রজ্জুতে সর্পভ্রম
কেন হইল?
১। হইতে পারে
দ্রষ্টার দৃষ্টি শক্তির দুর্বলতা রহিয়াছে।
২। রজ্জুর
উপরিভাগে পর্যাপ্ত আলোকের প্রক্ষেপণ না থাকায়
ভাল বুঝা যাইতেছিল না।
৩। দ্রষ্টা
অধিককাল যাবৎ সর্পচিন্তায় নিমগ্ন রহিয়াছিলেন বিধায় সকল কিছুর মধ্যে একটি সর্পত্ব পাইতেছেন
তিনি।
রজ্জুতে সর্পভ্রম
ব্যপারটিকে একটি
Hallucination রূপে প্রতিপাদিত করেন নাই শংকর।
তিনি বলিয়াছেন ইহা একটি Super-imposition.
যাহা বস্তুত যাহা নহে তাহাতে তদ্ভাবের ব্যঞ্জনা আনয়ণ
করা। এটিকে শঙ্কর বলিলেন ‘অধ্যারোপ’- অধি+আরোপ। রজ্জুতে সর্পভ্রম তেমনি একটি আরোপের
উপমা। রজ্জুকে সর্প মনে করিয়া দ্রষ্টা ভয়ার্ত হইতেছে। অথচ ইহা সর্পই নহে! ইহার নিহিত
তাৎপর্য্য হইল- একটি অচল জড় জগত যাহার বস্তুত স্বাধীন চৈতন্য নাই, তাহাতে কল্পিত চৈতন্যের
কল্পনা করিয়া আমরা আসক্ত হইতেছি, হাসিতেছি, কাঁদিতেছি! জগত নির্বিকার। ইহা ভালও নহে,
মন্দও নহে! আমরা যেইরূপে ভাবিতেছি, জগত সেইরূপে প্রতিভাত হইতেছে! ইহাই ভ্রম, ইহাই মায়া!
আরো আত্মিক স্তরে যাইয়া বলিতেছে বেদান্ত- দেহের সহিত যে মানবের আমিত্বের বন্ধন ইহাই
যে বড় মায়া। আত্মস্বরূপ ব্রহ্মকে না জানিয়া দিবসযামী এই দেহকে সর্বস্ব করিয়া চলাটিই
ভ্রম! জগতকে ব্রহ্মময় না দেখিয়া ইহাকে ভোগপ্রবৃত্তি সাধনের উপায়রূপে দেখিতে আমাদের
যে চেষ্টা ইহাই মায়া, ইহাই ভয়ংকর ভ্রম!
কেন এই ভ্রম?
উপরোক্ত তিনটি উত্তরের মধ্য দিয়া যাইতে চেষ্টা করিব। প্রথমে বলিয়াছি- দ্রষ্টার দুর্বল
দৃষ্টির কথা! দিনের আলোতেও সকলে একই প্রকার দেখিতে পায় না। সকলের দৃষ্টি সমান ক্ষমতা
সম্পন্ন নহে। যাহার দৃষ্টি যেমন সে তদসামর্থ্য
অনুযায়ী বস্তুকে দেখিতে পাইবে ও তাহার বর্ণনা করিবে। সুতরাং কাহারো দর্শন এইরূপে ভ্রমাত্মক হইতেই পারে।
দ্বিতীয় উত্তরানুযায়ী-
দ্রষ্টব্য বস্তু আলোকবঞ্চিত হইলে তাহাকে ভাল দেখিতে পারা যায় না। যাহা দেখিতে অস্পষ্ট
তাহা লইয়াও নানা জনের নানা মত উপস্থিত হওয়া কি অস্বাভাবিক?
তৃতীয় উত্তরানুযায়ী-
যে যে ভাব লইয়া সর্বদা আচ্ছন্ন থাকে তাহার সকল কার্য্যে সেই ভাবের প্রকাশ আপনি আসিয়া
পড়ে। মস্তিষ্ক কোন একটি বিষয় লইয়া অতিসক্রিয় হইয়া উঠিলে তাহার impact দীর্ঘস্থায়ী
হয়। ইহা তো বৈজ্ঞানিক ভাবেই সিদ্ধ সিদ্ধান্ত। এই কারণেও লোকের ভ্রমাত্মক দৃষ্টি জন্মাইতে
পারে ক্ষেত্রবিশেষে।
আমরা কে কি
কারণে ভ্রমে মজিতেছি ইহা আমাদেরই নিরূপণ করিতে হইবে। তবে এই সর্পভ্রম লইয়া আমার একটি
কূট প্রশ্ন জাগে। কেন রজ্জুতে সর্পেরই ভ্রম হইতে হইবে? অপর কিছুর ভ্রমাত্মক আরোপ হইবে
না কেন?
কেন না, রজ্জুতে
আরোপ করিবার উপযুক্ত অপর কোন চৈতন্যসম্পন্ন প্রাণীর কথা আমি জানি না! তাই সর্পই কল্পনা
করিতে হইল! ইহাও পরিপূর্ণ উত্তর
নহে। বরং বলিতে হয়, আমাদের সর্প সম্বন্ধিত পূর্বাভিজ্ঞতা এতটাই শক্তিশালী যে সাদৃশ্য
বিবেচনায় একটি বক্রাকারে শায়িত রজ্জু দেখিলে তাহার সহিত সর্পের যোগ অগ্রে উপস্থিত হয়।
আমার বক্তব্যের মূল সুরটি হইল- আমরা তাহাই আরোপ করিতে সক্ষম যাহা সম্বন্ধে আমাদের অতীত
জ্ঞান রহিয়াছে। যে ব্যক্তির সর্প সম্বন্ধে তিলমাত্র জ্ঞান নাই সে কি করিয়া সর্পভ্রমে
পতিত হইবে? জগত আমাদের অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাখ্যাত হইতেছে আমাদের নিকট। যাহার
অভিজ্ঞতা যত শুদ্ধ, যত গভীর, যত ব্যপ্ত তাহার দৃষ্টির পরিধিও তেমন হইবে! বিষয়াসক্ত
চিত্ত বিষয়ের বাহিরে কিছুতেই আনন্দ পায় না! চিত্ত যার যেখানে নিবিষ্ট সে তথায় আশ্রয়
লইবে। যে সুরাপায়ী নহে তাহাকে মাতলামির অনুভব বুঝাইতে পারা যাইবে না! সে সদা সর্বতোভাবে
সদাচারী তাহাকে কি করিয়া বুঝাইবে দুরাচারে কি সুখ! সকলের কাছে সুখ ও দুঃখের অনুভব আপন
আপন চরিত্রের ধরণ অনুযায়ী ধরা দেয়! জগতও তাহাদের কাছে তদ্রূপে প্রকাশিত হয়! ব্যর্থ
প্রেমিকের কাছে মনে হয়- এই জগত একটি প্রবঞ্চনা, তেমনি নব্য প্রেমিক মহীতলের সর্বত্র
বসন্ত দেখিতে পাইতেছে এক্ষণে! জগতকে কে কিরূপে দেখিতেছে তাহাতে জগতের ভ্রূক্ষেপ নাই!
ইহাই মায়া। অভিজ্ঞতাবাদ দর্শনের ঢঙে কহিলাম।
পূর্বেই
লিখিয়াছি- শঙ্কর ‘রজ্জুতে সর্পভ্রম’-কে একটি উপমা হিসাবে উল্লেখ করিয়াছেন। শঙ্কর ইহার
সহিত অধুনাতম ‘অভিজ্ঞতাবাদ’ জুড়িয়া দেন নাই! অভিজ্ঞতাবাদটি আমার ভাবনাপ্রসূত। সর্পের
ভ্রম হইতে আমাদের মুক্তি নাই। কেন না আমরা সর্প লইয়ায় দিবারাত্র আছি। অতএব সর্পের ভ্রম
হইবেই হইবে। সর্প হইতে দূরে সরিলেই রজ্জুর উপর সর্পের আরোপ আনিবার বৃত্তিটি ক্রমে নাশ
হইবে। ইহা সহজে বুঝিতে পারিবার মত কথা। দার্শনিক কূটবাক্য নাই ইহাতে কোন। সর্পের সহিত
দূরে রহিবার কথাটিই অদ্বৈত পথে ‘নেতি নেতি’! ‘ইহা নহে, ইহা নহে’! যাহা ব্রহ্ম নহে তাহা
হইতে দূরে রহো! ক্রমে সাধনফলে জানিবে- ‘সর্বং খলু ইদং ব্রহ্ম!’ যাহাতে ব্রহ্ম নাই ভাবিয়াছিলে,
পরে তাহাতেও ব্রহ্মদর্শন হইবে। ইহা অদ্বৈত সাধনার শেষ ফল! ইহাই মুক্তি।
সর্প
লইয়া কম ভাবিলেই সর্পের ভ্রম হইবার মাত্রা কমিবে! তবে ইহা করিতে যাইয়া কেহ ‘সর্পে রজ্জুভ্রম’
করিয়া বসিলে হিতে বিপরীত হইবে ইহা কে না বলিতে পারে। ইহাতে কিঞ্চিত বস্তুবাদের গন্ধ
ঢালিলাম শেষাংশে। পাঠক ইহার কি অর্থ করিবেন দেখি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন