শনিবার, ৪ মার্চ, ২০২৩

'না বুঝে কারে তুমি ভাসালে আঁখিজলে'

 


দত্তপুকুরের নবীন দত্ত। তাহার বাপ কলিকাতায় সরকারি চাকুরী করে। অতটাও বড় চাকুরী নহে যে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে নিজের সহিত কলিকাতায় নিয়া রাখে। তাই নবীনের জীবন কাটিয়াছে দত্তপুকুরেই। পাড়াগাঁয়ে কাহারো বাড়ির কেহ শহুরে হইলে তাহা সমীহ করিবার মতন বিষয় হয়। আর্থিক বন্দোবস্ত ভাল হইলে সেই বাড়ির কদরও বাড়ে বহুগুণে। সেই বাড়ি ও বাড়ির লোকের সমাদর হয় সর্বত্র। এমতাবস্থায় পিতার সরকারি চাকুরীর সুখ্যাতিতে ও ধনপ্রতুলতা হেতু পাড়ায় নবীনের আদর যারপরনাই জুটিত তাহা বলা বাহুল্য হইবে বৈকি। তদুপরি তাহার পরিবার এই গাঁয়ের আদিনিবাসী ভূস্বামীদের মধ্যে একটি। এতদ্ভিন্ন নবীন বহুগুণে গুণধর। দেখিতে কন্দর্প নাকি- গাঁয়ের মেয়েরা বলে। বলিষ্ঠ ও নানাবিধ ক্রীড়াতে সুদক্ষ। আশেপাশের তিন গাঁয়ের সকল সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিতে তাহার অগ্রগণ্য উপস্থিতি অগ্রাহ্য করিবার মতন নহে। তেমনি সে মেট্রিকুলেশনে বিশেষ ভাল ফলাফল দেখাইয়া দত্তপুকুর বিদ্যালয়েও চমক লাগাইয়া দিয়াছে। এইসকল দৃষ্টে পাড়ার লোকের দৃঢ় প্রত্যয় জন্মিয়াছে- এই ছেলে একটি অমূল্য রত্ন। বৈষয়িক উন্নতিতে সে তাহার পিতাকে অচিরে ছাড়াইয়া যাইতে সক্ষম এ বিষয়ে কাহারো দ্বিমত হইতে পারে না। নবীনের পিতা আইএ পাশ করিয়া রেলে কি এক ভাল চাকুরী পাইয়াছিল। নবীনের যাহা গুণ তাহাতে কোন বড় স্টেশনের স্টেশন মাস্টার হইতে আর কি বাকী আছে! ইশকুলের হেডমাস্টার মহাশয় বলেন- 'এই ছেলে ডাক্তারি পড়িয়া ডাক্তার হইবে’। গ্রামের জমিদার দিনু বাঁড়ুজ্জেও নবীনকে চেনেন। তিনি বলিয়াছেন নবীন আরও লেখাপড়া করিয়া সিভিল সার্জন হইয়া দত্তপুকুরের গর্ব হইবে, তাহাতে খরচের টান পড়িলে তিনি ভার লইবেন। তবে এহেন গুণবান তরুণের নিজের কি অভিপ্রায় তাহা কাহারো জানিতে সাধ নাই। মেট্রিকুলেশন পাশ করিয়া নবীন বড় বেপরোয়া হইয়া গিয়াছে, বাড়ির শাসন মানে না- ইহা তাহার মাতার বক্তব্য। পূর্বে সন্ধ্যা নামিবার আগেই ঘরে আসিয়া পড়িতে বসিত। এখন সে রাত অবধি কোথায় কোথায় ঘুরিয়া বেড়ায়। জিজ্ঞাসা করিলে কহে- সে কোন গানের আসরে, কি বাউলের আখড়ায়, কি কোন মন্দিরে বসিয়া গান শুনিতেছিল। প্রথম প্রথম তাহার জননী ইহাতে বাধা প্রয়োগ না করিলেও, ইদানীং বাধা না দিলে বুঝি ছেলের অধঃপতন হয়! ভদ্র ঘরের সন্তান রাতবিরেতে বাহিরে ঘুরিলে লোকে দুটি কুকথা বলিতেই পারে পাছে, তাহাই ভয়। অমন দু’চারটি বাজে কথা ঠারেঠোরে কানে আসিয়াছেও বটে। নবীন কুসঙ্গে পড়িয়া না হারাইয়া যায় এইভাবে- নবীনের মা তাহা পত্র মারফত স্বামীর কাছে লিখিয়াও পাঠাইলেন। পূজার ছুটিতে নবীনের পিতা বাড়ি আসিলে তিনি স্বস্তি পান। 


দত্তপুকুর থানার বড় বাবু অমিয় রঞ্জন মুখোপাধ্যায়। বছর পাঁচেক আগে বীরভূম হইতে বদলি হইয়া আসিয়াছেন এইখানে। তাঁহার মূল নিবাস বাঁকুড়া। অকালে বিপত্নীক হইয়াছেন। একটি মাত্র কন্যা দত্তপুকুর ইশকুলে পড়িতেছে। সপ্তম শ্রেণীতে। তাহার ভাষায় রাঢ়বঙ্গীয় টান আসিয়া পরে। ইহা লইয়া সহপাঠিনীগণ ভেঙচি কাটে। তাহাতে সে অপমানিত বোধ করিয়া বিড়ম্বনাকে শতগুণে বাড়াইয়া তুলিয়াছে। ইশকুল-ময় ক্রমে রাঢ় ভাষা লইয়া প্রহসন রটিয়া গেল বহুবিধ। কাব্যচর্চায় নিপুণ ও কথায় কথায় সুরে সুরে ছড়া কাটিতে উস্তাদ নবীন সেই ভাষা ও ভাষা-সঞ্চারিণী কিশোরীকে লইয়া দু-একটি এমনতর ছড়া বাঁধিল যে ঐসব সকলের মুখে মুখে ছড়াইয়া পড়িতে দেরী করিল না। এতাদৃশ লাঞ্ছনা কিশোরীকে মর্মাহত করিয়াছে দারুণ ভাবে। ইশকুলের সর্বজনপ্রিয় ছাত্র, উঁচু ক্লাশের দাদার মতন, কত সম্ভ্রমের চোখে দেখে- সেও কিনা ইয়ার্কি করিতে ছাড়িল না বেচারিকে লইয়া! হেডমাস্টার মহাশয়কে নালিশ দিয়াও লাভ নাই। তিনি নবীন বলিতে অজ্ঞান! অভিমানিনী রোগের ভান ধরিয়া ইশকুল আসিল না দু’সপ্তাহ। হঠাৎ তামাশার কেন্দ্রটিকে অদৃশ্য হইতে দেখিয়া নবীন উদ্বিগ্ন হইল যৎকিঞ্চিৎ। এখন কাহাকে লইয়া নবীনতম উপদ্রব সৃষ্টি করিবে তবে? অমিয় মুখুজ্জের বাড়ির কাছে তাহার কন্যার এক সহপাঠিনীর বাস। তাহাকেই নবীন রাঢ়-ভাষায় ব্যঙ্গ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল ‘কি রে, উনি ইশকুলে আসিবেক লাই?’ সহপাঠিনী কহিল ‘সুলগ্নার অসুখ হইয়াছে। কোলকাতা যাইবে ডাক্তার দেখাইতে।’ অভিমানিনীর নাম সুলগ্না। তিনি এই কথকতার নায়িকাও বটে। 


সুলগ্নার কি অসুখ হইয়াছিল তাহা জানিতে পারা যায় নাই। মাস দুই-তিন পর সে ইশকুলে আসিতে শুরু করিয়াছে। তাহার বিশ্বস্ত সহচরীদের কেহ রটাইয়াছে- ‘সুলগ্নার কিছুই হয় নাই। ইশকুলে ছোকরার দল উৎপাত করিত, তাই সে ইশকুলে আসিবে না বলিয়া বাড়িতে বসিয়া ছিল গোঁ ধরিয়া। পরে তাহার বাপ বহু বুঝাইয়া, হেডমাস্টারের কাছে নালিশ জানাইয়া- তাহাকে ইশকুলে আসিতে আস্বস্ত করিয়াছে’। এমন কথায় উপদ্রবপ্রিয় ছেলেমেয়ের দল কিছুটা দমিল বটে। তবে এই কথা নবীনের কানে যাইতেই যুগপৎ ভবিষ্যৎ মানহানির আশু-শঙ্কা ও বর্তমানে লব্ধ অপমান-বোধ তাহার প্রায়-বিগত-কৈশোর-চিত্তটিকে বিকটাকারে আহত করিল। রটনার সত্য মিথ্যা যাহাই হউক- নবীন আর এই বালিকার মুখদর্শন করিবে না, তাহাকে লইয়া ছড়া বাঁধিবার তো প্রশ্নই নাই। অভিমান ক্ষোভে রূপান্তরিত হইতে অধিক কালক্ষেপণ করিল না। যে বালিকার হাসিতে নবীনের কভু কোন ভাবান্তর হয় নাই, যে-ই হাসি এক পলক দেখিতে পাইলে তাহার কতিপয় সহপাঠীদিগের হৃদয়ে নিমেষক্ষণে বসন্ত সমাগত হয়, সেই হাসি দেখিলে অদ্য নবীন ভাবে- বুঝি তাহাকে জব্দ করিয়া বালিকার ভীষণ হর্ষপ্রকাশ পাইতেছে হাসির ছটায়! ইহাতে উদ্বেলিত না হইয়া সে পারে, কিন্তু এখন ইহাকে উপেক্ষা করিবার শক্তি যেন তাহার নাই! রঙ্গ করিবার নিমিত্ত সে সুলগ্নার ছড়া কাটিত, তাহাকে মনে বাঁধিয়া রাখিতেও নহে, উত্যক্ত করিতেও নহে, অহর্নিশ সুলগ্নার স্মরণ-মনন করিতেও নহে! এইসকল নিরর্থক কার্য করিয়া দিনাতিবাহিত করিবার সময় নবীনের বহু বন্ধুরও রহিয়াছে সে তাহা বিলক্ষণ জানে। কিন্তু সে তাহাদের মতন যে একেবারেই নহে। সে কেবলমাত্র ইয়ার্কি করিত। এই অহংকারী বালিকা তাহা বুঝিল না! উপরন্তু তাহার পিতাকে দিয়া ইশকুলে নালিশ জানাইয়া নবীনের নাক কাটিল! ইহা সত্য ঘটনা কি রটনা- যাহাই হউক নবীন সংশয়াচ্ছন্ন না রহিয়া বরং হৃদয়ে ইহাই নিশ্চিত করিল যে রটনার কিয়দংশ হইলেও যে ঘটনা তাহা তো লোকপ্রবাদরূপেই সর্বলোকে বিদিত। সে আজ হইতে এই বালিকাকে ঘৃণা করিবে, উপেক্ষা করিবে অন্তর হইতে যথাশক্তি দিয়া! কেবল মাত্র উপেক্ষা করিলে এই গল্প হয়ত এইখানে থামিবে। কিন্তু সে যে এক বিচিত্র ঘৃণা করিতে শুরু করিল বালিকাকে। সেই ঘৃণা কেহ শত্রুকে করে না। সেই ঘৃণার কি অর্থ হয়ত তাহা কিশোর-মনই জানে। হয়ত যাহাকে সে ঘৃণা ভাবিতেছে তাহা ঘৃণাই নহে, তাহা অন্য কোন অনুভূতির নামান্তর যাহার কোন সঠিক নামকরণ বাংলা ভাষায় হইয়া ওঠে নাই আজ অবধি।


ঘৃণার পাত্রটি যে কদাচিৎ প্রেমের পাত্রের ন্যায় সর্বদা হৃদয়ে বিঁধিয়া থাকিতে পারে সে ধারণা ক’জন প্রাপ্তমনস্ক ব্যক্তিই বা রাখে? যাহাকে লোকে ভালবাসে তাহাকে লোকে মনে রাখিতে চাহে সদা, কিন্তু যাহাকে ঘৃণা করিয়া সে থাকিতে চায়- তাহা চোখের বালির মতন ভেতরে ঠাঁই লয়। রগড়াইলে আরও রগড়াইবার কষ্ট সাধিতে হয় কেবল। বালি আর সরিতে চাহে না। নবীনের ঐ দুর্দশা হইয়াছে। সে সুলগ্নার মুখ দেখিবে না, কেন না সে দেখিতে কুরূপা (যদিও অন্তর হইতে নবীন এই মিথ্যা কহিতে পারে না), রাঢ় বাংলার ন্যায় বিশ্রী বাংলা হইতে পারে না দ্বিতীয়টি- কেন না তাহা সুলগ্নার ভাষা, পুলিশের চাকুরীর মত জঘন্য চাকুরী হয় না- কেন না সুলগ্নার পিতা পুলিশের বড়বাবু! এবম্বিধ প্রকারে যাহা কিছু সুলগ্না-সম্পৃক্ত তাহার ন্যায় দূষিত কিছু ত্রিসংসারে যে নাই তাহা জোর গলায় বলিতে নবীনের জিহ্বা আটকায় না। নবীনের এই প্রকার আচরণে তাহার কিছু বন্ধু অতিশয় প্রসন্ন বটে- যাহারা ভবিষ্যতে সুলগ্নার সহিত সুলগ্নে গাঁটছড়া বাঁধিবে ভাবিয়া স্বপ্নে বিভোর হইয়া থাকে, বিশেষত তাহারা। সম্মুখে সুলগ্নার নিন্দা তাহাদের ভাল না লাগিলেও নবীনের এই সুলগ্না-বিমুখতা তাহাদের নিশ্চিন্তে রাখে এই বিবেচনায় যে- নবীন যদি কখনো সত্যই সুলগ্নার পাণিগ্রাহী হয়- তাহা হইলে সুলগ্নার পিতাও তাহাকে জামাতা করিতে দ্বিধান্বিত হইবেন না। নবীনের সেই সকল চিন্তাপীড়িত সজ্জন বন্ধুগণ নিত্যনতুন উপায় আবিষ্কার করিতে থাকে- যাহাদের সহায়ে নবীনকে সুলগ্না হইতে অধিকতর দূরে সরাইয়া রাখা সম্ভব। নানান উপায় উদ্ভাবনে তাহারা কৃতকার্য্যও হইয়াছে- তাহা সবিস্তারে লিখিবার প্রয়োজন নাই। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিতেছি- একবার অত্যন্ত সকালে ইশকুলে গিয়া সুলগ্নার শ্রেণীকক্ষে চকপেন্সিল দিয়া তাহার একটি হাস্যকর ব্যঙ্গচিত্র আঁকিয়া রাখিয়াছিল নবীন। চিত্রকরের নাম কোথাও উল্লেখ না থাকিলেও কিশোরী সুলগ্নারও বুঝিতে বাকী রহিল না এই গুণপনা কাহার! ইহাতেও সে অপমানিত হইয়াছে, কিন্তু ইদানীং সে শিখিয়াছে যে তাহাকে সহিতে হইবে। অন্যথায় উৎপীড়ন বাড়িবে বৈ কমিবে না। তবে নবীনের প্রতি তাহার সমস্ত শ্রদ্ধা সেই হইতে মরিয়াছে। ইত্যকার দুষ্কর্মের নেপথ্যে সুলগ্নার-প্রণয়ীকূলের প্ররোচনা রহিয়াছে অবশ্যই। অংকের মাস্টার-মশাই সকলই টের পাইয়া নবীনের ক্লাসে সর্বসমক্ষে তাহাকে ভর্ৎসনাও করিয়াছেন। 


মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার আগে পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতিকালীন ছুটি পরিয়া যায়। এক মাস হইল নবীন ইশকুলে যায় না। সুলগ্নার কথাও তাহার মনে উদিত হইবার অবকাশ পায় না এখন। ছেলের পরীক্ষার আগে তাহাকে গৃহবদ্ধ করিয়া পড়ার টেবিলে বসাইতে তাহার পিতা সপ্তাহান্তর দত্তপুকুর আসিতেছেন। শিয়ালদা হইয়া আসিতে বেশী সময়ও লাগে না। পিতার শাসনে পড়িয়া, অনিচ্ছা স্বত্বেও তাহাকে দৈনিক দু-চার ঘণ্টা বেশী পড়িতে হয়, যদ্যপি সে জানে- কম পড়িলেও তাহার পরীক্ষার ফল মন্দ হইবে না। কম পড়িয়া বরং কিছুটা কাল বন্ধুবান্ধবসঙ্গে রঙ্গ-পরিহাসে মাতিলে মনটি উৎফুল্ল থাকে। পরীক্ষা শুরু হইয়া দেখিতে দেখিতে শেষও হইয়া গেল। পরীক্ষার সুফলের কথা কথকতার প্রারম্ভেই লিখিয়াছি। নবীন ফার্স্ট ক্লাস পাইয়াছে। ইশকুলে এই একটিই ছাত্র এমন কীর্তি করিল। গাঁয়ের ছেলের এমন কীর্তি বিরল! কোলকাতায় কত ছেলেমেয়েই তো ফার্স্ট-ক্লাস পায়! এ আর এমন কি! তবে দত্তপুকুর ইশকুলে আজ এটিই বড় আনন্দের কথা। হাই ইশকুলের হেডমাস্টার মশায় এইখানে আসিয়াছেন একুশ বছর হইল। তিনি জানাইলেন তিনি এইখানে আসিবার পাঁচ বছর পর একটি ছেলে ফার্স্ট-ক্লাস পাইয়াছিল, সে এখন বিলাতে থাকে, আর এই নবীনের ফার্স্ট-ক্লাস পাওয়া দ্বিতীয় ঘটনা মাত্র! এই কথায় নবীনের মাতা পুলকিত হন নাই। যে ছেলেকে তিনি চোখে হারান নিত্য, সেই ছেলেকে তিনি বিলাতে কক্ষনো যাইতে দেবেন না! তবে নবীনের বাপ ছেলের বিলাত-যাত্রার দৃশ্য চক্ষে আঁকিয়া দু'বিন্দু জল ফেলিলেন গর্বে! নবীনের মতন ফার্স্ট-ক্লাস সকলে না পাইলেও অন্যান্য বছর বিবেচনায় এই বছর ছাত্রছাত্রীরা তূলনামূলক ভাল ফলাফল করিয়াছে। কিন্তু মধ্যমণি নবীন। সকল শিক্ষকেরা মিলিয়া সিদ্ধান্ত নিলেন এইবার সকল পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের স্কুলের পক্ষ হইতে সম্বর্ধনা দেওয়া হইবে। তাহার জন্য একটি দিন নির্ধারণ করা হইল। সেইদিন দত্তপুকুরের সকল গণ্যমান্য লোক উপস্থিত থাকিবেন, আর বাধ্যতামূলকরূপে সকল ছাত্রছাত্রীর অভিবাবকেরা। এই অনুষ্ঠান ইশকুলের সকল শিক্ষার্থীদের জন্য প্রেরণাপ্রদ হইবে- হেডমাস্টার মহাশয়ের এই বিশ্বাস। 


নির্ধারিত দিনে অনুষ্ঠান শুরু হইয়াছে। গ্রামের ইশকুল। সর্বসাকুল্যে শ’খানেক ছাত্রছাত্রী হইবে। ছোট্ট একটি মাঠ আছে। তাহার এক প্রান্তে মঞ্চ হইল। মেট্রিকুলেশনের পর সবে ইশকুল খুলিয়াছে। বহু ছাত্রছাত্রী এখনও ছুটি কাটাইতেছে। পঞ্চাশ-ষাটের মতন ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক সমবেত হইলেন। মঞ্চে মাস্টারমশায়েরা উপবিষ্ট। নবীনের বাপ নামী লোক, তাহার জন্যও আসন আছে। থানার বড় বাবু, জমিদার দিনু বাবু, পোস্টমাস্টার মশাই, সরকারি দলের নেতামশাইও আসিয়াছেন ও মঞ্চে স্থান গ্রহণ করিলেন। পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের চন্দনের তিলক পড়াইয়া দিবার দায়িত্ব অর্পিত হইয়াছিল সুলগ্নার হাতে। সে গানও জানে। তাহার সঙ্গীত-শিক্ষক কলিকাতা হইতে আসে প্রতি রবিবার বিকাল করিয়া। অনুষ্ঠানারম্ভে সে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাহিয়া সকল শ্রোতাদের মুগ্ধ করিয়াছে। কেবল নবীনের তাহা কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভাল লাগে নাই। অনুষ্ঠান শেষে সে তার অন্তরঙ্গ বন্ধু বিপিনকে কানে কানে কহিল ‘এচ্চেয়ে আমাদের স্টেশনের হারু পাগলা যে গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষে করে, তা ঢের ভাল’! বিপিন কহিল ‘ভায়া আমাকে বোকা বানিয়ে লাভ কি? যতক্ষণ ছিলে ততক্ষণ তুমি আর সুলগ্না যে একে অপরে বিরামহীন চোখাচোখি করেছ তা আমি টের পাইনি ভাবলে?’ বিপিনের এই কথায় নবীন উত্তর করিতে যতটা না অপ্রস্তুত অইল তাহার চাইতে বেশী সে যেন অন্তরে আঘাত পাইল। মিথ্যা নহে তাহাদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হইয়াছে বহুক্ষণ, বহুবার- কিন্তু ইহার তাৎপর্য্য কি? কাহারো নয়নে নয়নপাত হইলেই তাহা প্রণয়াভিমুখে ধাবিত হইতে বাধ্য কি? অপর কেহ না বুঝিতে পারে, কিন্তু বিপিন! বিপিন যে তাহার সর্বনিকটতম বন্ধু। তাহার সমস্ত অনুভবের সাথী। সে কেন এইরূপ মাথামুণ্ডুহীন কথা আরোপ করিবে? অভিমান জমিল মনে। কয়েক কথায় বিপিনকে বুঝাইয়া ক্ষান্ত করিতে চাহিয়াও নবীন ব্যর্থ হইল। বিপিন খিকখিক করিয়া হাসে ‘দ্যাখো দ্যাখো, তোমার গাল কেমন লাল হয়ে উঠেছে! আমি কিছু বুঝিনে? আমি কচি খোকা?’ খিকখিকখিক! 

                            

                                                       ***


কয়েক ঋতু গত হইল নবীন কলিকাতা আসিয়াছে। শহরের বড় কলেজে পড়ে সে এখন। নবীনের পিতাই সকল ব্যবস্থা করিয়াছেন। একটি ঘর ভাড়া হইল। আপাতত নবীন পিতার সহিত থাকিবে। তাহার মাতা গ্রাম ছাড়িয়া আসিতে চাহেন নাই। তিনি গ্রামেই রহিয়া গেলেন বুকে পাথর বাঁধিয়া। পুত্রটি দূরে গিয়াছে, কন্যাটি তো আছে সাথে। তাহাকে শহুরে বানাইবার সাধ নাই। এর মধ্যে অমিয় মুখুজ্জে একবার তাহাদের ভাড়া বাড়িতে আসিয়াছিলেন তাহার পিতার সহিত আলাপ করিতে। ইশকুলের সেই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে নবীনের বাপের সহিত সুলগ্নার বাপের পরিচয়। সেই পরিচয় অল্প সময়ে বন্ধুত্বসুলভ হইয়াছে। কার্যোপলক্ষে কলিকাতা আসিয়া তাই নবীনের বাপের সহিত একটু সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন তিনি। নবীন প্রণাম করিল, সৌজন্যতা দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিল ‘কাকাবাবু সুলগ্না কেমন আছে’? ইহা জিজ্ঞাসা না করিলে ভাল হইবে কি মন্দ, ভদ্রতা হইবে কি অভদ্রতা তাহা লইয়া কিছুক্ষণ মনস্তাত্বিক বিচার-বিশ্লেষণ করিতে হইয়াছে অবশ্য। অমিয় বাবুও জানিতে চাহিলেন নবীনের কলিকাতা কেমন লাগিতেছে, নতুন পরিবেশে অসুবিধা হইতেছে কি না, লেখাপড়া ঠিক হইতেছে কি, নতুন বন্ধু কত জুটিল ইত্যাদি। সুলগ্নাকে যতই অপছন্দ হউক, সুলগ্নার পিতা যে অতি সজ্জন এবং দারোগা হইলেই যে মানুষ রুক্ষস্বভাবের হইবে না- এই বিষয়ে নবীনের সন্দেহ রহিল না আর। অমিয় বাবু বিশেষ করিয়া বলিয়া গিয়াছেন- সামনের গরমের ছুটিতে দত্তপুকুর ফিরিলে নবীন যেন অতি-অবশ্যই তাহার বাড়ি যায়। নবীনের এই নিমন্ত্রণে সম্মতি একেবারে না থাকিলেও ভদ্রতা দেখাইতে মুচকি হাসিয়া সম্মতিজ্ঞাপক ভঙ্গিতে সে মাথা নাড়িল। দত্তপুকুর হইতে এইখানে আসিবার পর আর সে গ্রামে ফেরে নাই। মাঝেমাঝে গ্রামের জন্য বুকের মধ্যে হুহু করে ওঠে। মাকে দেখে নাই কতদিন। মায়ের হাতের ছোঁয়া সে পায় নাই যেন এক যুগ। স্টেশনের কাছে ফুচকা-কাকুর তেতুলজলের স্বাদ তাহার জিহ্বায় জাগিয়া ওঠে। অমন স্বাদ কলিকাতায় নাই। চিতি খালের স্বচ্ছ জলে শাপলা ফোটে। জলে নামিয়া শাপলার ডগা তুলিয়া লয় গ্রাম্যনারী। বসন্তের শেষ, গ্রীষ্ম দুয়ারে খিড়কি নাড়ে। মাঠের সকল ধান কাটা সারা। তাহার বাড়ির উঠান ঝরা আমের মুকুলে ছাইয়া গিয়াছে। গরমে মা কাঁচা-আম দিয়া মুসুরির ডাল করে। তাহার দোতালার ঘরের জানালা ঘেরিয়া দুলিতে থাকে নারিকেলের পাতা, ঝিরিঝিরি হাওয়া বয়। এই কলিকাতার বৈদ্যুতিক পাখায় সে মমতা নাই। এইখানে যেন সকলই প্রেমহীন, মেকি, বাহ্যাড়ম্বরপূর্ণ। নবীন যৌবনের দ্বারদেশে দাঁড়াইয়া আছে। তাহার শরীরে মনে প্রতিপলে অনঙ্গের শর হানিতে পারে এমন সদ্যযুবতী রমণীর অভাব এই সুরম্য নগরে নাই। বিশেষ- এই নগরে প্রৌড়া রমনীও আপনারে যুবতীর ন্যায় দেখাইতে ব্যস্ত থাকে! নবীনের সহপাঠিনীরা সুশিক্ষিতা, আধুনিকা, নানাবিধ আধুনিক আভরণে সুসজ্জিতা। বিত্তশালী ঘরের কন্যা ইহারা। ইহাদের দু’কলি বাংলা কথায় দু-চারটি বিলাতি শব্দের প্রয়োগ আসিবেই। ইহাদের খলখল হাসি বাঁধ মানিতে জানে না। নৃত্য-গীতে ইহারা একেকটি ইন্দ্রলোকের অপ্সরা যেন। ইহারা পুরুষ দেখিলে বুকের ওপর আঁচল টানিয়া দিয়া লজ্জাকাতর হইতে বাধ্য নহে। গ্রাম্যবালার ন্যায় মাথাভর্তি তেল দিয়া ফিতা দিয়া বিনুনি বাঁধিয়া ইহারা পড়িতে আসে না। ইহাদের মুক্ত-চিকুর-জালে উদ্দাম যৌবনের পরাগ যেন বাতাসে ভাসিবে বলিয়া সদা উন্মুখ। তাহাতে নবীনের মত লক্ষ নবীন মৃত্যু-পর্যন্ত মোহিত হইতে কুণ্ঠা করিবে না। কিন্তু নবীন যে সর্বদা ভাবিয়াছে- সে আর দশজনের মতন হইবে না। তাহার প্রমথমথিত হৃদয় মাঝেমধ্যে আকুল হইয়া উঠিলেও সে এই শহুরে-সৌন্দর্য্যে নিমগ্ন হইতে পারে না। এইখানে সে কাহাকেও সাহস করিয়া দুটি ব্যঙ্গবাণ হানিয়া প্রত্যুত্তর না পাইয়া রহে না! গ্রাম্য-বালিকার ন্যায় ইহারা চুপ করিয়া অপমান সহে না। সকলেই কি আর সুলগ্না? যেদিন সে তুলনা করিতে গিয়া শহুরে রূপসীদের পাশে সুলগ্নাকে দাঁড় করাইল তাহার হৃদয়বেদীতে- সেদিন সে নিজে অনুভব করিল- এমন কিছু হইয়াছে যাহা আর তাহার আয়ত্তে নাই। যাহা সে আয়ত্তে আনিতেও আর চাহে না। ইহাকে বাঁধিয়া সুখ নাই, ইহাকে ছাড়িয়া সুখ নাই! ইহাকে কহিতে গেলে কষ্ট। ইহাকে বুকে চাপিয়া রাখিতেও ভয়!  



গরমের ছুটি পড়িলে দত্তপুকুরের ট্রেনে চাপিয়া পিতা-পুত্র গাঁয়ে ফিরিল এইবার। কাঠফাটা রৌদ্রে দগ্ধ জনজীবন। দুপুরে আহার করিতে করিতে নবীনের বাপ কহিল ‘হ্যাঁরে নবু, বিকেল বেলা রোদ্দুর পড়লে একটু তোর অমিয় কাকুর বাড়ি যাব। তোকে নিয়ে যেতে বলল খুব করে।’ পিতার মুখের ওপর ‘না’ কহিবার ধৃষ্টতা নবীনের হয় নাই আজও। সে মাথা নাড়িল। অন্তরে সুলগ্নার সম্মুখীন হইবার ভয় তাহাকে প্রকম্পিত করিতেছে, তাহার কোন বাহ্যিক অভিব্যক্তি নাই যদিও। সন্ধ্যার আগে আগে পিতা-পুত্রে একত্রে অমিয় মুখুজ্জের গৃহে আগত। আজ রবিবার। সুলগ্নার গানের মাস্টারমশাই গান শিখাইয়া ফিরিবেন। অমিয় বাবু পরিচয় করাইয়া দিলেন মাস্টারমশাইয়ের সাথে। মাস্টারমশাইয়ের যত্নে যে সুলগ্না রবীন্দ্রসঙ্গীতে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করিয়াছে তাহা অমিয় বাবু সবিস্তারে কহিলেন। তাঁহার আগ্রহ- মেট্রিকুলেশন পাশ করিবার পর সুলগ্না কলিকাতা যাইয়া রেডিওতে অডিশন দিবে। আগে পরীক্ষাটি ভাল হওয়া চাই। সামনেই পরীক্ষা। দিন ঘনাইয়া আসিতেছে। সুলগ্নার পিতার ইচ্ছা যে ক’দিন নবীন গ্রামে আছে- সে যেন মাঝেমধ্যে একটু আসিয়া সুলগ্নাকে একটু একটু পড়াইয়া যায়; সম্ভাব্য প্রশ্নসমূহ দেখাইয়া, বুঝাইয়া যায়। নবীনের মতন মেধাবী না হইলেও নবীনের কিঞ্চিৎ সাহচর্য লাভে তাহার কন্যারও কিঞ্চিৎ ভাল ফল হইতে পারে ইহা তাহার সুনিশ্চিত বিশ্বাস। রূপে-গুনে-জ্ঞান-গম্যিতে তাহার কন্যাটিও একেবারে ফেলিবার নহে। নবীনের বাপ এই প্রস্তাবে আহ্লাদিত হইলেন। তবে বাধ সাধিল নবীন স্বয়ং। পিতার আগ্রহ-অনাগ্রহের ওপর মুখ ফুটিয়া ‘হ্যাঁ-না’ কিছু সচরাচর না কহিতে পারিলেও এইবার নবীন কহিল, ‘কাকাবাবু আমার বিশেষ অসুবিধা ছিল না, তবে ছুটি কাটলে আমারও কলেজে পরীক্ষা আছে, তাই নিজের পড়াশোনা নিয়েও একটু ব্যস্ত থাকব। আমি তবুও চেষ্টা করব সময় পেলে।’ অমিয় বাবু সুপ্রসন্ন বদনে কহিলেন ‘বেশ বেশ’। ফিরিবার সময় নবীনের পিতা নবীনকে বলিলেন, ‘অত করে বলেছেন যখন, দু’এক বার অন্তত যাস’। নবীন মাথা নাড়িল বটে কিন্তু মনে মনে ভাবিল সে কক্ষনো যাইবে না। এমনিতেই গাঁয়ে ফিরিবার পর হইতে কতকগুলি উড়ো-কথা তাহার কানে আসিয়া তাহার ব্যতিক্রমতা-প্রিয় ব্যক্তিত্বকে ঘা মারিতেছে নিত্য। পাড়ার মুদির দোকানি সুধীর কাকা- রসিক লোক! তিনি নবীনকে কহিলেন ‘কি হে ভাইপো, পাকা কথা শুনছি যে!’ নবীন কিছুই বুঝিতে পারে নাই। পরে বিপিন ব্যখ্যা করিল, ‘সুলগ্নার বাপের সহিত নবীনের বাপের সখ্যতা গ্রামের লোকের বড় চোখে পড়িয়াছে। কোন রসিক গ্রামবাসী এইরূপ রটাইয়াছে যে- তাহারা ভবিষ্যতে পরস্পরের বেয়াই হইবে বলিয়া সংকল্পবদ্ধ!’ গ্রামের লোকের আর কিই বা করিবার আছে এইসকল গুজবে আনন্দিত হওয়া ভিন্ন? তাহারা তো আর শহুরেদের মতন ইচ্ছা হইলেই টিকিট কাটিয়া থেটার দেখিতে পায় না। তাই নিজেরাই আপন মনে ইহাকে উহাকে লইয়া স্বকপোলকল্পিত নাটক রচিয়া বিনোদন করে। আর একবার একটি নাটক জমাইতে পারিলে তাহা ঘরে ঘরে সংক্রমিত হয়। নবীন-সুলগ্না-কেন্দ্রিক এই আখ্যানও এখন গোটা পাড়ায় খ্যাতি লাভ করিয়াছে। এমনকি তাহার বন্ধু বিপিনও তাহা অন্তর হইতে বিশ্বাস করিয়াছে। সুলগ্নার প্রণয়াভিলাষী নবীনের বাকী বান্ধববৃন্দ, যাহারা একদা নবীনকে দেখিলে উৎফুল্ল হইত- অদ্য তাহাদের কেহ কেহ সুলগ্নার কথা পাড়িয়া নবীনকে খোঁচাইতে আসে। গাঁয়ে ফিরিবার পর হইতে যে এইসকল সে সহ্য করিতেছে। সে কত করিয়া বোঝাইতে চাহে ‘দ্যাখ ভাই, প্রথমত এইসব মিথ্যা গুজব। আর দ্বিতীয়ত ওরা মুখুজ্জে বামুন আর আমরা কায়স্থ। এসব হয় না। তারপর তোরা তো জানতিস আমি ওকে একেবারেই সহ্য করি না' (যদিও এই কথা কহিতে ইদানীং তার মর্মপীড়া হয় খুবই)। নিজের স্বাভিমান উন্নত দেখাইতে প্রত্যহ সে সুলগ্না হইতে সুদূরে রহিতে চাহে, কিন্তু সেই যে সুলগ্নার বাড়িতে তাহার পিতাসমেত গেল, সুলগ্না আসিয়া জলখাবার দিয়া তাহার পিতাকে প্রণাম করিল, শেষে কিনা তাহাকেও প্রণাম করিতে নীচে ঝুঁকিয়া কি এক বিব্রতকর পরিবেশ সৃজন করিল- এই সুলগ্না তো সেই সুলগ্না নহে যাহার রাঢ়-বুলি লইয়া সে বিদ্রূপ করিয়া মজা পাইত! লাল ফিতায় ছোট ঝুঁটি বাঁধিয়া দুলিতে দুলিতে সে ইশকুলে আসিত। এখন তাহার আজানুলম্বিত কেশদামে সঘননিন্দিত যুগযুগসঞ্চিত বরষা যেন বিপুল প্রণয়াবেগে ধরণীতে ছুটিয়া আসে বিপুল বেগে। কজ্জ্বলপুরিত নেত্রদ্বয়ে যেন শত জনমের প্রেমতৃষা ভাষা খুঁজিতেছে। পদসঞ্চারণে নূপুর-নিক্বণ যেন বসন্তের ভ্রমরগুঞ্জন হইয়া হৃদয়পদ্মে বাজিতেছে অবিরাম। তাহার সুহাস্যমাখা মৃদুভাষ যাহা কভু নবীনের চিত্ত বিগলিত করে নাই, আজ তাহা শুনিয়া মনে হইল- তাহার প্রতিটি শব্দ সুধানির্ঝরিনী। সেইদিন সুলগ্নাকে দেখিয়া প্রথমবার নবীনের আপাদমস্তকে প্রেমাতুর-পঞ্চশর বিঁধিয়াছিল, সে বুঝি বা অজ্ঞান হইয়া যায় তখন! সেই সন্ধ্যায় নিজেকে বহু কষ্টে সামাল দিতে পারিয়াছে। তখনই সে নির্ণয় করিয়াছিল- দ্বিতীয়বার আর সুলগ্নার বাড়ি যাইবে না। তাহার আর সাহস নাই। রটনা পাছে ঘটনা হইয়া যায়! পাছে সে নিজেরে পূর্ণাঙ্গ সমপর্ণ না করিয়া ফেলে! আপন পৌরুষের দেদীপ্যমান অহমিকাকে নারীর সৌন্দর্য-মোহে সে নিভাইতে পারিবে না। ইহা তাহার লজ্জা। সে সৎ-গ্রন্থে পড়িয়াছে- বিষয়াসক্তি বর্জন করিতে হইলে- প্রথমে আপনারে বিষয় হইতে দূরে রাখিতে হয়। সুলগ্নারে সে দূর করিতে পারে না সত্য, সে স্বয়ং তো চেষ্টা করিয়া দূরে থাকিতেই পারে। উপরন্তু গাঁয়ে কদর্য কথাবার্তা হইতেছে তাহাদের নিয়া। পাড়ার লোককে দুটি কথা আরও রঙ মাখিয়া কহিবার সুযোগ করিয়া দিবার কি প্রয়োজন? এই সব কথাবার্তায় সে কোন কৌতুক দেখিতেছে না। বরং সে দেখিতেছে- তাহার বলবীর্য্যদীপ্ত সদ্যোন্মেষিত পৌরুষ শ্লাঘাহীন হইয়াছে! সে যে আর দশজনের মতন রমনীপ্রেমে লালায়িত নহে এই কথা যত জোরে সে বুঝাইতে চাহে- সে যেন ততই হাস্যাস্পদ হইয়া যায়।   



সেইবার সে গ্রাম হইতে কলিকাতা ফিরিল। এখন সে খুব বেশী দত্তপুকুর আর যায় না। গেলেও মায়ের কাছে দিন কাটাইয়া সন্ধ্যার ট্রেনে কলিকাতা ফিরিয়া আসে। তাহার নাকি পড়াশোনার চাপ বাড়িয়াছে বড়। তাহার মায়ের কানে কে যেন এই কথা তুলিয়াছে- ‘ছেলে এখন স্বদেশী আন্দোলনে ভিড়িয়াছে, তাই গাঁয়ে এত কম থাকে’! কথাটি মিথ্যা না হইলেও, ইহা তাহার মাতার কর্ণকুহর অব্দি পৌঁছাক তাহা নবীনের ইচ্ছা ছিল না। তাহার পিতার সহিত এক ঘরে বাস করিয়াও- তাহার পিতা অদ্যপি কিচ্ছুটি আঁচ করিতে পারে নাই! স্বদেশী আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করিয়াও নবীন ভাবিয়াছে, ইহা যেন তাহার আত্মোন্নয়নে বিঘ্ন না আনে। নবীনের বাসনা সে ভাল বিদ্যার্জন করিয়া জন-প্রশাসনে চাকুরী করে। তাহাতে ইংরেজ-রাজের রাজকর্মচারী হইয়া, তাহাদের নাকের ডগায় বসিয়া কিছু দেশসেবা করিবার সুযোগ হইবে। তলে তলে বিপ্লবীদের সহায়তাও সে করিতে পারিবে। বিপ্লবীদের ওপর পুলিশের নজরদারী বাড়িয়াছে। সহিংসতা হইতেছে খুব। সরাসরি সশস্ত্র বিপ্লবে জড়াইতে চাহিয়াছিল সে। পূর্ববঙ্গের এক বিপ্লবী নেতা তাহাকে বলিয়াছে- সকলে সশস্ত্র পথে নামিলে হইবে না। তাহাদের কিছু ইন্টেলিজেন্স সংগ্রাহক চাই। যাহারা অভ্যন্তরে রহিয়া বৃটিশের আনাগোনার খবরাখবর রাখিবে। নবীনকে তাহাদের এই কার্য্যের উপযুক্ত মনে হইয়াছে। কেন না নবীনের মেধা আছে- সে কষ্ট করিলেই কোন সরকারি উচ্চপদ পাইতে পারে। তাহাতে বিপ্লবের উপকারই হইবে। নবীন ইহাতে গোড়ায় নিমরাজি হইলেও, পরে ভাবিয়া দেখিল এইরূপ কর্মের আসলেই গভীর প্রয়োজনীয়তা আছে। কেবল লাঠি-ছোটা-বারুদ-হাতিয়ার দিয়া দোর্দন্ড-প্রতাপ বৃটিশরাজের সহিত অসম লড়াইয়ে কিঞ্চিৎ সাফল্যও আশা করা যায় না। আর এইদিকে ভারতের নেতৃত্বও তাহাদের সমর্থনে নাই। ইহারা দেশের বিভাজন চাহে। বিলাতের বিশ্বযুদ্ধ থামিবার পথে। হিটলার হারিবে তাহা সুনিশ্চিত। নেতাজী সুভাষ বসু আর তার ফৌজের কি গতি হইয়াছে কেহ জানে না। বৃটিশ এই যুদ্ধ আমেরিকার সহায়তায় জিতিলেও বিলাতে তাহার অর্থনীতির কলকব্জা ভাঙিয়া গিয়াছে। উপনিবেশসমূহে রক্তক্ষয়ী বিপ্লব দানা বাঁধিতেছে। এইদিকে মুসলিম লীগ সুযোগ দেখিয়া দাবী করিতেছে -মুসলমানের আলাদা দেশ গড়িয়া দিতে হইবে! মহাত্মা তাহাতে একেবারেই অরাজি হইলেও মনে হইতেছে নেহেরুর বিশেষ আপত্তি নাই। যে ভয়টি লালা লাজপত রায় করিতেন- আজ তাহার পূর্বাভাস দিকে দিকে জাগিতেছে। বৃটিশ রাজ অস্তমিত হইতে যায়। অপরদিকে এই ভারতবর্ষ হইবে কি দ্বিখণ্ডিত? এই দ্বন্দ্বপূর্ণ পরিবেশে নবীন তাহার নিজ জীবনকে চালাইয়া নিতেছে অভীষ্ট সামনে রাখিয়া। 


সুলগ্নার বাড়ির পার্শ্বস্থ তাহার সহপাঠিনীর কথা পূর্বে উল্লেখ করিয়াছিলাম। উহার নাম ইন্দু। ভাল নাম ইন্দিরা নন্দী। ইন্দুর পিতা অখিল কাকা অসুস্থ হইয়া ডাক্তার দেখাইতে কলিকাতা আসিয়াছেন। নবীনের বাপ বলিয়াছেন যতদিন সময় লাগে- তাহাদের সহিত থাকিতে। ইন্দু বড় সাধাসিধে মেয়ে। দু চার কথা পাড়িতেই সে নবীনকে কহিল ‘নবীন দা, একটিবার যে সুলগ্নার কথা জানিতেও চাহিলে না!’ নবীন চমকিয়া উঠিল ‘সুলগ্না’! সেই সুলগ্না। কলিকাতায় আসিবার পর হইতে নবীনের রমণী-বান্ধবী দু-চার-পাঁচ হইয়াছে বটে। তাহারা সকলে তাহার ন্যায় বৈপ্লবিক কর্মকান্ডে যুক্ত। তাহাদের সহিত অহর্নিশ কত বিল্পবের পরিকল্পনা লইয়া কথা হয়, দেশ ও দশের কথা হয়, চাকুরী-বাকুরীর কথা হয়। আর অন্য কথার ভাব জাগে না। সুলগ্না তো ইহাদের মতন নহে। সুলগ্না! তাহার কথা আলাদা করিয়া মনে রাখিবার মতন কি হইল? সে নবীনেরই বা কে হয়? তবুও এতকাল পর ‘সুলগ্না' শব্দটি শুনিয়া বুকের গভীরে যেন এক তানপুরার তার ছিঁড়িয়া সুর কাটিবার নিনাদ বাজিয়া উঠিল। ‘না রে ইন্দু, সে কেমন আছে?’ ইন্দু সবিস্তারে বহু কথা বলিল। মেট্রিকুলেশনের পর সে কলিকাতা আসিয়া রেডিওতে গানের অডিশন দিয়া টিকিয়াছে। তাহার গান রেডিওতে বাজে। যদিও তাহা কখনো নবীন জানিতে পারে নাই। অমিয় মুখুজ্জে এদিক আসেন নাই দু’বছর কাল যাবৎ। নবীনও পিতার কাছে কোন খবরাখবর কখনো জিজ্ঞাসা করে নাই। দিনু বাঁড়ুজ্জের ছেলের সম্বন্ধ আসিয়াছিল সুলগ্নার জন্য। সুলগ্নার বাপ কন্যাকে আরও পড়াশোনা করাইতে চাহেন বলিয়া রাজি হন নাই তাহাতে। দিনু বাঁড়ুজ্জে বলিয়াছিল তিনি হবু পুত্রবধূকে লেখাপড়া করাইবেন। তবুও অমিয় মুখুজ্জে সম্মতি দেন নাই দেখিয়া দিনু বাঁড়ুজ্জে খুবই শত্রুতা শুরু করেন। দিনু বাঁড়ুজ্জের ছেলেটি যে একটি মহালম্পট এ কথা গাঁয়ে সবাই জানে। ভালই উৎপাত শুরু করে তারা। অমিয় মুখুজ্জে পুলিশের লোক হইলেও খুব নরম প্রকৃতির মানুষ। তিনি তাহার কন্যাকে লইয়া এহেন কদর্যতা মানিতে না পারিয়া দ্রুত দত্তপুকুর ছাড়িয়া দূরে কোথাও বদলি হইয়া গেলেন। 'তবে সুলগ্না আর দত্তপুকুরে নাই’ - তাহাতে কি? কত লোকই তো আর দত্তপুকুরে নাই! তাহাতে কি! নবীন আপনারে প্রাণপণে বোঝাইতেছে ‘তাহাতে কি?’ ইন্দু কহিল, ‘নবীন দা, সে তোমায় কত না পছন্দ করত। যাবার আগে আমায় বললে- ওঁকে হয়ত আর এ জন্মে দেখতে পাব না ইন্দু।’ নবীন বাক্যহারা হইয়া শুধু একটু মুচকি হাসিল। হৃদয়দীর্ণ হইবার মূক-ব্যথা তাহাকে কতটা গ্রাস করিল সেই ক্ষণে তাহা ইন্দু দেখে নাই। যাহা কেবল রটনারূপে মুখে মুখে ঘুরিল, তাহা ঘটনা হইয়া মরমের গভীরে মরিয়া গেল কেন? 


                                                          *** 


নবীনের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ হইল। কলিকাতায় থামিল রাইওট। এই জননী জন্মভূমির কর্তন হইবেই হইবে। চারিদিকে যেন রৌরবের উত্তাপ ছড়াইয়াছে। নবীনের পিতা ভাবিয়াছিল ছেলের পড়া শেষ হইলে তাহাকে বিলাত পাঠাইবেন। সে আশা প্রস্ফুটিত হইবার সম্ভাবনা এই মূহুর্তে কম। নবীনেরও তাহা ইচ্ছা নহে। তাহার ইচ্ছা এই আর্ত স্বদেশজননীর সেবা করে সে। এই কলিকাতাতেই একটি চাকুরী করিয়া এই দেশেই থাকিবে, কোথাও যাইবে না। ইংরেজ চলিয়া যাইবে। তারপর কে ধরিবে এই দেশের হাল? তাহাদের ন্যায় যুবকদের নিজ স্বার্থচিন্তা জলাঞ্জলি দিয়া আগাইয়া আসিতে হইবে। নবীনের বাপ বৈষয়িক মানুষ। তিনি অত ভাবিতে চাহেন না। তিনি চাহেন পুত্রের বৈষয়িক সমৃদ্ধি। নবীনের মাতা যে তাহাও বোঝেন না। তাঁহার ইচ্ছা- ছেলে লেখাপড়া শিখিয়াছে, বিবাহযোগ্য হইয়াছে, এখন উপযুক্ত পাত্রী দেখিয়া ঘরে বৌ লইয়া আসেন। সুলগ্নাকে তাঁহার খুবই মনে ধরিয়াছিল। দিনু বাঁড়ুজ্জেরা যা হুজ্জতি করিলেন, তাহাতে অমিয় মুখুজ্জের খুব কষ্ট হইয়াছিল। সেই দুরবস্থায় নবীনের বাপ ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও বন্ধুর হইয়া গলা চড়াইতে পারেন নাই, কেন না এই গাঁয়ে বাস করিতে হইলে দিনু বাঁড়ুজ্জের সহিত বিবাদ তাহার জন্য অশুভ। এই কারণে অমিয় মুখুজ্জের সহিতও নবীনের বাপের দহরম-মহরম ভাব আর টিকিয়া নাই। যোগাযোগ অল্পস্বল্প আছে বটে এখনো। ঐ পত্রালাপ পর্যন্ত। নবীনের বাপের সরকারি পদোন্নতি হইয়াছিল আর সুলগ্নার বাপ দারোগা হইয়াই রিটায়ার্মেন্ট-এর দিকে এখন। নবীনের মাতায় ন্যায় নবীনের পিতারও সুলগ্নাকে ভারী পছন্দ। কিন্তু ঘটনাচক্র এমন ভাবে ঘুরিয়াছে যে সুলগ্নার বাপের কাছে এই প্রস্তাব তুলিবার সাহস আর হইবে না। তাহা ভিন্ন কথা- যদি মানিয়াও নিই যে সুলগ্নার পিতা রাজি হইল- কিন্তু পুত্রবধূকে তো আর আড়াল করিয়া রাখা যাইবে না। যদি স্বপরিবারে নবীনেরা সকলে কলিকাতাতেই স্থায়ী হইয়া যায় তাহা হইলেও সকলে জানিবে আজ না হয় কাল যে নবীনের বৌটি কে। গ্রাম তো একেবারে ছাড়িবে না তাহারা। এইরকম কিছু হইলে কি দিনু বাঁড়ুজ্জে তাহাদের শান্তিতে বাঁচিতে দিবে? তদ্ভিন্ন এটিও বা কি করিয়া ভুলি যে মুখুজ্জের সাথে দত্তের বনিবে না! অন্তত পাড়াগাঁয়ে লোকজন আজও জাতপাত মানে! অতএব সুলগ্নাকে পুত্রবধূ করিবার ভাবনাটিকে বিসর্জন দেয়া উত্তম। বরং সুলগ্নার বাপের সহিত অন্য একটি ব্যাপারে আলাপ হইতে পারে। নবীন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করিলেও তাহার বাসনা সরকারি প্রশাসনিক কাজকর্ম করিবে। কারখানা, কলকব্জা, মেশিন-টেশিনে তাহার মন লাগে না। স্বদেশী বিপ্লবের দিনান্তে সে আজকাল সঙ্গীত সাহিত্য নিয়া ডুবিয়া থাকে। কলিকাতার এক খাঁ সাহেবের কাছে তালিম লইতে যায়। পুত্রের এইসকল ভাবগতিক পিতার পছন্দ নহে। তিনি ভাবিতেছেন একে শীঘ্র কোন চাকুরীতে বাঁধিয়া বিবাহ করাইতে হবে, তবে যদি একটু সাংসারিক হয় সে। সুলগ্নার বাপের সহিত যেমন মন কষাকষিই হোক না কেন, নবীনকে তিনি বরাবরই স্নেহ করিয়াছেন। তিনি নিপাট ভদ্রলোক। সরকারি নানা মহলে তাঁহার অবাধ বিচরণও আছে। চাহিলেই খুব দ্রুত নবীনের একটি চাকুরীর ব্যবস্থা করিয়া দিতে পারেন। নবীনের মাও ভাবিল- এইটিই বরং ঠিক হয়। পরদিনই অমিয় মুখুজ্জের সন্ধান জোগাড় করিয়া নবীনের বাপ পত্র লিখিলেন। বহুদিন লেখা হয়না বিধায় ঠিকানা বিস্মৃত হইয়াছেন। দত্তপুকুর থানায় গিয়া তিনি জানিয়াছেন অমিয় দারোগা এখন হুগলীতে আছেন। ঠিকানাও তাহারা দিয়া দিল। পত্রের উত্তর আসিল এক সপ্তাহ পর। অমিয় মুখুজ্জে ভীষণ খুশি। এতকাল পুরাতন মিত্রের পত্র পাইয়া যারপরনাই আনন্দিত তিনি। লিখিয়া পাঠাইলেন- টানবাজার হইতে কোন্নগর আসিতে কিই বা এমন সময় লাগিবে, সময় করিয়া তাহার বাড়িতে আসিতে স্বপরিবারে, বেশ আড্ডা হইবে, বাকী সব কথা হবে খন। নবীনের বাপ কৃতজ্ঞতায় গলিয়া গেলেন। এই মানুষটি কতই না উদার। তাহার দুর্দিনে পাশে দাঁড়াইতে পারি নাই, তবুও তিনি কিছু মনে রাখেন নাই। মাসখানেক পর একটি দিন স্থির করিয়া নবীন ও তাহার বাপ কোন্নগরে উপনীত হইল। নবীন সচরাচর কোথাও যাইতে চাহে না। কিন্তু অমিয় কাকাবাবুর বাড়ি যাইবে শুনিয়া সে মত্রমুগ্ধ কাঠপুত্তলির ন্যায় সম্মতি দিল। নিজেকে বিশ্লেষণ করিতে সে সময় নেয় নাই। সে যাইবেই যাইবে। এতকাল অন্তরে গুমরে মরিয়া আকুল হইয়া সে গগনের মাঝে খুঁজিয়াছে ‘সে কোথায় গেল’! গ্রামাফোনে বাজিয়া উঠিত যখন ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে বসন্তের বাতাসটুকুর মত’ তখন সমস্তসুরলহরী বিলুপ্ত হইয়া কি এক অদ্ভুত ক্ষোভ জন্মিত রবি ঠাকুরের জন্য! যেন তাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া এই বাক্যবাণ সুরে সুরে সজ্জিত হইয়াছিল। ‘সে চলে গেল বলে গেল না’। কেন সে বলিয়া যায় নাই? বলিলে কি ক্ষতি হইত? না হয় একটিবার মুখ ফুটিয়া বলিত! না হয় একটিবার নবীন তাহার পরিপূর্ণ অন্তরাত্মা সুলগ্নার পায়ে সঁপিয়া দিত! না হয় সেও আর দশের মত হইত! সে পারিল না। সে কিছু জানিত না। তাহাকে জানিতে দেওয়া হয় নাই! এই দোষ কি সুলগ্নার নহে? আকাশের চাঁদের দিকে মুখ তুলিয়া ভাবিয়াছে ‘সে ঢেউয়ের মতন ভেসে গেছে, চাঁদের আলোর দেশে গেছে’! সে কোথায়! সে গেল কোথায়? এই সংক্ষুব্ধ ব্যকুল হৃদয়কে সে কত না প্রবোধ দিয়া বাঁধিয়াছে। আজ যদি সে মায়া-কুরঙ্গিণী নিজেই এসে দেখা দিতে চাহে, সে কেন দেখিবে না? সে কেন তারে ধরিবে না? সে যাইবে তাহারে বাঁধিয়া আনিতে। 


কোন্নগরে সুলগ্নার বাড়ী অতি মনোরম পরিবেশে, ভাগীরথীর সন্নিকট। অমিয় বাবুর অবসর নিতে আর দুই বছর বাকী। তিনি এইখানে আসিয়া আর বাড়ি ভাড়া করেন নাই। এই বাড়িটি ক্রয় করিয়াছেন। মেয়ে বিবাহযোগ্যা হইয়াছে। বিএ শেষ বর্ষ পড়িতেছে সে। তাহারও অবসরের দেরী নাই। বিপত্নীক। আর কত বাড়ি ভাড়া করিয়া ঘুরিবেন ফিরিবেন। এই বাড়ি হইতেই কন্যাকে সুপাত্রে অর্পণ করিবেন। নবীনেরা যখন উপস্থিত হইল তখন সুলগ্না রান্না করিতেছিল। আজ বাড়িতে অথিতি আসবেন তাই ভাল মন্দ আয়োজন হইতেছে। মেয়ের রান্নার হাত তাহার মাতার ন্যায় নিপুণ- এই কথা স্মৃতিকাতর হইয়া বলিলেন অমিয় বাবু। এখন তাহার একমাত্র চিন্তা একটি সুযোগ্য জামাতা কি করিয়া জোটে তাহা। নবীনের মাতা ও ভগিনী আসিতে পারে নাই। তাহার মাতা অসুস্থ। ভগিনী সুশুশ্রা করিতেছে। অমিয় বাবু হাঁক দিলেন ‘কৈ রে, একবার এদিক আয় মা, তোর নবীনদা'রা এসেছে।’ ‘আসছি বাবা’ বলে ভেতর ঘর থেকে চঞ্চলা চিত্রা হরিণীর মতন সুলগ্না আবির্ভূত হইল। এই মূহুর্তটির জন্য যে একটি কল্পকাল অপেক্ষা করিয়াছে নবীন। আজ তাহার মানসপ্রতিমাকে যেন চর্মচক্ষুতে সে দেখিতে পাইতেছে। সুলগ্না উচ্ছ্বসিত হইয়া নবীনের পিতাকে প্রণাম করিল, নবীনকে করিতে অগ্রসর হইতেছে সে। নবীন প্রস্তরবৎ দেহে কোনক্রমে প্রবল হৃদকম্পনটিকে ধরিয়া রাখিতে চায়। ‘কেমন আছ নবীন দা?’ নবীনের গলা শুকাইয়া গিয়াছে। ‘ভাল আছি’ কথাটি বাহির হইতে পারিল না। জোর গলায় পরের বাক্যটি কহিল ‘তুমি কেমন আছ?’ 

- ‘আমি খুব ভাল আছি দাদা’। 


নানা কথার পর কিছু বৈষয়িক আলাপ পাড়িবার অবসর চাহিয়া অমিয় মুখুজ্জে সুলগ্নাকে কহিলেন নবীনকে তাহার বাড়ির পরিবেশ, কাছের গঙ্গাতট প্রভৃতি ঘুরাইয়া দেখাইতে। সুলগ্না বলিল ‘চলো নবীন দা’। নবীন বাধ্যগত হইয়া চলিতে লাগিল। গঙ্গা কিনারে আসিয়া সুলগ্না কহিল- 


‘ইশকুলে যখন তুমি আমাকে নিয়ে ওসব ছড়া লিখতে আমার খুব রাগ হত। মাঝেমাঝে একেকটায় আবার হাসিও পেত খুব। তুমি এখন কি আর লেখ?’ 


  • হ্যাঁ, টুকটাক। কখনো-সখনো। 


  • তবে সেই যে একটা বিচ্ছিরি ছবি এঁকেছিলে আমার- ওটা দেখে আমি রাগে কেঁদে ফেলেছিলাম! সত্যি বলছি সামনে পেলে তোমায় মেরেই দিতাম। আচ্ছা আমি বুঝি দেখতে অত বিচ্ছিরি ছিলাম? 


সুলগ্নার এই প্রশ্নের উত্তর একটি স্মিত হাসি ভিন্ন আর কিছু নহে। নবীন বলিল ‘আচ্ছা তুমি তো ভাল গান শিখেছ। রেডিওতে গাও। একটা শোনাও না’। 


  • শুনবে? 
  • নিশ্চয় শুনব। 
  • আচ্ছা তার আগে বল, তুমি যে দত্তপুকুর ছেড়ে কোলকাতা চলে এলে, তারপর একটিবার আমার কথা তোমার মনে পড়ত না? 
  • না। 
  • কিন্তু আমার তোমার কথা খুব মনে পড়ত। কেন জানি না। হয়ত তোমার মতন করে কেউ আর ছড়া কেটে জ্বালাতন করত না বলে। খুব মনে পড়ত। কেন জানি না। 


নবীনের কাছে এমন কোন যন্ত্র নাই যে সে তাহা দিয়া বক্ষ ফাঁড়িয়া দেখায়- তাহার মনে কি পড়ে আর কি পড়ে না। সে শুধু একটু হাসিয়া কহিল ‘তোমার কথায় কিন্তু আর রাঢ় বাংলায় টান নেই। আচ্ছা একটা গান গাও না। তবে বুঝব টান পুরোপুরি গেছে না কিছু বাকি আছে।’ সুলগ্না হাসিয়া একটা রবি ঠাকুরের গান ধরিল- 


‘কেহ কারো মন বুঝে না, কাছে এসে সরে সরে যায়’ 


গঙ্গার বিলোল বাতাসে সে সুর যেন নবীনের মর্ম ভেদ করিয়া যাইতেছে। সে সেই সুরে কান পাতিয়া অপর পারে অপলক দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া রহিল। গান সমাপনে সুলগ্না নবীনের চোখে চোখ রাখিয়া কহিল- ‘কেমন গাইলাম বলো’। 


  • বেশ ভাল হয়েছে। 
  • তুমি বোঝো? 
  • কি? 
  • কারো মন? 


                                                    

ফিরিবার পথে নিরন্তর নবীনের মনে এই প্রশ্ন নিরবচ্ছিন্ন বাজিয়াছে ‘তুমি বোঝো? কারো মন?’ সে বুঝিতে জানে না। সে বুঝিতে চাহে নাই। সে অধম। সে অক্ষম। তুমি যদি বুঝিতে, তবে তুমি কেন বলিলে না?’ সে ভাবিল কলিকাতা ফিরিয়াই সে সুলগ্নাকে একটি চিঠি লিখিবে। হৃদয় নিংড়াইয়া সকলি ব্যক্ত করিবে। সে যে কহিতে জানে না। সে যে কত অনর্থক বকিতে জানিয়াছে। কিন্তু যাহা না কহিলে প্রাণে মরে তাহা কখনো কহিতে শেখে নাই। সে দুকথা লিখিতে বরং সক্ষম। সে তাহাই করিবে। চিঠি লিখিবে। পিতার কাছ হইতে ঠিকানার বিবরণ লইয়া আজ রাত্রেই সে লিখিবে। ঠিকানা দিয়া পিতা কহিলেন- অমিয় কাকু তাহার চাকুরীর জন্য সুপারিশ করিবেন এক স্থানে, সে যেন রাজি হয়। নবীনের এই সকল জানিয়া কাজ নাই। তবুও পিতা বলিতে লাগিলেন- দিনু বাঁড়ুজ্জের লম্পট ছেলের কারণে সুলগ্নার দুটি সম্বন্ধ ভাঙিয়াছে। এই কথা শ্রবণে নবীনের হৃদয়ে দুঃখ নাই! সে মনে মনে দিনু বাঁড়ুজ্জের লম্পট ছেলের প্রতি কৃতজ্ঞ হইল! সুলগ্না যখন নবীনকে লইয়া ঘুরিতে গেল, তখন নবীনের বাপ আর অমিয় মুখুজ্জের অনেক কথা হইয়াছে। নবীনের বাপ নবীনের জন্য সুলগ্নাকে চাহিতে পারে না, সে বাসনাও রহিত হইয়াছে। অপরদিকে জাতপাত ইত্যাদির বালাই না মানা মুখুজ্জে বসিয়া ছিলেন যদি নবীনের পিতা স্বয়ং আপনা হইতে সুলগ্নাকে পুত্রবধূ করিতে ইচ্ছাপ্রকাশ করেন তাহা হইলে তিনি বিনা বাক্য-অপচয়ে মানিয়া লইবেন। তাহাদের মনের কথা মনেই রহিয়া গেল। সুলগ্নার একটি ভাল সম্বন্ধ আসিয়াছে। ছেলে পূর্ববঙ্গীয়। মূল নিবাস ঢাকায়। বিলাত-ফেরত। পড়শুনা ওইখানে করিয়াছে। ওপার বাংলায় এবার যা নির্মম নির্যাতন হইল হিন্দুদের ওপর তাহা দেখিয়া ঢাকার জমিজমা কিছু বেচিয়া, বেশীরভাগই একেবারে ছাড়িয়া এইপারে চলিয়া আসিয়াছে তাহারা। বাগবাজারে বাড়ি কিনিয়াছে। এইখানে ব্যবসা করিবে। নবীনের বাপ মুখুজ্জে বাবুকে ভাল মতন করিয়া বুঝাইলেন ‘এই সম্বন্ধ ছাড়া উচিৎ হইবে না। ছেলে সদ্বংশ। ব্রাহ্মণ পরিবার। অর্থবিত্ত আছে। ব্যবসায় মতি আছে। অতএব এই সম্বন্ধ পাকা হইলে সুলগ্না মা বেশ আনন্দেই থাকিবে।’ নবীনের পিতা সকলি বিশদে জানাইল নবীনকে। বলিলেন ‘এক প্রকার পাকা কথা-ই হল বলা যায়।’ নবীন দুই চোখে আঁধার দেখিতেছে। ‘তুমি কি তবে জানো তুমি চিরতরে সরে সরে যাচ্ছ! তবে কেন প্রশ্ন কর আমি মন বুঝলাম কি বুঝলাম না!’ সেই রাত্রে অন্তত দশটি পত্র লিখিয়া- সবকটি সে ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছে! ‘তবে তুমি জানতে! তুমি নিশ্চয় জানো! তুমি জানো তুমি চলে যাচ্ছ। যাবার আগেও তুমি এই ছল করে গেলে কেন? যে মুখ ফুটিয়া কহিতে জানে না তাহার ন্যায় হতাভাগা এ সংসারে কে আছে? নবীন যদি সুলগ্নার হাতটি ধরিয়া কহিত ‘এই তোমার হাতটি ধরলাম, আর ছাড়ছিনে', তবে কি এত বেদনার সদুত্তর সে যথাসময়ে পাইত না? কিন্তু সে তাহা করিতে পারে নাই! সে তাহা করিতে পারে না। সে করিতে জানে না। অথচ বিধি জানে- সুলগ্নাও এইসবের কিছুই জানে না! 


                                                      **** 


সুলগ্নার বিবাহ যেদিন হইল সেদিন পথকুকুরের ন্যায় হাঁটিয়া হাঁটিয়া নগরের রাস্তা ঘুরিয়াছে নবীন। বিবাহের সুসংবাদ আসিয়াছিল পূর্বেই। নবীনের বাপ, মা, ভগিনী সকলেই বিবাহে গিয়াছে। নবীন যায় নাই! নবীন কাঁদিতে চাহিয়া কাঁদিতেও পারে নাই। তাহার নয়ন যেন পাথর হইয়া গিয়াছে। তাহার অস্তিত্ব যেন পঞ্চভূতে মিলাইতেছে ক্রমে। সে যেন বাঁচিয়া নাই। শরীর খারাপের ভান ধরিয়া সে ঘরে রহিয়া গেল। অথচ ঘরে তাহার মন নাই। তাহার শরীরে আত্মা নাই। সে কি বাঁচিয়া আছে কি মরিয়া গেছে সে অনুভব করিতে পারে না আর। সন্ধ্যা নামিলে মনে হইল এই আঁধারে ত্রিভুবন তাহাকে পরম একাকীত্বে গ্রাস করিয়া লইবে। উন্মাদের মত সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। আপনার মনে বিড়বিড় করিতেছে সে, যেন মন্ত্র জপিতেছে ‘কেহ কারো মন বুঝে না’! 

সেই রাত্রে কেহই আর ঘরে ফিরিল না। সারারাত্রি শিলায়দা স্টেশনের বেঞ্চিতে ঘুমাইয়া ভোরে নবীন ফিরিয়াছে। দ্বিপ্রহরে তাহার মা-বাপ-ভগিনী ফিরিল। নবীন দরজা খুলিয়া দিয়া আবার শুইয়া পড়িল। নবীনের মা ভাবিল ছেলের অসুখ বাড়িয়াছে। নবীন মরার মত ঘুমায়। দুপুরে কিছুই ভাল করিয়া সে খাইতে পারিল না। ভাতের গ্রাস তুলিতে তাহার হাত কাঁপে। কি হইল কেহ জানে না। নবীনের বাপ জোর দেখাইয়া ডাক্তার আনাইলেন। ডাক্তার যদিও বা কিছুই আঁচ করিতে পারিলেন না, শুধু কহিলেন রক্তচাপ বাড়িয়াছে, কয়েকদিন ওষুধ খাইলে ঠিক হইয়া যাইবে। আজ সন্ধ্যায় সে যে বাহির হইবে আবার- সেই শক্তি দেহে নাই। অথচ আঁধার নামিলে জগতে- তাহার নিশ্বাস যেন বন্ধ হইবার উপক্রম হইতেছে। সে অন্ধকারে দেখিতে পায়- কোন্নগর, গঙ্গাতীর, সেই সুর - ‘কেহ কারো মন বুঝে না’, সেই মুখ- যাহা সে দেখিতে চাহে না আর, অথচ যাহারে কখনো আর দেখিবে না ভাবিতে বুকে শূলবেদনা জাগে! অন্ধকারের অতলে সে ডুবিয়া যায়। কে তাহাকে বাঁচাইবে আর? নিজের ঘর হইতে সে তাহার ভগিনীকে ডাকিল, ‘নিপু, এই ঘরে আয় তো’। ‘আসছি দাদা’- নিপু আসিল। নবীনের কিছু আলাদা করিয়া কহিবার নাই। যদিও সাধ হয় জানিতে নিপু কেমন দেখিল বধূবেশে তাহার সুলগ্না দিদিকে। সে কিছু অন্য কথা জুড়িল। কিছু কথা কহিতে না পরিলে বোধ হয় সে পাগল হইয়া যাইবে। এই ওই পাঁচ কথার পর নিপুই আপনা হইতে সবিস্তারে বলিল- ‘কেমন বিবাহ বাসর হইয়াছে, অমিয় কাকু জিজ্ঞাসা করিলেন কতবার নবীন কেন আসে নাই, সুলগ্নাদির সাজ কেমন ছিল, কত লোক আসিয়াছে, কেমন রোশনাই হইল, বর দেখিতে কেমন’ - কত কথা। নবীনের বাক্যস্ফূর্তি হইতেছে না। সে শুধু শুনিতেছে। সে কিছু কহিতে না পায়। এমনি অর্ধোন্মাদ অবস্থায় তাহার কাটিয়া গেল একটি মাস। এত গুণবান সুশীল সুপুত্রের এই দুর্দশা পিতা-মাতার দৃষ্টি কি এড়াইয়া যাইতে পারে? তাহার মাতা অনুভব করিল- নবীনের অসুখ শরীরের চাইতেও বড় বাসা হয়ত তাহার হৃদয়ে বাঁধিয়াছে। ইহার প্রতিকার কোন ডাক্তারের নাই। তাহার জননী প্রতি রাতেই ছেলের নিকট আসিয়া তাহার চুলে হাত বুলাইয়া জানিতে চাহে ‘তোর কি হয়েছে মাণিক আমার?’ তাহার ছেলেটি বড় অন্তর্মুখী। চিরকাল এমনই। জননী রোজ জানিতে চাহেন। একদিন নবীনের বাঁধ ভাঙিল। সে তাহার জননীর কোলে মুখ গুঁজিয়া কালবৈশাখী ঝড়ের মতন কান্নায় কাতরাইতে লাগিল। ‘সুলগ্না বলেছে- আমি কারো মন বুঝিনে মা’! 


কিছুদিন ধরিয়া নবীনের বাড়িতে কাহারো শান্তি হইল না। মনে হইল এটি গৃহ নহে, শ্মশানভূমি। নবীনের পিতামাতা জানে না কাহার ওপর তাহাদের পুত্রের সমস্ত বেদনাভারের দায় তুলিয়া দিলে তাহাদের নিস্তার হয়! ছেলের মুখের দিকে যে দেখা যায় না। সুলগ্নার এই বিবাহ পাকা করিতে নবীনের বাপ উৎসাহ দিয়াছে, দিনু বাঁড়ুজ্জের সহিত দ্বন্দ্বে যাইবে না বলিয়া নিজপুত্রকে সমস্ত অর্থে সুলগ্নার যোগ্য জানিয়াও একটি বাক্য এ নিয়া তুলেন নাই, উপরন্তু সুলগ্নার বিবাহে যাইয়া আনন্দ করিল স্বপরিবারে! নবীনের মা কাঁদিয়া কহে- ‘হতভাগা একটিবার যদি বলত আমি ছাদনাতলা থেকে ওই মেয়ে এনে ওর গলায় বেঁধে দিতাম।’ নবীনের ভগিনী সেই রাত্রে যে দাদাকে সুলগ্নার বিবাহের এত গল্প শুনাইল- তাহা মনে করিয়া দাদার সামনে পড়িলে সংকুচিত হইয়া যায়। এইভাবে দিন যাইতেছে। সময় কাহারো দুঃখে রুদ্ধ হইয়া পরে না। কালচক্র অবিরাম ঘুরিতেছে আপনবেগে। দুঃখকে বরিতে যে পারিল, দুঃখকে যে সহিতে পারিল সে দুঃখকে ভুলিতেও পারিবে। ইহা সর্বদা মানবের ক্ষমতাবলে হইবে তাহা নহে। বরং ইহাই প্রকৃতির আশ্চর্য বিধান। মানুষ দুঃখকে আঁকড়াইয়া বাঁচে না! সে দুঃখকে ছাড়াইয়া যায়- জ্ঞাতসারে কিম্বা অজ্ঞাতসারে। 


অমিয় মুখুজ্জের সহিত নবীনের বাপের সুসম্পর্ক আরও প্রগাঢ় হইল। সুলগ্নার বিবাহের মাস চারেক পর তিনি আসিয়া কয়েকদিন কলিকাতায় নবীনদের নিকট রহিয়াছিলেন। কেহ কিছু বুঝিতে দেন না। আর দিয়া-ই বা কি লাভ? কলিকাতা যে শুধু তিনি বেড়াইতে আসিয়াছেন তাহাও নহে, নবীনের চাকুরীর ব্যাপারে তিনি কথা দিয়াছিলেন তাহার পিতার কাছে যে তিনি ভাল একটি ব্যবস্থা নিশ্চয় করিবেন। সেই কার্যোপলক্ষে কলিকাতা পুলিশের কার্যালয়ে গিয়া তিনি বড় বাবুদের সহিত আলাপ করিয়া আসিলেন। নবীনের বয়স একুশ-বাইশের অধিক নহে। সুঠাম দেহ, তেজস্বী। উচ্চশিক্ষিত, ইঞ্জিনিয়ার। সে আরও অনেক ভাল চাকুরী আলবাৎ পাইতে পারে। কিন্তু নবীনের বরাবরই আগ্রহ পুলিশ কিম্বা সামরিক বাহিনীতে যোগ দিবার। (যদিও বর্তমানে তাহার জীবনে আগ্রহ করিবার মতন কিছুই আর পরিলক্ষিত হইতেছে না।) এইসকল কথা পূর্বের। নবীনের অভিপ্রায় জানিয়া-ই, তাহার পিতার সহিত আলোচনা করিয়া এই সিদ্ধান্ত হইয়াছিল যে অমিয় বাবু পুলিশে নবীনের চাকুরীর একটা বন্দোবস্ত করিয়া দিবেন। নবীন দু’একটি লিখিত ও কয়েকটি শারীরিক পরীক্ষা দিয়া যথাযথ ট্রেনিং নিয়া সরাসরি কোন বড় পদে আরোহণ করিতে যে পারিবে- সেই সম্ভাবনা শতভাগ- এই কথা পুলিশ কার্য্যালয় হইতে ফিরিয়া-ই অমিয় বাবু নবীনের পিতামাতাকে বলিলেন। তাহারা আনন্দে আত্মহারা। একমাত্র আনন্দহীন স্বয়ং নবীন! যাহাকে পাইতে নবীন অনন্তকাল অমিয় মুখুজ্জের সদর দরজায় ভিখিরি হইয়া মরিতে কুণ্ঠা করিত না তাহাই অমিয় মুখুজ্জে অন্যের হাতে দিয়াছেন! এই বড় চাকুরী দিয়া সে কি করিবে! 


ভারতভাগ অবশ্যাম্ভাবী। সে পুলিশের চাকুরী চাহিয়াছিল যে উদ্দেশ্যে তাহার কোন প্রয়োজন আর নাই! সে বরং ভাবে- যদি সশস্ত্র বিপ্লবে চলিয়া যাইত, গুলি খাইয়া মরিত, কিম্বা ফাঁসিতে ঝুলিত তবু এই জীবন বোধ করি সার্থক হইত। সে আপনারে না দেশমাতৃকারর কোলে সঁপিতে পারিল, না সেই মায়াবিনীর মায়ায় নিজেরে মুক্ত করিয়া তাহাতে বাঁচিতে পারিল! তাহার জীবনের আর কোন উদ্দেশ্য যেন নাই। এই কয়েক মাসে মানসিক শান্তি চাহিয়া সে বহু ঘুরিয়াছে। সে সমস্ত পথে জানিয়াছে- এই সংসার সুখের পুষ্পশয্যা তো কদাপি নহে। এইখানে সুখ দুঃখ চক্রাকারে ঘুরিতেছে। বাসনার নিবৃত্তি হইলেই কেবলমাত্র শান্তিদুয়ার খুলিয়া যায়। জনৈক সন্ত তাহাকে বলিয়াছে- তুমি পিতা মাতা ভগিনীর প্রতি দায়িত্ব পালন কর, উহাই তোমার ধর্ম। নবীন আপাতত ভাবিয়াছে- একটি ছোটখাট চাকুরী লইয়া সে তাহার কর্তব্য করিয়া যাইবে। বড় কিছু হইবার বা করিবার আবশ্যকতা নাই। অন্তত সুলগ্নার পিতার বদান্যতায় পাওয়া কিছুতে তাহার আর আগ্রহ হইবে না। সুলগ্নাকে ভুলিতে গেলে, সুলগ্নার পিতাকে মনে রাখিলে চলিবে? না তাহার পিতার দেয়া চাকুরী করিলে তাহার পিতাকে ভুলিয়া থাকা সম্ভব? সে তো তেমন নিমকহারাম নহে। এই চাকুরী সে করিবে না। কিছুতেই করিবে না। 


নবীনের বাপ মায়ের মাথায় বাজ পড়িল! ‘ওরে অমিয় কাকু পুলিশে বলে কয়ে সব ঠিক করে এসেছেন। এখন করব না বললেই হয়? উনি অসুস্থ শরীর নিয়ে এতটা এলেন শুধু তোর এই চাকরীর জন্য। আমাদের কথা না হয় ভাবলিনে, বোনটার কথা তো ভাব!’ নবীন যতই না কহে- তাহার পিতামাতা ততই চাপিয়া ধরে। তাহারা বলেন- বাস্তবতাবিমুখ আবেগসর্বস্ব হইয়া এই সংসারে কেহ টিকিয়া থাকিতে পারে না। যাহা হইয়াছে তাহাকে ভুলিয়া সামনে আগাইতে হইবে। অন্তত তাহাদের মান রক্ষার্থে হইলেও নবীনের উচিৎ এই চাকুরী গ্রহণ করা, তারপর তাহার ভাল না লাগিলে সে ছাড়িয়া দিবে যেদিন ইচ্ছা। পিতামাতার পীড়াপীড়িতে বাধ্য হইয়া নবীন রাজি হইল। সমস্ত পরীক্ষা দিল। উত্তীর্ণ হইল। পুলিশের ট্রেনিং এর জন্য তাহাকে ছয় মাস কাল দক্ষিণ ভারত গিয়া থাকিতে হইবে। অন্তত নবীন এই ভাবিয়া স্বস্তি পাইল যে- এই বাংলার আলো বাতাস হইতে দূরে রহিলে সে হয়ত তাহার যন্ত্রণা ভুলিবার প্রয়াসে সফল হইবে। 


                                                    ***


দু’বছর দেখতে দেখতে পার হইয়া গেল। দ্বিখণ্ডিত ভারত আজ স্বাধীন। লালবাজার পুলিশের ভবনে একখানা নতুন পতাকা উড্ডীন। মাঝারি আকৃতির ঘরে রেডিওতে রবি ঠাকুরের গান বাজিতেছে। পুলিশের এক নতুন এসপি এই ঘরে বসেন। দিনভর রবীন্দ্রসঙ্গীত না বাজিলে তিনি কিছুতেই কাজে মন লাগাইতে পারেন না। বয়সে নবীন। তাহার নামও নবীন কান্ত দত্ত। চৌকস অফিসার বলিয়া সুনাম অর্জন করিয়াছেন যুবক বয়সেই। বিবাহাদি করেন নাই। দেখিতে সুন্দর। লালবাজার এলাকায় চোর-ডাকাত হইতে শুরু করিয়া চায়ের দোকানিটিও এনার নাম জানে। 


বছর দেড়েক আগে পুলিশের সুপারিন্টেনডেন্ট পদে আসীন হইয়া নবীন একবার কোন্নগর গিয়া অমিয় কাকাবাবুকে প্রণাম করিয়া আসিয়াছে। তিনি বহু আশীর্বাদ করিলেন। দত্তপুকুরের দিনগুলি মনে করিয়া তিনি বলিয়াছিলেন- নবীনের ভবিষ্যৎ যে অত্যন্ত উজ্জ্বল সে বিষয়ে তাহার কখনোই সংশয় ছিল না। সুলগ্নার কথা বলিলেন। শ্বশুর বাড়িতে তাহার আদর হয়। সেইখানেও সে পড়াশোনা করিয়াছে। কাহারো অমত হয় নাই। একটাই দুঃখ- তাহার জামাতা ব্যবসায়িক উন্নতি তো কিছু করিতেই পারে নাই, উপরন্তু ঋণগ্রস্ত হইয়া নাকাল হইয়াছে। শরীরও তাহার ভাল যায় না। এইসকল শুনিয়া নবীন যথাসাধ্য ভাবলেশহীন হইবার চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু অতটা করাও অভব্যতা হয় বিধায় তাহাকেও কিছু দুঃখানুভূতি প্রকট করিতে হইল। সুলগ্না কেমন আছে, কোথায় আছে এইসব জানিয়া তাহার কষ্ট নাই। সুলগ্না নামটিই তাহার হৃদয়ে যেন আমৃত্য কষ্টকণ্টক হইয়া বিঁধিয়া থাকিবে। তাহাকে তুলিয়া ফেলিবার জো নাই। আজও রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিবার ছলে সে নিত্য একটিই কণ্ঠস্বরকে শুনিবার নিমিত্ত কর্ণপাত করিয়া রয়। আর তাহা শোনা হইল না। হয়ত সুলগ্না আর রেডিওতে গায় না। 


এদিকে সকাল হইতে কয়েকটি কেস ফাইল আসিয়া জমিয়াছে টেবিলে। কাল রাত্রে এক মদ্যপ আকণ্ঠ মদ্যপান করিয়া গাড়ি চালাইতে গিয়া দু’জন পথচারীকে চাপা দিয়াছে। একজন ঘটনাস্থলেই হত। অপরজন যমদূতের সহিত লড়িতেছে হাসপাতালে। দেশ হইতে বৃটিশ গিয়াছে। বৃটিশ রাজ্ যাইবার পর কিছু লোক ধরাকে সরা জ্ঞান করিতে লাগিল। দেশীয় নব্য শাসন ব্যবস্থাকে ইহারা আমল দেয় না। সেই মদ্যপের স্ত্রী সকালে খবর পাইয়া থানায় আসিয়া কাঁদিতেছে। নবীন কনস্টেবলকে জিজ্ঞাসা করিল- 'এই কেসের আর কি অগ্রগতি'? 

 

  • স্যার, ওই মাতালটার বৌ এসেছে সকালে! বলছে ওর বরকে ছাড়াবে জেল থেকে। আপনার সাথে দেখা করতে চায়। বললাম এর’ম ছোটখাটো ঘটনায় এসপি স্যারের সাথে দেখা করা যায় না! মানছেই না। বলে কিনা আপনাকে সে চেনে। 


তাহাকে চেনে- এই কথা শুনিয়া নবীনের বুক ধক করিয়া উঠিল। ‘তাঁকে ভেতরে নিয়ে এসো’। কক্ষে প্রবেশ করিয়াই ‘নবীন দা’ বলিয়া কাঁদিয়া উঠিল রমণী। শীর্ণা দেহ। আলুথালু বেশ। রুক্ষ চুল। চোখের নীচে কালি জমিয়াছে। নবীন কিয়ৎক্ষণ পর আকস্মিকতার রেশ কাটিলে কহিল- ‘ইন্দু না?’ 


  • হ্যাঁ দাদা! 


সমস্ত ঘটনা ইন্দুর কাছে আদ্যোপান্ত শুনিল নবীন। কি করিয়া একজন মদ্যপের হস্তে কন্যা সম্প্রদান করিয়া ইন্দুর পিতা মর্ত্যধাম ত্যাগ করিল। কি করিয়া তাহার মদ্যপ স্বামী তাহার শ্বশুরের সঞ্চিত অর্থে বাবুগিরি করিয়া বেড়ায়, প্রত্যহ তাহাকে প্রহার করে ইত্যাদি ইত্যাদি! সকল শুনিয়া নবীনের মনে হইল এক্ষুনি চৌদ্দ শিকের ভেতরে যাইয়া মাতালটাকে প্রবল উত্তম-মধ্যম দিয়া আসে! কিন্তু ইন্দু বিচার দিতে আসে নাই। সে তাহার স্বামীকে ছাড়াইতে আসিয়াছে। নবীন বুঝাইল ইন্দুকে- সে যে-ই ধারার অপরাধ করিয়াছে তাহাকে এইভাবে ছাড়া যায় না! ইহা নবীনের হস্তে নাই। পুলিশের কিছু আইন মানিয়া কার্য্য করিতে হয়। নবীন কহিল ‘তুমি একজন উলিকের সাথে কথা বলে জামিন করাতে পার কিনা দেখ’। ইন্দুর অত পাণ্ডিত্য নাই। নবীন কহিল ‘ঠিক আছে, আগে একজন উকিল তো খোঁজো, না হয় উকিলকে সাথে করেই নিয়ে আসবে।’ চক্ষু মুছিতে মুছিতে ইন্দু বিদায় লইল। তাহার এই দুর্গতি দেখিয়া সকাল বেলায় মনটি ভারাক্রান্ত হইল নবীনের। 


বিকালে ইন্দু পুনরায় আসিল। কনস্টেবল আসিয়া নবীনকে বলিল- 


  • স্যার, উনি আবার এসেছেন। সকালের সেই ভদ্রমহিলা। 
  • ভেতরে পাঠিয়ে দাও। 


ইন্দু একা আসে নাই। উকিল নিয়া আসিয়াছে। কালো গাউন পরিহিতা মহিলা উকিল। গাউনের নীচে সফেদ শাড়ী। শরীরে একটি অলংকার নাই। চেহারাটি ভাল করিয়া দেখে নাই নবীন। সে অপরিচিত রমণীগণের মুখও দেখিতে চাহে না সচরাচর। ইন্দুকে সম্ভাষণ করিয়া উকিলটিকেও বসিতে বলিলেন। উকিল একটি ফাইল তাহার সামনে বাড়াইয়া দিয়া কহিল- 'এই নিন স্যার আমার ক্লায়েন্টের বেইল পেপার।' কাহার কন্ঠস্বর শুনিল নবীন! বিনা মেঘে বজ্রপাতের ন্যায় চমকিত হইয়া সে মুখ তুলিয়া দেখিল। যাহা সে দেখিতে পাইতেছে আঁখির সম্মুখে তাহা সে জনম ভর আপনার করিয়া দেখিতে চাহিয়াছিল স্বপ্নঘোরে। ভাবিয়াছিল জীবনে কাহারো যদি সিঁথিতে সিন্দুর পড়াইতে হইবে এই সে। নচেৎ এই জন্মে সেই কার্য্য সে কভু করিবে না আর। কিন্তু আজ সেই নারীর সিঁথিতে কিছু নাই কেন? প্রচণ্ড আবেগে হয়ত আবোল-তাবোল ভাবনা আসিতেছে তাহার মনে। এই প্রশ্ন কেন সর্বাগ্রে মাথায় আসিবে? তবে কি প্রশ্ন আসা সঙ্গত? তবে কি ভাবনা আসা উচিত? কি বলিয়া তাহাকে ডাকা উচিত? নবীন যেন এক ঘোরের জগতে নামিয়া গিয়া কণ্ঠ তুলিয়া কহিল- 


‘সুলগ্না’


সুলগ্না এই বিস্মিত স্বরের প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন উত্তর করিল- ‘স্যার, হিয়ার ইজ দ্যা বেইল পেপার অফ মাই ক্লায়েন্ট’। নবীন এখনো ভাষা খুঁজিতেছে। কিন্তু ‘সুলগ্না’ এই একটি শব্দ ভিন্ন তাহার সকল কথা লুপ্ত হইল পৃথিবী হইতে। সে আবারও তাহাই বলিল। সুলগ্না এইবার আর কোন উত্তর না করিয়া ইন্দুকে কহিল, ‘আমি সব পেপার রেডি করে দিলাম। আমি বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করছি।’ 

'দাঁড়াও সুলগ্না’- এখন যেন কোথা হইতে শক্তি আহরণ করিয়া কিছু কথা প্রগলভের ন্যায় বলিতে পারে নবীন। সমস্ত যতিচিহ্নের বিনাশ করিয়া নবীন যেন এক নিশ্বাসে বলিতে লাগিল- 


‘তুমি কেমন আছ? তোমার বাবা কেমন আছেন? আমার এখানে পোস্টিং হবার আগে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। তোমার কথা শুনেছি। বলেছিলেন তুমি পড়াশোনা করছিলে শ্বশুরবাড়িতেও। তুমি আর গান গাও না রেডিওতে? তোমার বরেরও খুব প্রশংসা করেছিলেন কাকাবাবু। তাকেও একবার সঙ্গে করে- 


  • সে আর এই পৃথিবীতে নেই। এই বলিয়া সুলগ্না ইন্দুকে আবার বলিল ‘আমি বাইরে অপেক্ষা করছি, তুই আয় পরে।’ 


গ্রীষ্মদিনে ঝড়ের আগে যেমন বায়ুরুদ্ধ হইয়া থমথমে হইয়া যায় সব, তারপর ধীরে ধীরে মেঘ আসে- নবীনের হৃদয় তদ্রূপ হইল। আঁধার নামিবে একটু পর। তাহার ডিউটি টাইম শেষের বেলা। নবীন প্রস্তর মুরতির ন্যায় নির্বাক, স্তম্ভিত; দাঁড়াইয়া আছে যে দরজা দিয়া সুলগ্না বাহির হইয়া গেল সেই দরজার দিকে নিষ্পলক তাকাইয়া। আকাশবাণীর বৈকালিক অনুষ্ঠান আরম্ভ হইয়াছে কেবল - পুরনো অনুষ্ঠানের পুনঃপ্রচার হইতেছে আজ। বিধাতার কি পরিহাস- 


‘এখন শুনবেন শ্রীমতী সুলগ্না গঙ্গোপাধ্যায়ের কন্ঠে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত’ - প্রিলিউড শেষ করিয়া সেই কণ্ঠে বাজিয়া উঠিল- 


‘না বুঝে কারে তুমি ভাসালে আঁখিজলে। 

ওগো কে আছে চাহিয়া শূন্য পথপানে, 

কাহারো জীবনে নাহি সুখ, কাহার পরাণ জ্বলে। 

পড়নি কাহার নয়নের ভাষা 

বোঝনি কাহার মরমের আশা

দেখনি ফিরে, কার ব্যাকুল প্রাণের সাধ এসেছ দলে।।’ 


 



  

 







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

গ্রাস

  বুঝি আর আমাকে দিয়ে হবে না কিছুই। অসময়ে, অনাহুত, অতি অনভিপ্রেত জানি, সমস্ত বিবাদী উষ্মার অন্তরালে হারিয়ে যাব আমার এ যাবৎ যতনে গড়া সুরের ...