আমার মত গরীবেরা-
যারা বিশেষ্যে গরীব, গরীব বিশেষণেও।
যারা কামারশালার হাপরের মত ফুসফুস সম্পন্ন,
যাদের ঘামতে হয় মধ্য বয়সে গিয়েও রোদের নিচে
বাঁচার তাগিদে, যাদের অননুভূত অন্ধকার ফিসফিস করে
দিনের আলোতে, যে কোন দিন আসতে পারে বিনা আমন্ত্রণে
অগ্নিগর্ভ জৈষ্ঠের দিনে হাইওয়ের কঠিন কৃষ্ণ পিচে।
অভ্যর্থনার তোয়াক্কা না করে একদিন- আসতে পারে নিবিড় অন্ধকার,
আসতে পারে আমাদের রৌদ্রদগ্ধ সুঠাম শরীরে,
আসতে পারে আমাদের বাসনার জরায়ুমুখে- আসতে পারে ক্যান্সার
আসতে পারে আমাদের দুচোখের অনেক গভীরে-
জীবনের গুপ্ত অভিসার, সিনেমা হলের পাশে পুরাতন নোংরা গলিতে!
আমার মত গরীবের বিদীর্ন সংসার-
সে সংসারে কি প্রেম থাকে? যেখানে তেলের সংকট থাকে,
সংকট থাকে পেঁয়াজ হলুদ আদা রসুন ও নুনের?
সংকট থাকে অপরিসীম ভাবে দুমুটো খাবার-
আমাদের শিশুরা বাঁচে মালনিউট্রিশনে, শঙ্কা মনের-
কোনে থাকে লুকিয়ে একটু স্বস্তি পেতে অনেক ছাড়ার
বহুমূল্য কিছু, হয়ত অনেক কিছু যা ছিল গোটা জীবনের বাঞ্ছিত
অথবা নোনাজল পায়ে ফেলে সঞ্চিত ধন।
আমার মত গরীবেরা
যারা শাসনে গরীব, গরীব শোষনেও।
যাদের ক্রমবর্ধমান গরীবিয়ানা আছে সমাজতন্ত্রের দেশে
আছে গণতন্ত্রের গৌণ সংবিধানে, গরীব মারার সুস্থ পার্লামেন্ট
আছে বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর আমার অধিকারকে গিলে খাওয়ার, আমাকে পিষে-
বিশ্লিষ্ট করার অমর প্রত্যয় দানবকুলের, আমার হৃদয়-পিন্ড হাড় মজ্জা মাংস
জংবাজী জুনুন বামে ডানে অগ্রে ও পশ্চাতে, স্বগৃহে বা বনবাসে
আমাদের উপেক্ষার বর্জ্য বানিয়ে কাস্তে হাতুড়ী ঝান্ডাও করে প্রকান্ড প্রহসন,
বুর্জোয়াদের গুষ্টি উদ্ধার- চমৎকার যাত্রাপালা!
এ জীবনে কি প্রেম সাজে?
সাজে দুহাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করার স্বাধীন দম্ভ?
কাউকে 'একমাত্র' বলার দাবী চোখের ভুরু সুস্থির রেখে
অপলক রেখে চোখের মণি কোন মেঘাঙ্গীর চুলে ফেলা যায় কি উষ্ণ শ্বাস?
আমার মত গরীবেরা-
যারা ক্রমাগত জীবন দেখে স্বপ্নকে দিয়েছে দড়ি ফাঁস
দিয়েছে রুদ্ধ করে প্রেরণার গতিবেগ প্রস্তরবিদারী হাতে দিনে ও রাতে
যারা শুধু চলেছে ছুটে রুটি রুজি কামাইয়ে, নিয়মিত বারোমাস
তাদের কি সাজে প্রেমে পড়া, ডুবে মরা প্রতিদিন গহীন বিশ্বাসে,
যাদের আত্মশ্লাঘা, দুর্মুখ আত্মবিশ্বাস কোন এক কঠিন বেলচা করেছে সম্বল
নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে খুঁজে ফেরার হাতিয়ার তুলেছে আকাশে -গলদঘর্ম শ্রমে,
দুবেলা ভাতের অঙ্গীকার, মরার পর দু জোড়া ন্যায্য পিন্ড জল
অনিশ্চিত ফেরে এখানে ওখানে।
সেখানে আমাকেও কি মানায় কবিতা লেখা?
আমাকেও কি মানায় পান্ডুলিপি হাতে ঘুরে ঘুরে মরা ভ্যাপসা গরমে
পত্রিকা অফিসে, ম্যাগাজিনে ট্যাগাজিনে হন্য হয়ে বন্য প্রাণীর মত?
সস্তায় কথা বিকানোর কাজে মত্ত হয়ে ভুলে যাওয়া অমোঘ বাস্তব-
পেটের জ্বালা, শিশুর কান্না, গৃহিণীর ময়লা শাড়ী, দুমাসের ঘরভাড়া-
বাকী আছে, বাকী পরে থাক তামাম সংসার, পরে থাক তীব্র কলরব;
এইসব ভ্রষ্ট আবেগ কি আমাকেও মানাবে নজরুল কিম্বা মধুসূদনের মত?
আমার মত গরিবেরা
যারা গরীব প্রবন্ধে, গরীব কবিতায়
অনাকাঙ্খিত প্রসঙ্গ যারা কাগজের নিত্য কলামে, টিভি টকশোতে
রাজনীতির জঘন্য প্রলাপে যারা প্রয়োজনীয় উপাত্ত হয়, ভাঁড়ামিতে-
মুগ্ধ যারা ভোট দিতে পারে পিতৃহন্তাকে, ভয়ে যারা ভগবান বলতে পারে
কোন এক ছ্যাঁচড়া গুন্ডাকেও যার কুনজর লেগে গেছে কুলের সম্ভ্রমে,
আমাদের কি বাঁচতে নেই?
আমাদের কি হাসতে নেই প্রাণখুলে?
আমাদের কি গাইতে নেই 'জনগনমনঅধিনায়ক' ইত্যাদি স্কুল গান
সাধারণ নাগরিক হয়ে হেলেদুলে বাবুদের সাথে অন্তত একদিন?
আমাদের ভাবনা নেই, আমাদের বাক্য নেই, আমরা কি চেতনাবিহীন-
জড়খন্ড ঘুমিয়ে আছি শতাব্দী ধরে বাবুদের জুতোর নিচে?
আমাদের কি মুক্তি নেই? মুক্তি চাইতে নেই? ভালবাসতে নেই যেচে?
আমরা কি অর্থহীন? আমরা কি অস্তিত্বহীন? আমাদের সবটুকুই কি গেছে-
ধ্বংসের অনড় স্তূপের তলে আমাদের নির্বাক জন্মদিবসে?
১৩-৫-১৫
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন