াও হয়ত দেখতে বিরিয়ানি হয়ে যাবে কিছু একটা, খেতে গেলে অমন মনে হবে না!

 

আমরা সবাই গাইতেই পারি। গাইবার স্বাধীনতা আমার আছে। গাইতে গেলেই আমাকে আগেই একজন সঙ্গীত-তত্ত্ব-বিশারদ হয়ে উঠতে হবে কেন? গান মানব-মনের একটা আদিম, অতি স্বচ্ছ্‌ল, সাবলীল অভিব্যক্তি। একটা গান গাইবার অধিকার শ্রীকান্ত আচার্য্যের যেমন আছে, একজন রিকশাচালকেরও ততটুকু আছে। এই অধিকারের প্রসঙ্গে আলোচনা কিন্তু করছি না। তাত্ত্বিক স্তরের আলোচনা যে সকলের জন্য নয় এই কথাটা বোঝার জন্য আরেকটি তত্ত্ব-বিশ্লেষণের দরকার হবে না আশা করি। ক্ষিদে পেলে খাই আমরা, খাবারের অধিকারী হবার জন্য রান্না জানা জরুরী? এটা কোন যুক্তি?

 

এক গাদা রাগ-রাগিনী শুদ্ধভাবে না জানলে গাইবার উপযুক্ত হলাম না! অমুক বাবুর গানের বইয়ের স্বরলিপির পান থেকে একটু চুন খসাচ্ছি বলে আমি জাতিচ্যুত হয়ে যাচ্ছি! অমুক খেয়াল গাইতে গিয়ে ওটা টপ্পা হয়ে গেল! ধ্রূপদ গাইছেন মনে হচ্ছে আগ্রার খেয়াল! হেন তেন শতপ্রকারেণ- বাতচিত বিতণ্ডার একটা মানসম্মত সমাধান খুঁজতে গেলে সঙ্গীতের গভীরতা, রসবোধ, সাধনের প্রণালী প্রভৃতি নিয়ে বিস্তৃত অধ্যয়ণ প্রয়োজন। নইলে ‘অন্ধের হস্তিদর্শন’ জাতীয় যত্তসব কাণ্ড হতেই থাকবে আর তা নিয়ে চলবে ঠোকাঠুকি অনন্তকাল। সর্বসাধারণের জন্য এইসব শিক্ষা স্ববিস্তারে প্রয়োজন তা নয়- কিন্তু তাঁদের মধ্যেও উচ্চতম আদর্শটি অন্তত প্রসারিত হওয়া উচিত। সকল লোকে সাধু হয় না, কিন্তু সাধুর চরণধুলি তো নিতে যায় প্রায় সকলে! আমরা যে আদর্শই মানি না কেন, অন্তত মহত্তম আদর্শটি যেন যোগ্য সম্মান লাভ করে তার জন্য সেই আদর্শের পরিচিতিও তো চাই!

 

আমার কথার সারমর্ম হল-

 

আমি স্বাধীনতার বিপক্ষে নই। মানুষ স্বভাবে স্বাধীনতাপ্রিয়, জীবনের অন্যতম লক্ষণ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, কিন্তু ‘স্বাধীনতা’ কেবল একটা শব্দ মাত্র নয়! দানবের কাছে স্বাধীনতা উন্মত্ততা! আত্মনিয়ন্ত্রনহীনতা কখনো শুভ-অর্থে স্বাধীনতা নয়। শিল্প প্রসঙ্গে বরাবরই এই কথা উঠে এসেছে যে -শিল্পী স্বাধীনতা সৃষ্টি করেন। এটা তো সত্যি বটেই। তার আগেই বুঝতে হবে আমি আদৌ শিল্পী-পদবাচ্য কি না! অপরের শিল্পের ওপর হাত চালানোর মেধাকে শিল্প বলে এমন কথা আমার জানা নেই।

শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পৃথিবী ডুবে যায়

 

বলার মত এতটুকু শান্তি নেই চরাচরে আমার,

দূরদূরান্তপানে অনিমিখ আঁখি খুলে, অহর্নিশ দুর্নিবার-

পন্নগের বিষ ধমনী শিরায় ধরে, পথ ঘাট খেয়াবাট ভুলে,

আমি কোটি কোটি আলোকবর্ষ এই অন্ধকারে! এই অন্ধকার,

এমন পূর্ণতামসগ্রাস, আমার অস্তিত্বের সংজ্ঞা গিলে খায়,

একটি ভ্রমাত্মক স্বপ্নের মত, সূর্য্য ডোবে না আর, পৃথিবী ডুবে যায়!

সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পক্ষীর জীবন দর্শন

যদিও বা তার ভেঙে যায় খাঁচা, আকাশে উড়েছে ডানা,
অক্ষয় পথ, অবারিত দিনরাত্রি, বিহগনয়নে বিধুর সুরের হানা,
কেঁপে কেঁপে ওঠে, তারে তারে বাজে, তর তর নামে ধারা,
ঝাপসা কেমন- ঝর ঝর ঝরে, সরে যায় গ্রহ তারা,
দিগ্বলয়ের লয় ধীর হলে, লাখ রাগ কোটি রাগিনী
অতলান্তরে ঝঞ্ঝার বেগে হরদম, ক্রন্দসী, হতভাগিনী-
কোন দূরাশার হাতে হাত রেখে, তানে তান গেঁথে গড়া মালা,
গলায় তুলেও মেটে না মোটেও, মোটেও মেটে না জ্বালা


তাই 


এক আকাশ ছেড়ে অপর আকাশে,

বদলে বদলে খাঁচা,
ভেবেছ পক্ষী এই তো জীবন
এরই নাম যেন বাঁচা!

শনিবার, ৮ আগস্ট, ২০২০

সম্প্রসারণ ও শিক্ষা

একটি তত্ত্ব, কি একটি মতবাদ, কি একটি শিল্পভাব যতই উচ্চ হোক, যতই নিগুঢ় হোক- যখন আমরা চাই এটি সর্বজনীন হোক, যখন আমরা চাই এটি সবার মধ্যে বিকশিত হোক- তখন আমরা যেন এটা মেনে নিতে উদার থাকি যে- সর্বসাধারণে সম্প্রসারণ মাত্রেই সংমিশ্রণের দ্বার অবারিত করা। আজ যে গানটি আমি গাইলাম- আমি যদি চাই এই গান গোটা পাড়া গাইবে- তবে আমার বোঝা উচিত গোটা পাড়া আমার কণ্ঠের অনুকরণ করে গাইবে না, কারো নিজস্বতা আসবে, কারো অক্ষমতার দরুন তাতে বিকৃতি ঘটবে, কেউ ইচ্ছে করেই হয়ত বিকৃত করবে- ইত্যাদি ইত্যাদি ব্যাপার তাতে অবধারিত। তবে কোনটি রূপান্তর আর কোনটি রূপের আত্যন্তিক বিপর্যয় এটা কে ঠিক করে দেবে এ নিয়েই দ্বন্দ্ব চলছে!


একদল আদিবাসীকে দেখেছিলাম খোল-করতাল নিয়ে যীশুর নামগান করতে। ধর্মান্তরিত হবার আগে তাঁদের পূর্বপুরুষ খোল-করতাল নিয়ে কৃষ্ণনাম গাইত। যীশুর ধর্ম এসে কৃষ্ণের নামটি তুলে নিলেও খোল-করতালটি তুলে নিতে পারেনি। যারা যীশুর নাম প্রচারে নেমেছিলেন- তাঁদের এটা মানতেই হবে যে যীশুর নামটার প্রচারই উদ্দেশ্য, খোল-করতাল দূরীকরণ নয়। যারা তত্ত্ব সম্প্রসারণের সাথে সাথে প্রাগ-ভাবটিও বিনষ্ট করতে চাইবেন, তাঁদের পথে শতেক বাধা। এখানে অবশ্য এ কথারও স্পষ্টীকরণ দরকার- প্রাগ-ভাবটি সর্বৈব অর্থে সঠিক ছিল কি? যে মসুর ডাল রান্না জানে, তাকে বিউলির ডাল রান্না করতে গেলে কি মসুর ডাল রান্না ভুলে যেতে হবে?

আবার একটা সাধারণ বিপরীত যুক্তি দিই। যেমন গান শেখাতে গিয়ে দেখেছি ছাত্র হারমোনিয়াম না টিপলে নিজের ‘সা’টিও গাইতে পারে না! আমি বলি ‘বাছা এ তো আমাদের দেশী যন্ত্র নয়, যখন হারমোনিয়াম ছিল না, তখন লোকে গান কি করে করত? তারা সরগম কি করত না?’ প্রশ্ন শুনে ছাত্র মাথা চুলকায়। তবে এতকাল কি করে এলাম? একটা যন্ত্র আমার কন্ঠ পরিচালনা করছে, অথচ উচিত ছিল আমিই যন্ত্রটিকে আমার আজ্ঞাধীন করব! তা-তো হল না। এই হল উদাহরণস্বরূপ আমার ছাত্রের প্রাগভাব। এখন তাকে শুদ্ধরূপে স্বরগ্রাম শিক্ষা দিতে গেলে আমাকে প্রথমেই এই ধারণা সৃষ্টি করে দিতে হচ্ছে যে – তোমার পূর্ব প্রক্রিয়াটি একটি প্রমাদ! তখন সকলের পক্ষে একটি নবারম্ভ দুষ্কর হয়ে ওঠে। এবং প্রত্যেকে এরকম আরম্ভের পক্ষেও নেই। অর্থাৎ যে মসুর ডালটিও ভুল-ভাল রাঁধে, তাকে বিউলির ডাল রাঁধতে দেয়ার আগে, মসুর ডালটি ঠিকঠাক শেখালে তো ভাল! মন্দ কি? কিন্তু ভুলটিতেই যখন আমরা এতটা অভ্যস্ত, এতটা আশ্বস্ত- তখন নতুন করে আরেকটি ‘শুদ্ধ’ হাজির করলে সেটাই বরং বিরক্তিকর লাগে!

অতএব আমরা চেয়েছি, সকলে সু-শিক্ষার্থী না হলেও সঙ্গীতের উচ্চরূপ সকলের কাছে পৌঁছাক। তারপর অধিকারীভেদে যে যেমন পারবে সে তেমন প্রচেষ্টায় কিছু শিখবে। অনেকে শিক্ষার মাধ্যমটিকে সহজতর করার জন্য নতুন নতুন রূপরেখা আবিষ্কার করতে কৃতসংকল্প হয়েছেন। কিন্তু সহজে লভ্য হলেই অনেক জিনিসের গুণমানে লঘুত্ব যে আসে- এ কথা প্রকাশ্যে ক’জনে স্বীকার করে? সর্বজনমধ্যে সম্প্রসারণের বড় সংকটটি এই যে- গুরুতত্ত্বও ক্রমে লঘুতত্ত্ব হয়ে আসে, এবং সেই লঘুত্ত্বের গুরুভাব দর্শানোর জন্য তারপর আর কয়েকটি নতুন তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটিয়ে একটি হজবরল বিষয় বানিয়ে নিতে হয়। সঙ্গীতকে কেবল একটি রূপক হিসেবেই ধরে দেখুন। সঙ্গীতের জায়গায় সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্ম এসবও বসান- দেখবেন সব এক তরীতেই উঠে গেছে ডুববে বলে।

কেউ বিরিয়ানি রান্নার চেষ্টা করে দেখল, তারপর ওটা খিচুড়িতুল্য কিছু হল- এবার একে একটা আলাদা নামকরণ করে লোকের পাতে ও জাতে তোলার দায় পাচকের, এবং স্বাধীনতা ও সর্বজনীনতার দোহাই দিয়ে এ কার্য্যও সম্ভবপর হচ্ছে। যারা শিল্প ও মতবাদের স্বাধীনতা ও সর্বজনীনতা কামনা করেন- তাদের সিংহভাগকে দেখেছি- নিজের অপারগতাটিকে বৈধতা দেবার প্রয়াস করে যাচ্ছেন। যখন আমার আদর্শটি উচ্চ, অথচ আমি তাতে পৌঁছুতে পারছি না, অতএব একে টেনে হেঁচড়ে নিচে নামিয়ে এই দাবী করা- একটি নতুন আদর্শ আমরা তৈরি করলাম। নবকলেবরের নব নাম দেয়া যেতেই পারে, তবে অজ্ঞ পাচক খিচুড়ি রেঁধে বিরিয়ানি বলে খাওয়াতে গেলে সে খাবার সবার মুখে হয়ত রোচবে না! কিন্তু তাও লোকে খাবে। লোকের খাদ্য আগে চাই, বিশ্লেষণে কিছু যায় আসে না। আপামর জনগণ গান শুনবে- গানের ব্যকরণ জানা তাদের কাজ নয়! কিন্তু তারাই ভাল-মন্দের নির্ণায়ক হয়ে যদি ওঠেন?

সুন্দর মাত্রেই সর্বজনীন, সুন্দরের চর্চার অধিকার সকলের আছে- এই কথাতে আমার কোন আপত্তিই নেই, কিন্তু অধিকার থাকলেই সকলে চর্চার ‘অধিকারী’ হন না। ‘অধিকারী’ হবারও একটি সাধন-প্রণালী আছে। অনধিকারীর হাতে উত্তম কিছু গেলেও অবশেষে ‘শিব গড়তে বানর গড়া’র মতন কিছু হয়ে যায়। এতে অনধিকারীকে আমি দোষ দিচ্ছি না, তার শিল্পচেতনাকেও দিচ্ছি না, তার সমর্থকদেরও দিচ্ছি না, আমরা সবাই উচ্চ তত্ত্বের রসজ্ঞ হব না, তাই এমনটাই বরাবর হয়। সাঁওতালী গানে যে মাদলের তালে নাচে, সে দ্রুত-খেয়ালের তবলার ঠেকাতেও নড়বে- তার কাছে শরীরে দুলুনি লাগাটাই মূখ্য। এ কথা অনস্বীকার্য্য যে -আমরা প্রায় সকলেই বিষয়ের মূল্য নির্ধারণ করি আমার ওপর তার প্রভাব বিচার করেই, আমাদের ভাল লাগাটাই যেন শিল্পের সার্থকতা- এরকম একটা কথাও আমরা প্রায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছি। অর্থাৎ ‘লোকে যারে বড় বলে সেই বড় হয়’! কিন্তু আজকের সমাজ এই কথার বিপরীত মেরুতে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে না? অথবা চিরকালই ‘লোক’ কি খুব সমঝদার ছিল?

একটা কিছু লোকের মধ্যে ছড়িয়ে দেব ভাবলেই সেই একটা কিছুর খুব উন্নতি হয় না- যদি একটা কিছু ছড়িয়ে দেবার জন্য একটা সুন্দর পরিকাঠামো না তৈরি হয় আগে।

শুক্রবার, ৭ আগস্ট, ২০২০

আত্ম-স্বাধীনতা

কতটা আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা পেলে 

বলা যায় আমরা বর্বর!

কতটা সকল প্রচলিত ঋজুতার

বিপরীতে বেঁকে গেলে 

বলতে পারি আমরা আধুনিক!

কতটা প্রথাহীন হব বলে

পুরনো শেকড় উপড়ে ফেলা যায়!

কতটা অস্বাভাবিকতাকে অভিনবত্ব বলে

প্রতিদিন প্রতিনিয়ত প্রবিষ্ট করা অন্তরাত্মায়—

এভাবে আর কতটা দিন...

বৃহস্পতিবার, ৬ আগস্ট, ২০২০

বায়স-তাড়ন

প্রাতঃকালে টিনের চালে নিদ্রাভঙ্গে বায়সবৃন্দ
মধুর মন্ত্রে ডাকিছে কাতরে অরুণ-বরুণ-অগ্নি-ইন্দ্র!
নখর-আঁচড়ে টিনে কড়কড়ে –
শব্দ, পশিল কর্ণকূহরে,
তাহাতে সুপ্তি ত্যাজিয়া পরাণ বিস্বাদে গেল ভরি,
কি বা পাপফলে এমন সকালে নিত্য ঘুমাতে নারি!

এতৎ ভাবিয়া ঋষি শ্রীঅণ্ড, ক্রোধারক্তিম করিয়া গণ্ড,
খিড়কি খুলিয়া আসিলেন প্রভু, ছোড়েন কতক ঢিল!
রসরাজ করে এই কারসাজি, সহ্যের সীমা পার হল আজি,
ব্যাটারে এ বেলা দণ্ড না দিলে, টেকা হবে মুশকিল!
খিড়কি খুলিয়া আসিলেন প্রভু, ছোড়েন কতক ঢিল!


_____________________________

রসরাজ-অণ্ডবাক সংঘর্ষ নিয়ে আমাদের যে ইতিহাস গবেষণা, তাতে নতুন আলোক প্রদান করেছে এই অধুনাপ্রাপ্ত কাব্যটি। 'বজ্রযানী বৈষ্ণব পদাবলী'র একটি অপ্রকাশিত অংশে এটি পাওয়া গেছে।

রাম-কথা

এবারে অযোধ্যা যাব, অযুত নিন্দা মাথায় তুলে,
আমায় তোরা ভাগ করে নে চাড্ডি কিম্বা মাকুর কূলে!

রাম-পাঁঠাদের রামের নামে রাম-প্যাঁদানি লাগছে গায়ে,
আমায় তারা সইছে না আর, ব্যাথায় মরি গুঁতোর ঘায়ে।

বাদলা দিনের রাম-ধনুটাও, বলছে এরা ভিন্ন দেশী,
যত আ-রাম প্রিয় হা-রাম-জাদায় কত কথায় রেষারেষি—

করছে এখন কর্ম ফেলে নিত্য নতুন ফন্দি এঁটে,
সহজ কথাও মন্দ লাগে, তাও তারা দিচ্ছে ঘেঁটে!

মায়া-বীণ

উতল শ্রাবণধারা,
নয়ন নিদ্রাহারা,
নিরালা নিশির মাঝে
নীরবে প্লাবিত ধরা—
ঝরোঝরো সুধারসে,
অবিরল নিরলসে
কি নিনাদে বাজে যেন,
কার বীণে সুরধারা!

এমনি বরষা যাবে,
তেমনি বরষ যায়,
এমনি বিষাদে ভরে,
হরষে কে গান গায়;
তারে যেন খুঁজে মরি,
ডেকে গো না পাই সাড়া!
কি নিনাদে বাজে তার
মায়া বীণে সুরধারা!

মঙ্গলবার, ৪ আগস্ট, ২০২০

সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স

ফালতু কথায় চোখ জ্বলে ভাই,
করেই দিলাম আনফলো!
সোশ্যাল ডিস্টেন্স হোক এভাবে,
অটুট থাকুক হাই-হ্যালো!

দশের দোষী নন্দ-ঘোষের,
নিন্দা তুমি খুব কর,
আমি কি আর বুঝব এতো?
জ্ঞানে-গুণে নই বড়!

তোমার আবার শ্যেণ-দৃষ্টি,
আমি শনির দয়ায় দিনকানা!
তুমি বিদ্যাবলে ঘোরকর্মা,
আমি অলস অচল কারখানা!

তোমার সাথে রইবে তফাৎ
উভয়পক্ষে সেই ভাল,
সোশ্যাল ডিস্টেন্স হোক এভাবে,
অটুট থাকুক হাই-হ্যালো!

বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০২০

স্থবিরতা

কেমন এক স্থবিরতা পেয়ে বসেছে।

জানালার পাশে ভরা সন্ধ্যায়, আঁধারে যেমন

নেতিয়ে পড়েছে এক জোড়া জবা ফুল,

আমিও… আমাকে তেমন…

কি যেন অরতি-অরিষ্ট আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে

বয়ে যায়, কি যেন বিরহ-সমাকুল-

গানের সারেঙ্গীর তার ছিঁড়ে-

বড় অবসন্ন, অরুন্তুদ-

বড় বিচিত্র, অদ্ভুত-

এক স্তব্ধতা আমাকে ময়ালের মত

মুখে পুরে নিল!

 

চোখের পলক ফেলতেও পাহাড়-কাটা শ্রম লাগে,

অন্তরের অর্গল খুলি- সে শক্তিটুকু নেই,

বিষাদের বিষিত সব;

এমন এক অনভিব্যক্ত, অলঙ্ঘ্য বিষ্টম্ভ বিমর্ষতা-

কি এক বিমিশ্র অনুভব

আমাকে পথে পথে হেঁচরে নিয়ে যায়;

নিরুদ্দিষ্ট যুগযুগান্ত, নিরুদ্বেগে অচঞ্চল,

অথচ ভেতরে আমি ভীত ভুজঙ্গের মত-

উদগ্রীব, উদগ্র, সচল।

ত্রাসিত, হৃত-বল-

আমি আত্মসঞ্জাত কোন অরিঘ্নে আস্থাহীন হয়ে

আমাকে নিয়ে একলা পড়ে রই!

 

আমাকে এমন এক ক্রুর-

অতিক্রুর আড়ষ্টতা আড়াআড়ি ছেদ করে গেছে!

 

 

 


মঙ্গলবার, ২১ জুলাই, ২০২০

কি জ্বালায় জ্বলি গো তারা

কি জ্বালায় জ্বলি গো তারা, ভবদারা কি বা রঙ্গে!

এ অঙ্গে অঙ্গার করি অনঙ্গ-তরঙ্গ-ভঙ্গে-

ক্ষান্তি দিয়ে শ্রান্তি পাব?

 

মায়ার কুরঙ্গ-পিছে, ভ্রমিয়ে ক্লান্ত মিছে,

কপট কুসঙ্গ-সুখ-আসঙ্গ টানিল নীচে।

ঠেকেছি গো রসাতলে, কৃতান্ত করতলে,

এভাবে কি চলে যাব?

 

কৃপাময়ী কৃপাণ ধরি, কিঙ্করে করুণা করি,

অভয়দায়িনী হও ভীতজনে ক্ষেমকরী।

আবদ্ধ সংসারপঙ্কে, পঙ্ককশোভিত অঙ্কে

কবে গো লুটিয়ে রব?

 

 

 

 


রবিবার, ১৯ জুলাই, ২০২০

আষাঢ়-কেষ্ট-ক্লেশ

আমায় দেখে তোমার বাড়ির হাঁসগুলো সব হাসে

প্যাঁকপ্যাঁকিয়ে পুকুরধারে, ভেঁচি কাটে, পুচ্ছ নাড়ে,

তেড়ে গেলেই অমনি তারা পুকুর জলে ভাসে!

তোমার বাড়ির হাঁসগুলো সব হাসে।

 

তোমার বাড়ির সামনে আসি, রাস্তা জুড়ে কাদা,

আষাঢ় দিনে, ষাঁড়ের মতন একটি মাত্র দাদা,

দেখতে পেলাম আছেন ঘরে, তাকিয়ে আছেন কেমন করে,

জানেন আমি কেষ্ট ঠাকুর, বোনটি যে তার রাধা!

তোমার একটি মাত্র দাদা!

 

চোখের দেখা আর কি দেখি, ফিরে যাবার ক্ষণে

স্যাঁতলা ইটে পা পড়েছে, কি করে কে জানে!

এক আছাড়েই বিধির বিচার টের পেয়েছি বেশ,

আষাড় মাসের কেষ্ট হওয়া – এ যে ভীষণ ক্লেশ!

 

 

 

 

 

 


গ্রাস

  বুঝি আর আমাকে দিয়ে হবে না কিছুই। অসময়ে, অনাহুত, অতি অনভিপ্রেত জানি, সমস্ত বিবাদী উষ্মার অন্তরালে হারিয়ে যাব আমার এ যাবৎ যতনে গড়া সুরের ...