ভগবান লীলাছলে এই
জগতপ্রপঞ্চ রচিয়াছেন, তাহাতে প্রাণের সঞ্চার করিয়াছেন, প্রাণের স্পন্দনের অন্তরালে
তিনি দিয়াছেন চেতনা যাহাতে জীব একদা অনুভব করিতে পারে এই জগত তাহার রচনা, তিনি
জগতের স্বামী, তাহাকে জানিতে পারিলেই মুক্তি, তিনিই সকল জীবাত্মার একান্ত গতি!
আমরা তাঁহাকে জানিতে পারি না বলিয়াই এত দুর্দশায় পতিত হই। এই সংসারে একমাত্র তিনিই
সত্যসার, বাকী সকল অনিত্য, অসার, মিথ্যা ও জড়- এই বোধ নাই বলিয়াই আমরা এত পতিত, এত
তাপিত; তাঁহার শীতল করকমলের স্পর্শ হইতে বঞ্চিত। আমরা কেন এত ভ্রমে মজিয়া আছি?
সত্যকে অনুভব করিতে আমাদের এত অপারগতা কিসের? কেনই বা এই সংসারের বন্ধুর পথে
বারেবারে নানাভাবে হোঁচট খাইয়া পড়িলেও এই সংসার হইতে আমাদের আসক্তির লেশমাত্র উপশম
হয় না? আমরা কেনই বা এত ভগবদ্বিমুখ?
পৌরাণিক কথামালায় বিশ্বাসী
ভক্তশ্রেণী এই প্রশ্নের নিরসণে একটি মিশ্রিত তত্ত্ব ঠাহর করিয়াছিলেন। প্রথমত-
জীবের জন্মান্তরীন কর্মসংস্কার যাহা জীবের মুক্তির অন্তরায় হইয়া আসে বলিয়া তাহারা
বলিয়া থাকেন, দ্বিতীয়ত জগদীশ্বরের মায়া-ই ইহার কারণ, তিনি জগতকে মায়া দিয়া আচ্ছন্ন
করিয়াছেন, কেন করিয়াছেন- কেন না তিনি লীলা করিতে ভালবাসেন! এই ত্রিসংসার তাঁহার
ক্রীড়াভূমি! আমাদের অন্তর হইতে মায়ার আবরণ ঘুচিয়া গেলে তখনই আমরা তাঁহার এই লীলার
তাৎপর্য্য অনুধাবন করিতে সক্ষম হইব। বদ্ধজীবের কষ্টের কারণ তাঁহার লীলার গভীরে না
যাইয়া জড়জগতের অসার বস্তু সকল লইয়া মজিয়া থাকায়। ভক্তেরা বলেন- ইহাদের চৈতন্য নাই,
কারণ ইহাদের মতি ঈশ্বরের পথ হইতে দূরে। যদি এই প্রশ্ন আসে যে, যিনি সর্বনিয়ন্তা
তিনি চাহিলেই তো পারিতেন ইহাদের মতি নিমেষক্ষণে তাহার দিকে টানিয়া লইতে, তবে তিনি
তাহা করেন না কেন?- তখন এই প্রশ্নের কোন মননযোগ্য উত্তর ভক্তের মনে পড়ে না! তখন
বলিতে হয়- এও তাঁর লীলা, অথবা সেই কর্মফলবাদের পুরাতন খোঁড়া দোহাই! তাহারা
প্রারব্ধের বশে বদ্ধ। সংস্কার ক্ষয় না হইলে, সঞ্চিত কর্মের ফলভোগ না হইলে সেই গভীর
অন্তঃদৃষ্টি জন্মিবে না!
যদি আমাকে সত্য হইতে বঞ্চিত
করিয়া রাখা ভগবানের লীলা হইয়া থাকে- তাহা হইলে তেমন ভগবানকে একজন ক্রুর প্রবঞ্চক
ভিন্ন আর কি বলিব? যদি ইহা সত্য যে আমরা শুভাশুভ কর্মের ফল ভুগিতেছি মাত্র, এবং
অতীত কোন অশুভ কর্মের সংস্কার আমাদের বারেবারে একইরূপ হীনপথে ধাবিত করিতেছে যাহার ফলস্বরূপ আমাদের শুভবোধ জাগ্রত হইতে পারিতেছে না, তাহা হইলেও কয়েকটি গোড়ার প্রশ্ন
আসে- আমাদের প্রথম অশুভ কর্মটি কিরূপে হইয়াছিল? আমাদের মনে কেনই বা আদিমতম অশুভ
ভাবটি জন্মিয়াছিল? কেনই বা আমরা মোক্ষদ্বারনিরোধক পাপে নিয়োজিত হইয়াছিলাম? সেই
ক্ষণে বিধাতার কি ভূমিকা ছিল? আমাদের প্রবৃত্তি কি পূর্ব হইতে বিধাতার ইচ্ছানুসারী
ছিল না? নাকি আমরা প্রথম হইতেই ‘যাহা করিতে ইচ্ছুক, তাহাই করিব' এইরূপ মনোভাবাপন্ন
ও ভাবিতে স্বাধীন ছিলাম? যদি আমাদের কৃতকর্ম ও তাহার ফলের জন্য আমরাই একান্তভাবে
দায়ী রহি, তাহা হইলে ‘কোনকিছুই ঈশ্বরের ইচ্ছা ব্যতিরেকে ঘটে না’ এমন কথার কোন
যুক্তিসিদ্ধতা থাকে না! যদি আমাদের কৃতকর্মই আমাদের ভবিষ্যত নির্ধারণ করিয়া দিবে,
আমাদের কৃতকর্মই পারে আমাদের মোক্ষের পথে লইয়া যাইতে তাহা হইলে কেবলমাত্র সৎকর্মের
মাধ্যমেই তাহা করা সম্ভব, তাহার জন্য একজন ঈশ্বরের দয়ার অপেক্ষা করিতে হইবে কি?
আর যদি কেবল মাত্র তাঁহার
দয়া হইলেই তিনি আপনা প্রকাশিত হইবেন ও মোক্ষ দ্বার অবারিত করিবেন ইত্যাদি ভক্তিকথা
সত্য হয়- তাহা হইলে কর্মফলের দোহাইটিকে দূরে সরাইয়া রাখিতে হইবে! ‘একবার নাম নিলে যত
পাপ হরে, জীবের সাধ্য নাই তত পাপ করে’- লক্ষ পাপকর্ম করিয়াও জীব বলিবে আমি পাপ
করিয়াছি, তথাপি তব নামে আমি শরণাগত অতএব হে কর্মের ফলদাতা তুমি কৃপা করিয়া সকল দোষ
ক্ষালন করিয়াও লও! যদি কর্মের একজন ফলদাতা থাকেন তাহা হইলে কর্মের সহিত
কর্মফলবাদের ও ভাক্তিতত্ত্বের একটি মিশ্রণ দেখানো যাইতে পারে। নচেৎ হিন্দু দর্শনের
যে মৌলিক কর্মফলবাদ, তদাশ্রিত জন্মান্তরবাদ- তাহার সহিত ভক্তি-ভক্ত-ভগবানের
সুসম্পর্ক নাই!
জীব কুকর্মে কেন প্রবৃত্ত
হইল- এই প্রশ্নের অদ্যপি সদুত্তর হইল না। কি কুহকে পড়িয়া তাহার মনে অসদ্ভাব আসিল?
কেন আদম মর্ত্যে আসিয়া নিষিদ্ধ ফল খাইয়া ফেলিল? তাহার কেন জ্ঞাত হইল না এই ফলটি
খাইলে পাপ হইবে? আদমকে আমরা আমাদের প্রতিভূ করিয়া লইলাম তর্কের খাতিরে। ধরিয়া
লইলাম-
১। আদম যাহাই করেন তাহাই ঈশ্বরের গুপ্ত ইচ্ছা নহে,
আদম কিছু না কিছু স্বাধীন চিন্তানুসারে করিতে সক্ষম, সেই স্বাধীন ইচ্ছার বলবর্তী
হইয়া আদম একটি দুষ্কর্ম করিলেন, তাই তাহার শাস্তি হইল। এইখানে আমরা একটি সিদ্ধান্ত
পাইলাম যে, আদমেরও একটি সিদ্ধান্ত লইবার ক্ষমতা আছে। তিনি ঈশ্বরের হাতের যন্ত্র
বিশেষ নহেন!
২। আদম অজ্ঞাতসারেই এই মারাত্মক ভ্রমটি করিয়াছিলেন,
কেন না ঈশ্বর তাহার মনে একটি প্রেরণা জুগাইয়াছিলেন, অথবা ঈশ্বর এইরকম লীলা প্রকট
করিতেছিলেন যাহাতে আদম একটি নিমিত্তমাত্র- আদম ফল খাইবে, আদম শাস্তি পাইবে, এই
শাস্তির মাধ্যমে জগতে মানবজাতি আসিবে এবং মানবেরা ঈশ্বরের ভজনা করিবে! আমরা আরেকটি
সিদ্ধান্তে উপনীত হইলাম যে- আমরা ঈশ্বরের ঈচ্ছাধীন, তিনি যেমন চাহিতেছেন আমরা
সেইরূপে পরিচালিত হইতেছি!
৩। আদম অতি সরল চিত্তে একটি
ফল খাইয়াছে, তাহার এই সব যাবতীয় পাপ-পূণ্যের বোধ ছিল না, তিনি জ্ঞানত কাহারও কোন
ক্ষতি করিতে চাহেন নাই, তথাপি একটি ফল খাইয়া তাহার মনে একটি স্বাভাবিক জৈব প্রেরণা
জন্মিল, তিনি হাওয়ার সহিত মিলিত হইলেন- অতঃপর শাস্তি পাইলেন! কোনটি কি অর্থে
নিষিদ্ধ সে বোধ পূর্বে ছিল না, অদ্য তাহার মাধ্যমে সিদ্ধাসিদ্ধের নীতি উদিত হইবে।
এইখানে আদম ঈশ্বরের সম্মুখে একটি বলির পাঁঠা- যাহার কিছুই করিবার নাই! ইহা আরেকটি
সিদ্ধান্ত।
উপরোক্ত তিনটি সিদ্ধান্তের মধ্যে ভক্তগণ যে সময়ে যেটি প্রযোজ্য
সেইক্ষণে তাহারই প্রয়োগ করিয়া থাকেন! আমরা কি স্বাধীন? আমরা ভগবানের হাতের পুতুল?
আমাদের শুভাশুভ কর্মের নিয়ন্তা কি ভগবান স্বয়ং?- এই সকল প্রশ্নের যথাবিহিত উত্তর
ভক্তের হাতে নাই। ভক্ত বলেন ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর!’ তর্কসাঙ্গ
করিবার এই হল ভক্তের শেষ মহাস্ত্র! অতএব আমরা ভগবানকে কিরূপে জানিব? ভক্ত বলেন ‘তাঁহার
কৃপা হইলেই জানিতে পারিবে’! তাঁহার কৃপা কিরূপে হইবে? ‘তাঁহার আরাধনা, স্তুতি,
শুভকর্মে তিনি প্রসন্ন হইলে।‘ চিত্ত সেই পথে ধাবিত হয় না কেন? __
এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নহে!
ভক্ত সাধক বলেন- বারেবারে মনকে ঘষামাজা করিলে তাহা ক্রমে চকচক করিয়া উঠিবে। মন
পরিষ্কার হইলে তাহাতে তাঁহার প্রতিবিম্ব ভাসিবে। এই চেষ্টাটির নাম সাধনা, এটিই তো
তপস্যা! মনকে বারবার ফিরাইয়া আনা। ইন্দ্রিয়সুখ হইতে তুলিয়া ভগবদসুখে তাহাকে
প্রবৃত্ত করা! এই কাজ কি সহজ? ভক্ত এইখানে মনকে নিয়োজিত করিবার উপায় বলিতেছেন,
কিন্তু কোন দর্শনপ্রসূত সমাধানে আসিতে পারেন নাই! অথবা তিনি কেবলমাত্র তাঁর
স্ব-বিশ্বাসটিকে দর্শনের ভাষায় নামাইয়া একটি বিচিত্র খিচুড়ি বানাইতে চাহিয়াছিলেন!
এই চেষ্টায় জগতের তাবৎ ভক্তকূল জয়ী হইয়াছেন বটে! এই স্থলে ‘ভ্রাময়ণ সর্বভূতানি
যন্ত্ররূঢ়ানি মায়য়া’ বলেই শেষ করিতে হয়!
বেদান্ত বলিতেছে- ‘জগত
পরব্রহ্মের দ্বারা বস্ত্রের ন্যায় আচ্ছাদিত। তিনিই জগদ্রূপে প্রতিভাত হইতেছেন!’
আবার বলিতেছেন, আমরা তাহাকে জানিতে পারি না কারণ ‘পরব্রহ্ম আমাদের ইন্দ্রিয়সকলকে
বহির্মুখী করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন (পরব্রহ্ম কোন ব্যক্তিবাচক শব্দ নহে), সেইহেতু
আমরা আপনার গভীরে স্থিত পরমসত্ত্বাকে জানিতে না পারি। যাহারা ইন্দ্রিয়সমূহকে
গুটাইয়া নিজের ভেতরে দেখিতে পান- তাহাদের আত্মসাক্ষাৎকার হয়! পরব্রহ্ম একটি আলাদা
মিথ্যার আবরণ রচিয়াছেন, এই কথা বেদান্তের নহে! বেদান্ত বলে- সেই ব্রহ্ম
আনন্দস্বরূপ ও সর্বভূতে বিরাজমান! একটি আলাদা শক্তিশালী, সর্ব শক্তির অধীশ্বর,
যিনি যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে সক্ষম এমন কোন ব্যক্তিরূপসম্পন্ন ঈশ্বরের কথাকে এইখানে
প্রাধান্য দেয়া হয় নাই! আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহ বহির্মুখী বলিয়াই আমাদের অন্তঃদৃষ্টি
ক্ষীণ এই কথা বলিতেছে! কাহারো দয়ায় এই অন্তর্দৃষ্টি জাগিবে- এমন তত্ত্ব বেদান্তের
নহে। আমরা ঈশ্বরের মায়ায়, তাহার লীলায় আচ্ছন্ন হইয়াছি বলিয়া তাহাকে ভুলিয়া আছি- এই
কথাও আমাদের পুরাতনী বেদান্ত বলে না। বেদান্ত বলে- আমাদের স্বরূপ হইল আমাদেরই
অন্তস্থ ব্রহ্ম, আমরাই সত্যস্বরূপ, আমরা তথাপি ইহা উপলব্ধি করি না, কেন না আমরা-
অজ্ঞানে মগ্ন রহিয়াছি, আমরা অবিদ্যায় আচ্ছন্ন, আমরা আপনার গভীরে দেখিতে তৎপর নহি-
এই অপারগতাটিই ‘মায়া’! একটি অসত্যকে অসত্য বলিয়া অনুভব করিবার পরও তাহাতে আসক্ত
হইয়া পড়ি। কারণ কেহ আমাদের জাদু করিয়াছে বলিয়া নহে, কেহ আমাদের দৃষ্টিদুয়ার রোধ
করিয়াছে বলিয়া নহে- বরং আমরা আমাদ্বিগের ইন্দ্রিয় প্রভাবেই বাহিরের জগতকে সর্বদা
আত্মস্থ করিতে চাহি, যদ্যপি বাহিরের জগতটিই একটি আপেক্ষিক সত্য, নিয়ত পরিবর্তনশীল,
ইহাকে সত্যের ধ্রুবকমাণ ধরা চলিবে না! অদ্বৈত বেদান্ত জগতকে মিথ্যা বলিতেছে, কারণ
অদ্বৈত পথের সাধকেরা জন্মান্ধ! তাহা নহে। কিছু মূর্খ বুঝিতে পারে নাই! মিথা শব্দের
অর্থ- অনিত্য! যাহা আজ আছে কিন্তু কাল রহিবে না এমন কিছুকে স্থির সত্য কিরূপে বলিবে? তাঁহারা বলিতেছেন- কেবলমাত্র পরব্রহ্মই সত্য, একমাত্র অবিনশ্বর সত্য!
তাঁহারা বলিতেছেন- এই জগত প্রপঞ্চ একটি মায়া, একটি মিথ্যা! কি অর্থে? অবিদ্যায়
অন্ধজন এই সত্য উপলব্ধি করেন না যে এই প্রপঞ্চের অন্তরালে সেই ব্রহ্মেরই বিচরণ!
ব্রহ্মই সকল কিছুতে অধিষ্টিত। অন্ধজন জগতস্থিত ব্রহ্মকে না দেখিয়া বাহিরের
অস্থিচর্মসারটিকেই উপভোগ্য করিয়া দিনাতিপাত করে! এইরূপ মিথ্যা কালযাপনটিই
বেদান্তের ভাষায় মায়া! জগতকে এইরূপে দর্শনই মিথ্যা! জগতকে যখন কেবলমাত্র ভোগের
সামগ্রীভরপুর বলিয়া প্রতীতি হয়- তখনই বেদান্ত বলে ইহা অবিদ্যা, ইহা মায়া, ইহা
অজ্ঞান, ইহা মিথ্যা; আবার যখন জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত হয় তখন মানুষ দেখিতে পায়- আলাদা
করিয়া ভাবিবার মত কোন পরব্রহ্ম নাই, তিনি এই জগতেই, তিনি আমাতেই- এই উপলব্ধিটিই আত্মদর্শন।
তিনি নিজেকে জগত হইতেও আলাদা করেন না! জ্ঞানীর সে ভেদ ভাব নাই! ‘স্বীয় আত্মাকে
সর্বভূতে দেখা ও সর্বভূতের আত্মাকে স্বীয় আত্মায় দেখা’- এরই নাম ব্রহ্মোপলব্ধি! এরই
নাম অপরোক্ষানুভূতি! এটিই বেদান্ত বলে! মিথ্যা দৃষ্টিটি দূরে সরাইয়া সত্য
দৃষ্টিটিকে উন্মোচিত করা! আপনার অজ্ঞানতার দায়ভার কোন ঈশ্বরে প্রযুক্ত না করিয়া
স্বীয় চরিত্রবলে জ্ঞানারোহণের সাধনা এটি। সত্যকে
কেন জানিতে না পারি? কেন না আমরা মায়াচ্ছন্ন!
মায়া কি? মায়া মানে অজ্ঞান, অবিদ্যা, মিথ্যা! এই মায়া আত্মসঞ্জাত! কেহ সৃষ্টি করেন
নাই। তবে এই মায়া কিরূপে আসিল? কিরূপে আমরা এই মায়ায় মুগ্ধ হইলাম? এই জিজ্ঞাসার
উত্তর কি হইবে? অদ্বৈতও এইখানে বৈভবপূর্ণ উত্তর দিতে পারিয়াছে বলিয়া বোধ করি না!
তবে বেদান্তের ধারায় মনে হয়- মায়া একটি ঘটনা, যাহা নিত্য-ঘটমান, যাহা কার্যকারণ
সম্পর্কে উদ্ভূত নহে, ইহা ঘটিয়া চলিতেছে নিয়ত চোখের সম্মুখে তথাপি ইহার কোন
ব্যখ্যা নাই! মায়া একটি ব্যাখার অতীত সূত্র! যে মূর্খের দল অদ্বৈত বেদান্তের ‘মায়া’টি
কি তাহা ধরিতে পারে নাই- তাদের কাছে অদ্বৈত হইয়া গিয়াছে ‘মায়াবাদ’! যেহেতু অদ্বৈত
বেদান্ত একজন ‘মায়াপতি’ আবিষ্কার করিয়া ফেলে নাই যাহার ওপর সমস্ত অলৌকিকতার আলো
ফেলিয়া চিরকালের মত যুক্তিবিমুখ হইয়া কেবলমাত্র অন্ধানুসরণকেই পন্থা করিবে! যেহেতু
বেদান্ত যথাসম্ভব যুক্তিনিষ্ঠ হইবার প্রয়াস করিয়াছে, যেহেতু তাহারা ব্যখ্যাতীত
ঘটনাকে রঙ চড়াইয়া উপস্থাপিত করিতে পারে নাই সেহেতু তাহাদের দর্শন সকলের পাতে ভাল
রুচিল না! যেহেতু যুক্তির সাথে জুঝিয়া উঠিতে যে শক্তি লাগে তাহাও সকলের নাই,
সেহেতু হীনবল লোক যেমন পশ্চাতে থাকিয়া সবলের নিন্দাবাদকেই আপনার গৌরব ভাবিয়া থাকে,
তেমনি কেবল বিশ্বাসীর দল যুক্তিবাদের মুন্ডুপাত করিয়াই স্ব-গোত্রমধ্যে আহ্লাদিত!
মায়া, অজ্ঞান, অবিদ্যা,
মিথ্যা এইসকল খলদল কি হেতু ও কি রূপে আমাদের গ্রাসিল, তাহা লইয়া বিকট দর্শন না
রচিয়াও একজন ব্যক্তি ভারতবর্ষে সহস্র সূর্য্যের প্রভা লইয়া উদ্দীপিত হইয়াছিলেন! তিনি
তথাগত বুদ্ধ। তিনি বলিয়াছিলেন ইহা সত্য যে আমরা মায়া, অজ্ঞানের অন্ধকারে ডুবিয়া
আছি, ইহা সত্য যে আমরা অসত্যকে সত্য বলিয়া প্রাণপণে তাহাকে জড়াইয়া আছি- তবে কোথা
হইতে এইসকল আসিল তাহা ভাবিয়া দিনাতিপাত করা অপেক্ষা শ্রেয় নিজেকে এইসকল শৃঙ্ক্ষল
হইতে মুক্ত করা, নিজেদের মোক্ষের সাধনায় ব্রতী করা, এবং তাহা কোন পূর্ববর্তী
বিশ্বাসকে পূঁজি করিয়া নহে, সেই সাধনা হইবে অন্তরের অন্তস্থ সত্ত্বাটিকে জাগরিত
করিয়া, নিজের অন্তরকে দেখিতে চাহিয়া, সত্যকে নিজের ভেতর খুঁজিতে চাহিয়া মিলিবে সে
পথ- সে পথ গেছে নির্বাণের দিকে! অদ্বৈত বেদান্তের দর্শন এই সাধারণ কথাগুলিকে এতটা
সহজ করিয়া বলিতে পারে নাই যেরূপে ইনি প্রচারিলেন।
তথাপি আমরা কি পারিয়াছি তাহার কথাগুলিকেও
ধারণ করিতে? না, পারি নাই! আমরা চিরকাল বিশ্বাস করাকেই করিয়াছি বাঁচিবার পুঁজি!
যিনি বলেন নাই ভগবানে বিশ্বাস করিতে, কালক্রমে আমরা তাহাকেই ভগবান বানাইয়া পূজা
করিতে লাগিলাম! ইহাই আমাদের রীতি! আমাদের বিশ্বাসকে প্রস্তরীভূত করিবার জন্য,
আমাদের বিশ্বাসকে পরম্পরা বানাইবার জন্য আমরা কত গ্রন্থ লিখিলাম- ক্রমশ যুক্তি ও
দর্শনের সাধনাকে আমরা বিশ্বাসের হাড়িকাঠে আনিয়া ফেলিলাম! যে সকল তত্ত্ব হইল আমাদের
বুদ্ধির অগম্য তাহদের দূর-ছাই করিলাম, আমরা মূর্খ হইয়াও সংখ্যাগরিষ্ঠ হইয়াছি হেতু,
সংখ্যালঘুর সৌন্দর্য্যটিকে আমরা সদলবলে মিলিয়া কুৎসিত আখ্যা করিলাম! আমাদের এইসকল
কর্মে বিরাম নাই! ইহাও কি বিচিত্র মায়া!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন