বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৬

সনেটের সাতকাহন (১ম পর্ব)

মধুসূদন থেকে শেক্সপীয়র
----------------------------

সনেটের সাথে আমার যখন প্রথম আলাপ হচ্ছে তখন আমি নবম শ্রেণীর ছাত্র। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন এক সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সাগড়দাঁড়ির 'কপোতাক্ষ নদ' এর তীরে। ২০১৫ সালের কচুরিপানা আক্রান্ত শৌর্য শ্রীহীন কপোতাক্ষ সে নয়। কবি কপোতাক্ষের দিকে আঙুল দেখিয়ে আমাকে বলেছিলেন 'দ্যাখ এ হল বাংলার সনেট। আমার বয়স তখন পনের। আর সনেটের বয়স তখন সাড়ে সাতশ ছাড়িয়ে গেছে। বুড়ো সনেটের সাথে রসালাপ জমাতে স্বাভাবিক ভাবেই আমি ব্যার্থ ছিলাম।
বয়স যত বাড়তে লাগল বুড়ো সনেটের সাথে আমার ভাবও একটু একটু জমতে শুরু করেছিল। সতের আঠার বছরের কোন এক দিনে সনেটকে আমি আমার কবিতার খাতায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। সনেট স্বভাবে বড্ড গম্ভীর হলেও মনটা কিন্তু খুব ভাল। ধীরে ধীরে আমাদের বন্ধুত্ব হল। সনেটের বুকের ভেতরে যে এত কথা জমা তা কে জানত!
সনেট খুব সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলে। ইটালিতে জন্ম। বাবার নাম গায়াকোমো দ্যা লেনটিনি। সাধ করে ছেলের নাম রেখেছিলেন সনেট্টো। পরে ইংরেজ লোকগুলো তার সুন্দর নামটার এই অবস্থা করেছে। এতে অবশ্য সনেটের তেমন কোন কষ্ট নেই। সে মনে মনে খুশী। কারণ এই ইংরেজরা তাকে এভাবে এন্টারপ্রাইজ না করলে তার কি আজ এত দুনিয়াময় খ্যাতি হত? আর মধুসূদনও বা কোথায় পেতেন তাকে? আমিও বা কি করে জানতাম- সনেট নামের কেউ আছে পৃথিবীতে?
সনেটের মনে অবশ্য একটা বিরাট দুঃখ আছে। জানেন? পিতৃপরিচয় থাকলে কি হবে ওর কোন জন্মদিন হয়না! ওর জন্মের দিন ক্ষণ সন কেউ জানেনা। ওর উদাসীন বাপ ছেলে জন্মানোর পরেই কোথায় যে নিরুদ্দেশ হল সে খবর কারো কাছেই নেই। সনেটের শিশুকাল তাই কত অনিশ্চয়তা আর দুঃখের মধ্যে কেটেছে সে আর কি বলব। বারশ শতকের একটা সময় আরেক ইটালিয়ান কবি গুইত্তোন ডি আরেজ্জো তাকে সে অবস্থা থেকে উদ্ধার করে নিজের শহর তাসকানে নিয়ে আসেন। সেখানেই সনেটের বংশবিস্তার। আরেজ্জো সনেটকে প্রায় ২৫০ টা নতুন ভাই-বোন দেন। সনেট তো মহাখুশী! তবে ঝামেলা লাগল অন্য এক জায়গায়। সব ভাই-বোনের নামই যে সনেট! সনেটের এটাতে কেমন অস্বস্তি লাগে। এত সনেটের ভীড়ে সর্বপ্রথম সনেট কোনটা সেটা যে আর কেউ জানতেই পারল না!

আচ্ছা পেত্রার্কের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? - প্রশ্ন করেছিলাম বুড়ো সনেটকে।
- তোমরা শুধু ওই এক পেত্রার্ককেই চেনো। জানো আরেজ্জো কাকুর অনেক বন্ধুরাও আমাদের জন্য কম করেনি। যেমন ধর কবি দান্তে ও তাঁর বন্ধু গুইডো ক্যাবালকান্টি এরা সব অনেক বিস্তার ঘটিয়েছিল আমাদের বংশের।
- কিন্তু আমরা তো শুধু পেত্রার্কের নামই শুনি।
- সে তোমরা জানো না তাই। আমার বংশেতিহাস আমি জানব না! তবে মানছি পেত্রার্কার কৃতিত্ব অন্যদের চেয়ে বেশী ছিল। তোমরা বল যে ইটালিতে সবচেয়ে বেশী সুন্দর সনেট উনিই করেছিলেন। কিন্ত তারপরও আরেকজন ছিলেন যার কথা একেবারেই জানোনা হয়ত- চৌদ্দশতকের কবি মাইকেলেঞ্জেলো!

আসলেই তাই। কতকিছুই তো জানিনা দেখি। আমাদের অনেকেরই সনেটের দৌড় মধুসূদনে গিয়ে থমকে যায়। ইংরেজীতে সেটা বড়জোর শেক্সপীয়র পর্যন্ত এগোয়। পেত্রার্ক বা সেই সময়ের অন্যান্য সনেটিয়ারদের নিয়ে জানার সময় বা চেষ্টা কোথায়?  হালের কবিরা ছন্দ নিয়েই লিখতে চাননা সেখানে আবার সনেটের কি কথা? ছন্দ নিয়ে লিখতে না চাওয়া আর ছন্দ নিয়ে লিখতে না পারা কিন্তু এক ব্যাপার নয়! বিদেশের ছেলেমেয়েরা তাদের কাব্যকলার এইসব ক্ল্যাসিক্যাল দিকগুলো নিয়ে এখনো কিন্তু বিস্তর পড়াশোনা লেখালেখি করে যাচ্ছে। আর আমাদের বাংলায় স্বদেশী সাহিত্যের ঐতিহ্য নিয়ে ক'জনে মাথা ঘামায়? আফসোস করে বলেছিলাম এসব কথা সনেটকে। সনেটও হতাশ। চুপ করে ছিল গোমরা মুখে!

কেমন ছিল সেই মান্ধাতার দিনের ইতালিয়ান সনেট? আর অক্টেভ (প্রথম আট লাইন), সেসেস্ট (শেষ ছয় লাইন) এর বিভাজনই বা কেন? যতদুর শুনেছি সনেটের মুখে তার সারকথা হল এই- সনেট লেখা হত সবসময় কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে। প্রথম আট লাইনে উত্থাপন করা হত কোন প্রস্তাব, কোন একটা দর্শন, বা কোন একটা সামাজিক সমস্যা এসব। আর শেষ ছয় লাইনে থাকত উত্থাপিত প্রস্তাব, দর্শন এদের নিয়ে যুক্তি। সমস্যার জন্য সমাধান। তখন আমার মাথায় এলো কেন এই আট লাইন, ছ'লাইনের ভাগ সনেটের মাঝে! ১৪ লাইনের সনেটে ৯ম লাইনটিকে বলা হয় টার্ণ। ৯ম লাইন থেকেই সুর বদলে যায় সনেটের।

আচ্ছা সনেট কি শুধু ১৪ লাইনেই হয়?
- এটা জানার আগে তোমাকে আরো অনেক কিছুই জানতে হবে। - সনেটের ভারিক্কী উত্তর!
কি আর করা- সেদিন সন্ধ্যায় কি কারণে যেন সনেটের মেজাজ হঠাত করেই বিগড়ে গেল। তার কারন দ্বিতীয় পর্বে বলব। আজকে আর লিখছিনা খুব ক্ষিদে পেয়ে গেছে। (১৩/৭/২০১৫)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আমায় তুমি করছ আড়াল

  আমায় তুমি করছ আড়াল আঁচল ছায়ে তোমার কোলে, আমি বড়ই অধীর বাইরে যেতে বড়ই  ব্যাকুল, দুষ্ট ছেলে! বিশ্বভুবন দিচ্ছে সাড়া- 'ও তুই চোখ খুলে...