কবি ও কবিতা নিয়ে
কবিগুরুর সুচিন্তিত ভাবনা ব্যক্ত হয়েছে তাঁর রচনাবলীর নানা অংশে। সেসব লেখনীর চুম্বক অংশ সমূহকে উদ্ধৃত করেই এই
নতুন লেখার অবতারণা
করছি, যার নাম দিয়েছি- ‘কবি চিন্তনে কবিগুরু।’
ভাবনা ১- কবিতায় ভাবকেন্দ্রিকতা
___________________ ______
কবিতায় বা অন্যান্য শিল্পকর্মেও কবি একটা নির্দিষ্ট ভাবকেন্দ্রিকতার আশ্রয় গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। একটা কবিতায় যেখানে একটা ভাব প্রকাশ করতে গেলে কয়েকটা অনুষঙ্গ ভাবেরও আবির্ভাব ঘটাতে হয় সেখানে অনেক কবি লেখকই খেই হারিয়ে ফেলেন। অনেক সময় দেখা যায় সেখানে মূখ্য ভাবটাই অস্পষ্ট হয়ে যায়। নাটকের ক্ষেত্রে এই ঘটনাটা অভিনয়ের হেরফেরে ঘটে যেতে দেখেছি। কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনয় দুর্বলতার কারণে পার্শ্বচরিত্র মহান হয়ে গেলেন। লেখালেখির ক্ষেত্রেও এমন হয়। কবিগুরুর মত হচ্ছে-
“.........যাহারা একেবারে সত্যের চারি দিক দেখাইতে চায়, তাহারা কোনো দিকই ভালো করিয়া দেখাইতে পারে না–তাহারা কতকগুলি কথা বলিয়া যায়, কিন্তু একটা ছবি দেখাইতে পারে না। একটা উদাহরণ দিলেই আমার কথা বেশ স্পষ্ট হইবে। একটা ছবি আঁকিতে হইলে, যথার্থত যে দ্রব্য যেরূপ, ঠিক সেরূপ আঁকা উচিত নহে। যখন চিত্রকর নিকটের গাছ বড়ো করিয়া আঁকে ও দূরের গাছ ছোটো করিয়া আঁকে, তখন তাহাতে এমন বুঝায় না যে বাস্তবিকই দূরের গাছগুলি আয়তনে ছোটো। একজন যদি কোনো ছবিতে সব গাছগুলি সমআয়তনে আঁকে, তবে তাহাতে সত্য বজায় থাকে বটে, কিন্তু সে ছবি আমাদের সত্য বলিয়া মনে হয় না–অর্থাৎ তাহাতে সত্য আমাদের মনে অঙ্কিত হয় না। লেখার বিষয়েও তাহাই বলা যায়। আমি যে ভাবটা নিকটে দেখিতে পাই, সেই ভাবটাই যদি বড়ো করিয়া না আঁকি, ও তাহার বিপরীত দিকের সীমান্ত যদি অনেকটা ক্ষুদ্র, অনেকটা ছায়াময়, অনেকটা অদৃশ্য করিয়া না দিই–তবে তাহাতে কোনো উদ্দেশ্যই ভালো করিয়া সাধিত হয় না; না সমস্তটার ভালো ছবি পাওয়া যায়, না এক অংশের ভালো ছবি পাওয়া যায়। এইজন্যই লেখক-চিত্রকরদিগকে পরামর্শ দেওয়া যায়, যে যে-ভাবটাকে কাছে দেখিতেছ, তাহাই বড়ো করিয়া আঁকো; ভাবিয়া চিন্তিয়া, বিচার করিয়া, সত্যের সহিত পরামর্শ করিয়া–ন্যায়কে বজায় রাখিবার জন্য তাহাকে খাটো করিবার কোনো আবশ্যক নাই।”
কবিতায় বা অন্যান্য শিল্পকর্মেও কবি একটা নির্দিষ্ট ভাবকেন্দ্রিকতার আশ্রয় গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। একটা কবিতায় যেখানে একটা ভাব প্রকাশ করতে গেলে কয়েকটা অনুষঙ্গ ভাবেরও আবির্ভাব ঘটাতে হয় সেখানে অনেক কবি লেখকই খেই হারিয়ে ফেলেন। অনেক সময় দেখা যায় সেখানে মূখ্য ভাবটাই অস্পষ্ট হয়ে যায়। নাটকের ক্ষেত্রে এই ঘটনাটা অভিনয়ের হেরফেরে ঘটে যেতে দেখেছি। কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনয় দুর্বলতার কারণে পার্শ্বচরিত্র মহান হয়ে গেলেন। লেখালেখির ক্ষেত্রেও এমন হয়। কবিগুরুর মত হচ্ছে-
“.........যাহারা একেবারে সত্যের চারি দিক দেখাইতে চায়, তাহারা কোনো দিকই ভালো করিয়া দেখাইতে পারে না–তাহারা কতকগুলি কথা বলিয়া যায়, কিন্তু একটা ছবি দেখাইতে পারে না। একটা উদাহরণ দিলেই আমার কথা বেশ স্পষ্ট হইবে। একটা ছবি আঁকিতে হইলে, যথার্থত যে দ্রব্য যেরূপ, ঠিক সেরূপ আঁকা উচিত নহে। যখন চিত্রকর নিকটের গাছ বড়ো করিয়া আঁকে ও দূরের গাছ ছোটো করিয়া আঁকে, তখন তাহাতে এমন বুঝায় না যে বাস্তবিকই দূরের গাছগুলি আয়তনে ছোটো। একজন যদি কোনো ছবিতে সব গাছগুলি সমআয়তনে আঁকে, তবে তাহাতে সত্য বজায় থাকে বটে, কিন্তু সে ছবি আমাদের সত্য বলিয়া মনে হয় না–অর্থাৎ তাহাতে সত্য আমাদের মনে অঙ্কিত হয় না। লেখার বিষয়েও তাহাই বলা যায়। আমি যে ভাবটা নিকটে দেখিতে পাই, সেই ভাবটাই যদি বড়ো করিয়া না আঁকি, ও তাহার বিপরীত দিকের সীমান্ত যদি অনেকটা ক্ষুদ্র, অনেকটা ছায়াময়, অনেকটা অদৃশ্য করিয়া না দিই–তবে তাহাতে কোনো উদ্দেশ্যই ভালো করিয়া সাধিত হয় না; না সমস্তটার ভালো ছবি পাওয়া যায়, না এক অংশের ভালো ছবি পাওয়া যায়। এইজন্যই লেখক-চিত্রকরদিগকে পরামর্শ দেওয়া যায়, যে যে-ভাবটাকে কাছে দেখিতেছ, তাহাই বড়ো করিয়া আঁকো; ভাবিয়া চিন্তিয়া, বিচার করিয়া, সত্যের সহিত পরামর্শ করিয়া–ন্যায়কে বজায় রাখিবার জন্য তাহাকে খাটো করিবার কোনো আবশ্যক নাই।”
ভাবনা ২- কবিতায় বার্তা
ও দেশকাল সম্বন্ধ
_________________________________
ইদানীংকালে আমরা কম বেশী একটা কথা শুনে থাকি- কবিতার মেসেজ! একটি কবিতা আমাদের কাছে কি বার্তা বহন করে আনছে তার ওপর খুব জোর দিই। বার্তাবাহী না হলে কবিতা যেন সার্থক কবিতা-ই নয়। তাহলে তো বলতে হয় সুকুমার রায় কোন সার্থক কবি নন। নারায়ণ গাঙ্গুলি কোন সার্থক লেখক নন। তাঁরা সাহিত্যের আনন্দে সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন। কোন স্থান-কাল-পাত্র প্রসূত ভাবনায় তাড়িত হয়ে নয়। সেটাই সুসাহিত্য যা স্বতস্ফূর্ত ভাবে মন থেকে নির্গত হয়। মস্তিষ্কের চিন্তা থেকে অনেক মহৎ কিছু বেরুতে পারে কিন্তু সেটা সর্বক্ষেত্রে যে সাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত হবে তেমন কিন্তু নয়। কবিগুরুর সময়েও এই আলোচনা উঠেছিল যে- যে কবিতা দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে লেখা হয় সেসব কৃত্রিম কবিতা। কারণ কবি নিজের রঙে লিখছেন ওসব। যাদের বাস্তবিক সত্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রশবিদ্ধ। অর্থাৎ কবিতার বার্তায় গন্ডগোল! যেটা আমরা ইদানীং শুনি। কাজেই সেসব কবিতাকে সুকবিতা বলা যায় না। কবিগুরু এই যুক্তির দ্বিমত পোষন করে লিখেছিলেন-
“কবিতায় কৃত্রিমতা দোষার্হ, এ বিষয়ে কাহারো দ্বিমত থাকিতে পারে না। কিন্তু যখন লেখক এই সাধারণ মত ব্যক্ত না করিয়া কতকগুলি বিশেষ মতের অবতারণা করিয়াছেন, তখনই তাঁহার সহিত আমাদের মতান্তর উপস্থিত হয়। যখন তিনি বলেন, দেশকালপাত্র-বর্হিভূত হইলে কবিতা কৃত্রিম হয় ও আধুনিক বঙ্গীয় কবিতা দেশকালপাত্র-বর্হিভূত হইতেছে, সুতরাং কৃত্রিম হইতেছে, তখনই তাঁহার সহিত আমরা সায় দিতে পারি না।
“দেশকালপাত্র” কথাটাই একটা প্রকাণ্ড ভাঙা কুলা–উহার উপর দিয়া অনেক ছাই ফেলা গিয়াছে। কোনো বিষয়ে কোনো পরিবর্তন দেখিয়া ব্যক্তি বিশেষের তাহা খারাপ লাগিলেই তৎক্ষণাৎ তিনি দেশকালপাত্রের দোহাই দিয়া তাহার নিন্দা করিয়া থাকেন। যখন কোনো যুক্তিই নাই, তখনো দেশকালপাত্র মাটি কামড়াইয়া আছে।”
কবিতা বা অন্য যেকোন সাহিত্যকে এরকম দেশ কালের ক্ষুদ্র গন্ডীতে আনা যায় না। আমরা অনেকেই এ ক্ষেত্রে প্রাচীন কবিদের সাথে আধুনিক কবিদের সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু করে দিই। প্রাচীনেরা যদি ওভাবে লিখতে পারতেন তো আমাদের লিখতে অসুবিধে কোথায় হচ্ছে। এই আলোচনা নিরর্থক। এরকম একটা অভিযোগের উত্তরে কবিগুরু লিখছেন-
“আমাদের আধুনিক কবিরা দেশকালপাত্রের ব্যভিচার করিয়া কবিতা লেখেন। কী তাহার প্রমাণ? না আমাদের প্রাচীন কবিরা যেভাবে কবিতা লিখিতেন, এখনকার কবিরা সেভাবে কবিতা লেখেন না, কথাটা যদি সত্য হয় তবে তাহা হইতে কি ইহাই প্রমাণ হইতেছে না যে, বাস্তবিকই দেশকালপাত্রের পরিবর্তন হইয়াছে; নহিলে, কখনোই লেখার এরূপ পরিবর্তন ঘটিতেই পারিত না! অতএব লেখক যদি বলেন, যে, প্রাচীন কবিরা যেরূপ লিখিতেন, আমাদেরও সেইরূপ লেখা উচিত–তাহা হইলে আর-এক কথায় এই বলা হয় যে, দেশকালপাত্রের ব্যভিচার করিয়াই কবিতা লেখা উচিত।
ইংরাজি পড়িয়াই হউক, আর যেমন করিয়াই হউক, আমাদের মনের যে পরিবর্তন হইয়াছে সে নিশ্চয়ই। একবার লেখক বিবেচনা করিয়া দেখুন দেখি–তিনি যে প্রবন্ধটি লিখিয়াছেন (অভিযোগকারীর প্রবন্ধ), তাহার ভাষা-বিন্যাস, তাহার ভাব-ভঙ্গি, তাহার রচনা প্রণালী, পঞ্চাশ বৎসর পূর্বেকার বাংলা হইতে কত তফাত।”
যারা এখনও মনে করেন কবিকে কেবল তার কবিতাকে সামজিক বার্তার আধার করে তুলতে হবে তাঁদের জন্য কবিগুরুর এই কয়েকটা কথা-
“প্রকৃত কথা এই যে, সমাজকে সমাজ বলিয়াই খাতির করা, এবং দেশকালপাত্রের অন্ধ অনুসরণ করিয়া চলা কবিরা পারিয়া উঠেন না। প্রবহমান সমাজের উপর যে-সকল ফেনা, যে-সকল তৃণখণ্ড ভাসে তাহা তো আজ আছে কাল নাই, কবিরা সেই ভাসমান খড়-কুটায় বাঁধিয়া তাঁহাদের কবিতাকে সমাজের স্রোতে ভাসান দিতে চান না। সেই স্রোতের বাহিরেই তাঁহারা ধ্রুব আশ্রয়ভূমি দেখিতে পান। সামাজিক নীতি ও সামাজিক নিয়ম প্রভৃতিরা সমাজের কাছে ঠিকা কাজে নিযুক্ত আছে–যতদিন তাহাদের আবশ্যক, ততদিন তাহারা মাহিয়ানা পায়, আবশ্যক ফুরাইলেই তাহাদের ছাড়াইয়া দেওয়া হয়–সমাজের সকল অবস্থায় তাহারা কাজ করিতে পারে না। সমাজের এই ঠিকা চাকরদের চাকরি করা কবিদের পোষায় না। এক কথায় বলিতে গেলে কবিদিগকে অনেক সময়ে অসামাজিক হইতেই হইবে। কারণ, সমাজ এখনো সম্পূর্ণ হয় নাই, সর্বাঙ্গসুন্দর হয় নাই–সমাজ যাহাকে ভালো বলে, তাহা মন্দের ভালো, তাহা বাস্তবিক ভালো নহে–আবার সমাজ স্বয়ং মন্দ বলিয়া অনেক ভালোও সমাজের পক্ষে মন্দ হইয়াছে। কবিরা যথার্থ ভালোকে ভালো বলেন, ও যথার্থ মন্দকে মন্দ বলিতে চাহেন, তাহাতে ফল হয় এই যে–যাহাতে মন্দকে আমাদের চাকরি হইতে ছাড়াইয়া দিতে পারি, অর্থাৎ মন্দ আমাদের কাজে না লাগিতে পারে ক্রমে এমন অবস্থা হয়,আর ভালোর উপযোগী হইতে পারি এইরূপ চেষ্টা করিতে পারি। নহিলে, ক্ষণিক ভালোকে ভালো বলিয়া জানিলে, ও ক্ষণিক মন্দকে মন্দ বলিয়া জানিলে তাহারাই চিরস্থায়ী ভালোমন্দরূপে পরিণত হয়–এবং ভালোই হউক, মন্দই হউক, পরিবর্তনের নাম মাত্র শুনিলেই আমরা ডরাইয়া উঠি। সমাজকে দাসভাবে অনুসরণ করিয়া না চলিলে কবিদের এই একটি মহৎ উপকার হয়-যখন সমাজের উপর দিয়া সহস্র বৎসরের পরিবর্তন চলিয়া গিয়াছে, যখন এক সমাজ ভাঙিয়া আর-এক সমাজ গঠিত হইয়াছে, যখন চারি দিকে সকলই ভাঙিতেছে গড়িতেছে–তখনও তাঁহাদের কবিতা দীপস্তম্ভের ন্যায় সমুদ্রের মধ্যে অটল ভাবে দাঁড়াইয়া থাকে। নতুবা সমাজের প্রত্যেক তরঙ্গের সহিত উঠিয়া পড়িয়া তাহারা কোথায় মিলাইয়া যায়।”
_________________________________
ইদানীংকালে আমরা কম বেশী একটা কথা শুনে থাকি- কবিতার মেসেজ! একটি কবিতা আমাদের কাছে কি বার্তা বহন করে আনছে তার ওপর খুব জোর দিই। বার্তাবাহী না হলে কবিতা যেন সার্থক কবিতা-ই নয়। তাহলে তো বলতে হয় সুকুমার রায় কোন সার্থক কবি নন। নারায়ণ গাঙ্গুলি কোন সার্থক লেখক নন। তাঁরা সাহিত্যের আনন্দে সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন। কোন স্থান-কাল-পাত্র প্রসূত ভাবনায় তাড়িত হয়ে নয়। সেটাই সুসাহিত্য যা স্বতস্ফূর্ত ভাবে মন থেকে নির্গত হয়। মস্তিষ্কের চিন্তা থেকে অনেক মহৎ কিছু বেরুতে পারে কিন্তু সেটা সর্বক্ষেত্রে যে সাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত হবে তেমন কিন্তু নয়। কবিগুরুর সময়েও এই আলোচনা উঠেছিল যে- যে কবিতা দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে লেখা হয় সেসব কৃত্রিম কবিতা। কারণ কবি নিজের রঙে লিখছেন ওসব। যাদের বাস্তবিক সত্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রশবিদ্ধ। অর্থাৎ কবিতার বার্তায় গন্ডগোল! যেটা আমরা ইদানীং শুনি। কাজেই সেসব কবিতাকে সুকবিতা বলা যায় না। কবিগুরু এই যুক্তির দ্বিমত পোষন করে লিখেছিলেন-
“কবিতায় কৃত্রিমতা দোষার্হ, এ বিষয়ে কাহারো দ্বিমত থাকিতে পারে না। কিন্তু যখন লেখক এই সাধারণ মত ব্যক্ত না করিয়া কতকগুলি বিশেষ মতের অবতারণা করিয়াছেন, তখনই তাঁহার সহিত আমাদের মতান্তর উপস্থিত হয়। যখন তিনি বলেন, দেশকালপাত্র-বর্হিভূত হইলে কবিতা কৃত্রিম হয় ও আধুনিক বঙ্গীয় কবিতা দেশকালপাত্র-বর্হিভূত হইতেছে, সুতরাং কৃত্রিম হইতেছে, তখনই তাঁহার সহিত আমরা সায় দিতে পারি না।
“দেশকালপাত্র” কথাটাই একটা প্রকাণ্ড ভাঙা কুলা–উহার উপর দিয়া অনেক ছাই ফেলা গিয়াছে। কোনো বিষয়ে কোনো পরিবর্তন দেখিয়া ব্যক্তি বিশেষের তাহা খারাপ লাগিলেই তৎক্ষণাৎ তিনি দেশকালপাত্রের দোহাই দিয়া তাহার নিন্দা করিয়া থাকেন। যখন কোনো যুক্তিই নাই, তখনো দেশকালপাত্র মাটি কামড়াইয়া আছে।”
কবিতা বা অন্য যেকোন সাহিত্যকে এরকম দেশ কালের ক্ষুদ্র গন্ডীতে আনা যায় না। আমরা অনেকেই এ ক্ষেত্রে প্রাচীন কবিদের সাথে আধুনিক কবিদের সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু করে দিই। প্রাচীনেরা যদি ওভাবে লিখতে পারতেন তো আমাদের লিখতে অসুবিধে কোথায় হচ্ছে। এই আলোচনা নিরর্থক। এরকম একটা অভিযোগের উত্তরে কবিগুরু লিখছেন-
“আমাদের আধুনিক কবিরা দেশকালপাত্রের ব্যভিচার করিয়া কবিতা লেখেন। কী তাহার প্রমাণ? না আমাদের প্রাচীন কবিরা যেভাবে কবিতা লিখিতেন, এখনকার কবিরা সেভাবে কবিতা লেখেন না, কথাটা যদি সত্য হয় তবে তাহা হইতে কি ইহাই প্রমাণ হইতেছে না যে, বাস্তবিকই দেশকালপাত্রের পরিবর্তন হইয়াছে; নহিলে, কখনোই লেখার এরূপ পরিবর্তন ঘটিতেই পারিত না! অতএব লেখক যদি বলেন, যে, প্রাচীন কবিরা যেরূপ লিখিতেন, আমাদেরও সেইরূপ লেখা উচিত–তাহা হইলে আর-এক কথায় এই বলা হয় যে, দেশকালপাত্রের ব্যভিচার করিয়াই কবিতা লেখা উচিত।
ইংরাজি পড়িয়াই হউক, আর যেমন করিয়াই হউক, আমাদের মনের যে পরিবর্তন হইয়াছে সে নিশ্চয়ই। একবার লেখক বিবেচনা করিয়া দেখুন দেখি–তিনি যে প্রবন্ধটি লিখিয়াছেন (অভিযোগকারীর প্রবন্ধ), তাহার ভাষা-বিন্যাস, তাহার ভাব-ভঙ্গি, তাহার রচনা প্রণালী, পঞ্চাশ বৎসর পূর্বেকার বাংলা হইতে কত তফাত।”
যারা এখনও মনে করেন কবিকে কেবল তার কবিতাকে সামজিক বার্তার আধার করে তুলতে হবে তাঁদের জন্য কবিগুরুর এই কয়েকটা কথা-
“প্রকৃত কথা এই যে, সমাজকে সমাজ বলিয়াই খাতির করা, এবং দেশকালপাত্রের অন্ধ অনুসরণ করিয়া চলা কবিরা পারিয়া উঠেন না। প্রবহমান সমাজের উপর যে-সকল ফেনা, যে-সকল তৃণখণ্ড ভাসে তাহা তো আজ আছে কাল নাই, কবিরা সেই ভাসমান খড়-কুটায় বাঁধিয়া তাঁহাদের কবিতাকে সমাজের স্রোতে ভাসান দিতে চান না। সেই স্রোতের বাহিরেই তাঁহারা ধ্রুব আশ্রয়ভূমি দেখিতে পান। সামাজিক নীতি ও সামাজিক নিয়ম প্রভৃতিরা সমাজের কাছে ঠিকা কাজে নিযুক্ত আছে–যতদিন তাহাদের আবশ্যক, ততদিন তাহারা মাহিয়ানা পায়, আবশ্যক ফুরাইলেই তাহাদের ছাড়াইয়া দেওয়া হয়–সমাজের সকল অবস্থায় তাহারা কাজ করিতে পারে না। সমাজের এই ঠিকা চাকরদের চাকরি করা কবিদের পোষায় না। এক কথায় বলিতে গেলে কবিদিগকে অনেক সময়ে অসামাজিক হইতেই হইবে। কারণ, সমাজ এখনো সম্পূর্ণ হয় নাই, সর্বাঙ্গসুন্দর হয় নাই–সমাজ যাহাকে ভালো বলে, তাহা মন্দের ভালো, তাহা বাস্তবিক ভালো নহে–আবার সমাজ স্বয়ং মন্দ বলিয়া অনেক ভালোও সমাজের পক্ষে মন্দ হইয়াছে। কবিরা যথার্থ ভালোকে ভালো বলেন, ও যথার্থ মন্দকে মন্দ বলিতে চাহেন, তাহাতে ফল হয় এই যে–যাহাতে মন্দকে আমাদের চাকরি হইতে ছাড়াইয়া দিতে পারি, অর্থাৎ মন্দ আমাদের কাজে না লাগিতে পারে ক্রমে এমন অবস্থা হয়,আর ভালোর উপযোগী হইতে পারি এইরূপ চেষ্টা করিতে পারি। নহিলে, ক্ষণিক ভালোকে ভালো বলিয়া জানিলে, ও ক্ষণিক মন্দকে মন্দ বলিয়া জানিলে তাহারাই চিরস্থায়ী ভালোমন্দরূপে পরিণত হয়–এবং ভালোই হউক, মন্দই হউক, পরিবর্তনের নাম মাত্র শুনিলেই আমরা ডরাইয়া উঠি। সমাজকে দাসভাবে অনুসরণ করিয়া না চলিলে কবিদের এই একটি মহৎ উপকার হয়-যখন সমাজের উপর দিয়া সহস্র বৎসরের পরিবর্তন চলিয়া গিয়াছে, যখন এক সমাজ ভাঙিয়া আর-এক সমাজ গঠিত হইয়াছে, যখন চারি দিকে সকলই ভাঙিতেছে গড়িতেছে–তখনও তাঁহাদের কবিতা দীপস্তম্ভের ন্যায় সমুদ্রের মধ্যে অটল ভাবে দাঁড়াইয়া থাকে। নতুবা সমাজের প্রত্যেক তরঙ্গের সহিত উঠিয়া পড়িয়া তাহারা কোথায় মিলাইয়া যায়।”
ভাবনা ৩ - কবি কে?
_____________________________
কবিগুরুর সময়কালে 'কবি কে?’ 'কবিতা কি?' এই জাতীয় বিষয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা সমালোচনা হত যা এই কালেও বিস্তর হচ্ছে। তখন 'নিরব কবি' নামে একটা কবির সংজ্ঞা আবির্ভূত হয়েছিল সম্ভবত যার নিরীখে কবিগুরু 'নীরব কবি ও অশিক্ষিত কবি নামে একটা সুচিন্তিত প্রবন্ধ লেখেন। সেই প্রবন্ধ থেকেই কিছু কিছু অংশ নিয়ে এই লেখা।
সব মানুষের ভেতরেই কম বেশি কবিত্বশক্তি আছে। প্রকাশ করার একটা নির্দিষ্ট ভঙ্গিমা-ই কারো কারো জন্য কবি পদবীটা বয়ে আনে। দুঃখের দিনে মানুষের প্রবল বিলাপ যদি কখনও মন দিয়ে শোনেন তাহলে একটা বিষয় আপনি উপলব্ধি করবেন মানুষটা নিজের অজান্তেই অনেক কাব্যিকতাপূর্ণ ভাষার ব্যবহার করছে যা সে স্বাভাবিক অবস্থায় করে না। ব্যার্থ প্রেমের হাহাকারে এটা বেশি শুনে থাকবেন। তাই একটা সাধারন ধারনা কবিদের সম্পর্কে নিম্নতর রুচির মানুষের থাকে- কবিরা ছ্যাকা খাওয়া পাবলিক! আবার একটা কথা প্রবল ভাবে চাউর আছে যে- প্রেমে পড়লে মানুষ কবি হয়। এটাকে সর্বৈব মিথ্যাও বলা যায় না। নতুন প্রেমিক, যে বাংলার 'ব'ও ভাল জানে না সেও প্রেমপত্র লেখার সময় খুব কাব্যিক হয়ে ওঠে। এই সাময়িক কবিত্বলাভ, বা কবিত্বভঙ্গির প্রকাশে কি কাউকে কবি বলা যাবে?
রবীন্দ্রচিন্তায় বিষয়টা কেমন? -
" একটা কথা উঠিয়াছে, মানুষ মাত্রেই কবি। যাহার মনে ভাব আছে, যে দুঃখে কাঁদে, সুখে হাসে, সেই কবি! কথাটা খুব নূতনতর। সচরাচর লোকে কবি বলিতে এমন বুঝে না। সচরাচর লোকে যাহা বলে তাহার বিপরীত একটা কথা শুনিলে অনেক সময় আমাদিগের ভারি ভালো লাগিয়া যায়।
যাহার মনোবৃত্তি আছে সেই কবি, এ কথাটা এখনকার যুবকদের মধ্যে অনেকেরই মুখে শুনা যায়। কবি শব্দের ঐরূপ অতিবিস্তৃত অর্থ এখন একটা ফ্যাসান হইয়াছে বলিলে অধিক বলা হয় না।.................. ভাবপ্রকাশের সুবিধার জন্য লোকসাধারণে একটি বিশেষ পদার্থের একটি বিশেষ নামকরণ করিয়াছে, সেই নামে তাহাকে সকলে ডাকিয়া থাকে ও অনেক দিন হইতে ডাকিয়া আসিতেছে, তাহা লইয়া আর তর্ক কী হইতে পারে? লোকে কাহাকে কবি বলে? যে ব্যক্তি বিশেষ শ্রেণীর ভাবসমূহ (যাহাকে আমরা কবিতা বলি) ভাষায় প্রকাশ করে।"
প্রকাশের পার্থক্যটাই একজন কবি ও অকবির মধ্যে ফারাক গড়ে দেয়। কবিগুরু এ ব্যাপারে বলছেন-
" এমন হয় বটে, যে, তুমি যাহাকে কবি বল আমি তাহাকে কবি বলি না; এই যুক্তির উপর নির্ভর করিয়া তুমি বলিতে পার বটে, যে, “যখন বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন লোকে কবি বলিয়া থাকে, তখন কি করিয়া বলা যাইতে পারে যে কবি বলিতে সকলেই এক অর্থ বুঝে? “ আমি বলি কি, একই অর্থ বুঝে! যখন পদ্যপুণ্ডরীকের গ্রন্থকার শ্রীযুক্ত রামবাবুকে তুমি কবি বলিতেছ, আমি কবি বলিতেছি না ও কবিতাচন্দ্রিকার গ্রন্থকার শ্রীযুক্ত শ্যামবাবুকে আমি কবি বলিতেছি তুমি বলিতেছ না, তখন তোমাতে আমাতে এই তর্ক যে, “রামবাবু কি এমন কবি যে তাঁহাকে কবি বলা যাইতে পারে?” বা, “শ্যামবাবু কি এমন কবি যে তাঁহাকে কবি বলা যাইতে পারে?” রামবাবু ও শ্যামবাবু এক স্কুলে পড়েন, তবে তাঁহাদের মধ্যে কে ফাষ্ট্ ক্লাসে পড়েন কে লাষ্ট্ ক্লাসে পড়েন তাহাই লইয়া কথা। রামবাবু ও শ্যামবাবু যে এক স্কুলে পড়েন, সে স্কুলটি কি? না, প্রকাশ করা। তাঁহাদের মধ্যে সাদৃশ্য কোথায়? না, প্রকাশ করা লইয়া। বৈসাদৃশ্য কোথায়? কিরূপে প্রকাশ করা হয় তাহা লইয়া। তবে, ভাল কবিতাকেই আমরা কবিতা বলি, কবিতা খারাপ হইলে তাহাকে আমরা মন্দ কবিতা বলি, সুকবিতা হইতে আরও দূরে গেলে তাহাকে আমরা কবিতা না বলিয়া শ্লোক বলিতে পারি, ছড়া বলিতে প্রবন্ধটির মধ্যে আড়ম্বর করিয়া কবিতা কথাটির একটি দুরূহ সংজ্ঞা নির্ণয় করিতে বসা সাজে না বলিয়া আমরা নিরস্ত হইলাম। পারি, যাহা ইচ্ছা। পৃথিবীর মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ জীবকে আমরা মানুষ বলি, তাহার কাছাকাছি যে আসে তাহাকে বনমানুষ বলি, মানুষ হইতে আরো তফাতে গেলে তাহাকে মানুষও বলি না, বনমানুষও বলি না, তাহাকে বানর বলি।"
যথেচ্ছা লেখাকে কবিতা বলা যায় না। তেমনি সব লেখককে কবিও বলা যায় না।
_____________________________
কবিগুরুর সময়কালে 'কবি কে?’ 'কবিতা কি?' এই জাতীয় বিষয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা সমালোচনা হত যা এই কালেও বিস্তর হচ্ছে। তখন 'নিরব কবি' নামে একটা কবির সংজ্ঞা আবির্ভূত হয়েছিল সম্ভবত যার নিরীখে কবিগুরু 'নীরব কবি ও অশিক্ষিত কবি নামে একটা সুচিন্তিত প্রবন্ধ লেখেন। সেই প্রবন্ধ থেকেই কিছু কিছু অংশ নিয়ে এই লেখা।
সব মানুষের ভেতরেই কম বেশি কবিত্বশক্তি আছে। প্রকাশ করার একটা নির্দিষ্ট ভঙ্গিমা-ই কারো কারো জন্য কবি পদবীটা বয়ে আনে। দুঃখের দিনে মানুষের প্রবল বিলাপ যদি কখনও মন দিয়ে শোনেন তাহলে একটা বিষয় আপনি উপলব্ধি করবেন মানুষটা নিজের অজান্তেই অনেক কাব্যিকতাপূর্ণ ভাষার ব্যবহার করছে যা সে স্বাভাবিক অবস্থায় করে না। ব্যার্থ প্রেমের হাহাকারে এটা বেশি শুনে থাকবেন। তাই একটা সাধারন ধারনা কবিদের সম্পর্কে নিম্নতর রুচির মানুষের থাকে- কবিরা ছ্যাকা খাওয়া পাবলিক! আবার একটা কথা প্রবল ভাবে চাউর আছে যে- প্রেমে পড়লে মানুষ কবি হয়। এটাকে সর্বৈব মিথ্যাও বলা যায় না। নতুন প্রেমিক, যে বাংলার 'ব'ও ভাল জানে না সেও প্রেমপত্র লেখার সময় খুব কাব্যিক হয়ে ওঠে। এই সাময়িক কবিত্বলাভ, বা কবিত্বভঙ্গির প্রকাশে কি কাউকে কবি বলা যাবে?
রবীন্দ্রচিন্তায় বিষয়টা কেমন? -
" একটা কথা উঠিয়াছে, মানুষ মাত্রেই কবি। যাহার মনে ভাব আছে, যে দুঃখে কাঁদে, সুখে হাসে, সেই কবি! কথাটা খুব নূতনতর। সচরাচর লোকে কবি বলিতে এমন বুঝে না। সচরাচর লোকে যাহা বলে তাহার বিপরীত একটা কথা শুনিলে অনেক সময় আমাদিগের ভারি ভালো লাগিয়া যায়।
যাহার মনোবৃত্তি আছে সেই কবি, এ কথাটা এখনকার যুবকদের মধ্যে অনেকেরই মুখে শুনা যায়। কবি শব্দের ঐরূপ অতিবিস্তৃত অর্থ এখন একটা ফ্যাসান হইয়াছে বলিলে অধিক বলা হয় না।.................. ভাবপ্রকাশের সুবিধার জন্য লোকসাধারণে একটি বিশেষ পদার্থের একটি বিশেষ নামকরণ করিয়াছে, সেই নামে তাহাকে সকলে ডাকিয়া থাকে ও অনেক দিন হইতে ডাকিয়া আসিতেছে, তাহা লইয়া আর তর্ক কী হইতে পারে? লোকে কাহাকে কবি বলে? যে ব্যক্তি বিশেষ শ্রেণীর ভাবসমূহ (যাহাকে আমরা কবিতা বলি) ভাষায় প্রকাশ করে।"
প্রকাশের পার্থক্যটাই একজন কবি ও অকবির মধ্যে ফারাক গড়ে দেয়। কবিগুরু এ ব্যাপারে বলছেন-
" এমন হয় বটে, যে, তুমি যাহাকে কবি বল আমি তাহাকে কবি বলি না; এই যুক্তির উপর নির্ভর করিয়া তুমি বলিতে পার বটে, যে, “যখন বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন লোকে কবি বলিয়া থাকে, তখন কি করিয়া বলা যাইতে পারে যে কবি বলিতে সকলেই এক অর্থ বুঝে? “ আমি বলি কি, একই অর্থ বুঝে! যখন পদ্যপুণ্ডরীকের গ্রন্থকার শ্রীযুক্ত রামবাবুকে তুমি কবি বলিতেছ, আমি কবি বলিতেছি না ও কবিতাচন্দ্রিকার গ্রন্থকার শ্রীযুক্ত শ্যামবাবুকে আমি কবি বলিতেছি তুমি বলিতেছ না, তখন তোমাতে আমাতে এই তর্ক যে, “রামবাবু কি এমন কবি যে তাঁহাকে কবি বলা যাইতে পারে?” বা, “শ্যামবাবু কি এমন কবি যে তাঁহাকে কবি বলা যাইতে পারে?” রামবাবু ও শ্যামবাবু এক স্কুলে পড়েন, তবে তাঁহাদের মধ্যে কে ফাষ্ট্ ক্লাসে পড়েন কে লাষ্ট্ ক্লাসে পড়েন তাহাই লইয়া কথা। রামবাবু ও শ্যামবাবু যে এক স্কুলে পড়েন, সে স্কুলটি কি? না, প্রকাশ করা। তাঁহাদের মধ্যে সাদৃশ্য কোথায়? না, প্রকাশ করা লইয়া। বৈসাদৃশ্য কোথায়? কিরূপে প্রকাশ করা হয় তাহা লইয়া। তবে, ভাল কবিতাকেই আমরা কবিতা বলি, কবিতা খারাপ হইলে তাহাকে আমরা মন্দ কবিতা বলি, সুকবিতা হইতে আরও দূরে গেলে তাহাকে আমরা কবিতা না বলিয়া শ্লোক বলিতে পারি, ছড়া বলিতে প্রবন্ধটির মধ্যে আড়ম্বর করিয়া কবিতা কথাটির একটি দুরূহ সংজ্ঞা নির্ণয় করিতে বসা সাজে না বলিয়া আমরা নিরস্ত হইলাম। পারি, যাহা ইচ্ছা। পৃথিবীর মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ জীবকে আমরা মানুষ বলি, তাহার কাছাকাছি যে আসে তাহাকে বনমানুষ বলি, মানুষ হইতে আরো তফাতে গেলে তাহাকে মানুষও বলি না, বনমানুষও বলি না, তাহাকে বানর বলি।"
যথেচ্ছা লেখাকে কবিতা বলা যায় না। তেমনি সব লেখককে কবিও বলা যায় না।
ভাবনা ৪ – কবির কল্পনা ও বস্তু বিশ্লেষন
___________________________
“কল্পনা প্রবল হইলেই কবি হয় না। সুমার্জ্জিত সুশিক্ষিত ও উচ্চ শ্রেণীর কল্পনা থাকা আবশ্যক। কল্পনাকে যথাপথে নিয়োগ করিবার নিমিত্ত বুদ্ধি ও রুচি থাকা আবশ্যক করে। পূর্ণচন্দ্র যে হাসে, বা জ্যোৎস্না যে ঘুমায়, এ কয়জন বালকের কল্পনায় উদিত হয়? একজন বালক যদি অসাধারণ কাল্পনিক হয়, তবে পূর্ণচন্দ্রকে একটি আস্ত লুচি বা অর্দ্ধচন্দ্রকে একটি ক্ষীরপুলি মনে করিতে পারে। তাহাদের কল্পনা সুসংলগ্ন নহে; কাহার সহিত কাহার যোগ হইতে পারে, কোন্ কোন্ দ্রব্যকে পাশাপাশি বসাইলে পরস্পর পরস্পরের আলোকে অধিকতর পরিস্ফুট হইতে পারে, কোন্ দ্রব্যকে কি ভাবে দেখিলে তাহার মর্ম্ম তাহার সৌন্দর্য্য চক্ষে বিকাশ পায়, এ সকল জানা অনেক শিক্ষার কাজ। একটি দ্রব্য অনেক ভাবে দেখা যাইতে পারে। বৈজ্ঞানিকেরা এক ভাবে জগৎ দেখেন, দার্শনিকেরা এক ভাবে দেখেন ও কবিরা আর এক ভাবে দেখেন। তিন জনে তিন প্রকার পদ্ধতিতে একই বস্তু দেখিতে পারেন। তুমি কি বল উহার মধ্যে দুই প্রকার পদ্ধতি আয়ত্ত করিতে শিক্ষার আবশ্যক করে, আর তৃতীয়টিতে করে না? শুদ্ধ করে না তাহাই নয়, শিক্ষাতেই তাহার বিনাশ! কোন্ দ্রব্য কোন্ শ্রেণীর, কিসের সহিত তাহার ঐক্য ও কিসের সহিত তাহার অনৈক্য, তাহা সূক্ষ্মানুসূক্ষ্মরূপে নির্ণয় করা দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও কবি তিন জনেরই কাজ। তবে একটা দ্রব্যের তিনটি দিক আছে, তিন জন তিন বিভিন্ন দিকের ভার লইয়াছেন। তিন জনের মধ্যে এই মাত্র প্রভেদ, আর কিছু প্রভেদ আছে কি? অনেক ভাল ভাল কবি যে ভাবের পার্শ্বে যে ভাব বসানো উচিত, স্থানে স্থানে তাহার ব্যতিক্রম করিয়া শিক্ষার অসম্পূর্ণতা প্রকাশ করিয়াছেন।............
কল্পনারও শিক্ষা আবশ্যক করে। যাহাদের কল্পনা শিক্ষিত নহে, তাহারা অতিশয় অসম্ভব অলৌকিক কল্পনা করিতে ভালবাসে; বক্র দর্পণে মুখ দেখিলে নাসিকা পরিমাণাধিক বৃহৎ এবং কপাল ও চিবুক নিতান্ত হ্রস্ব দেখায়। অশিক্ষিতদের কুগঠিত কল্পনাদর্পণে স্বাভাবিক দ্রব্য যাহা কিছু পড়ে তাহার পরিমাণ ঠিক থাকে না; তাহার নাসা বৃহৎ ও তাহার কপাল খর্ব্ব হইয়া পড়ে। তাহারা অসঙ্গত পদার্থের জোড়াতাড়া দিয়া এক-একটা বিকৃতাকার পদার্থ গড়িয়া তোলে। তাহারা শরীরী পদার্থের মধ্যে অশরীরী ভাব দেখিতে পায় না। তথাপি যদি বল বালকেরা কবি, তবে নিতান্ত বালকের মত কথা বলা হয়। প্রাচীন কালে অনেক ভাল কবিতা রচিত হইয়া গিয়াছে বলিয়াই, বোধ হয়, এই মতের সৃষ্টি হইয়া থাকিবে যে, অশিক্ষিত ব্যক্তিরা বিশেষরূপে কবি। তুমি বল দেখি, ওটাহিটি দ্বীপবাসী বা এস্কুইমোদের ভাষায় কয়টা পাঠ্য কবিতা আছে? এমন কোন্ জাতির মধ্যে ভাল কবিতা আছে যে জাতি সভ্য হয় নাই। যখন রামায়ণ মহাভারত রচিত হইয়াছিল তখন প্রাচীন কাল বটে, কিন্তু অশিক্ষিত কাল কি? রামায়ণ মহাভারত পাঠ করিয়া কাহারো মনে কি সে সন্দেহ উপস্থিত হইতে পারে?”
আমাদের আর কি বলার আছে এক্ষণে?
___________________________
“কল্পনা প্রবল হইলেই কবি হয় না। সুমার্জ্জিত সুশিক্ষিত ও উচ্চ শ্রেণীর কল্পনা থাকা আবশ্যক। কল্পনাকে যথাপথে নিয়োগ করিবার নিমিত্ত বুদ্ধি ও রুচি থাকা আবশ্যক করে। পূর্ণচন্দ্র যে হাসে, বা জ্যোৎস্না যে ঘুমায়, এ কয়জন বালকের কল্পনায় উদিত হয়? একজন বালক যদি অসাধারণ কাল্পনিক হয়, তবে পূর্ণচন্দ্রকে একটি আস্ত লুচি বা অর্দ্ধচন্দ্রকে একটি ক্ষীরপুলি মনে করিতে পারে। তাহাদের কল্পনা সুসংলগ্ন নহে; কাহার সহিত কাহার যোগ হইতে পারে, কোন্ কোন্ দ্রব্যকে পাশাপাশি বসাইলে পরস্পর পরস্পরের আলোকে অধিকতর পরিস্ফুট হইতে পারে, কোন্ দ্রব্যকে কি ভাবে দেখিলে তাহার মর্ম্ম তাহার সৌন্দর্য্য চক্ষে বিকাশ পায়, এ সকল জানা অনেক শিক্ষার কাজ। একটি দ্রব্য অনেক ভাবে দেখা যাইতে পারে। বৈজ্ঞানিকেরা এক ভাবে জগৎ দেখেন, দার্শনিকেরা এক ভাবে দেখেন ও কবিরা আর এক ভাবে দেখেন। তিন জনে তিন প্রকার পদ্ধতিতে একই বস্তু দেখিতে পারেন। তুমি কি বল উহার মধ্যে দুই প্রকার পদ্ধতি আয়ত্ত করিতে শিক্ষার আবশ্যক করে, আর তৃতীয়টিতে করে না? শুদ্ধ করে না তাহাই নয়, শিক্ষাতেই তাহার বিনাশ! কোন্ দ্রব্য কোন্ শ্রেণীর, কিসের সহিত তাহার ঐক্য ও কিসের সহিত তাহার অনৈক্য, তাহা সূক্ষ্মানুসূক্ষ্মরূপে নির্ণয় করা দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও কবি তিন জনেরই কাজ। তবে একটা দ্রব্যের তিনটি দিক আছে, তিন জন তিন বিভিন্ন দিকের ভার লইয়াছেন। তিন জনের মধ্যে এই মাত্র প্রভেদ, আর কিছু প্রভেদ আছে কি? অনেক ভাল ভাল কবি যে ভাবের পার্শ্বে যে ভাব বসানো উচিত, স্থানে স্থানে তাহার ব্যতিক্রম করিয়া শিক্ষার অসম্পূর্ণতা প্রকাশ করিয়াছেন।............
কল্পনারও শিক্ষা আবশ্যক করে। যাহাদের কল্পনা শিক্ষিত নহে, তাহারা অতিশয় অসম্ভব অলৌকিক কল্পনা করিতে ভালবাসে; বক্র দর্পণে মুখ দেখিলে নাসিকা পরিমাণাধিক বৃহৎ এবং কপাল ও চিবুক নিতান্ত হ্রস্ব দেখায়। অশিক্ষিতদের কুগঠিত কল্পনাদর্পণে স্বাভাবিক দ্রব্য যাহা কিছু পড়ে তাহার পরিমাণ ঠিক থাকে না; তাহার নাসা বৃহৎ ও তাহার কপাল খর্ব্ব হইয়া পড়ে। তাহারা অসঙ্গত পদার্থের জোড়াতাড়া দিয়া এক-একটা বিকৃতাকার পদার্থ গড়িয়া তোলে। তাহারা শরীরী পদার্থের মধ্যে অশরীরী ভাব দেখিতে পায় না। তথাপি যদি বল বালকেরা কবি, তবে নিতান্ত বালকের মত কথা বলা হয়। প্রাচীন কালে অনেক ভাল কবিতা রচিত হইয়া গিয়াছে বলিয়াই, বোধ হয়, এই মতের সৃষ্টি হইয়া থাকিবে যে, অশিক্ষিত ব্যক্তিরা বিশেষরূপে কবি। তুমি বল দেখি, ওটাহিটি দ্বীপবাসী বা এস্কুইমোদের ভাষায় কয়টা পাঠ্য কবিতা আছে? এমন কোন্ জাতির মধ্যে ভাল কবিতা আছে যে জাতি সভ্য হয় নাই। যখন রামায়ণ মহাভারত রচিত হইয়াছিল তখন প্রাচীন কাল বটে, কিন্তু অশিক্ষিত কাল কি? রামায়ণ মহাভারত পাঠ করিয়া কাহারো মনে কি সে সন্দেহ উপস্থিত হইতে পারে?”
আমাদের আর কি বলার আছে এক্ষণে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন