বুধবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৬

ফেবু- বঙ্গ ও বাংলা



বাংলার মাটি, বাংলার জল,   বাংলার বায়ু, বাংলার ফল--
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান ॥
বাংলার ঘর, বাংলার হাট,   বাংলার বন, বাংলার মাঠ--
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান ॥
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা--
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান ॥
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন,   বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন--
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান ॥

১৯০৫ সালে বড় কাতর হয়ে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ! কিন্তু বাংলা-বাঙালির ব্যবচ্ছেদ আটকানো গেল না! এই ১৯০৫ সালেই 'বঙ্গভঙ্গ' রদ করার পক্ষে থেকে হৃদয়ের উচ্ছাসে লিখেছিলেন- 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি'। সোনার বাংলা কেবল দু-টূকরো হল না। দুটো আলাদা দেশ আজ! দু'খণ্ডেই এক নৃগোষ্টীর বাস। তারা বাঙালি! ভৌগলিক সীমারেখার তাদের রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তা ভিন্ন, কিন্তু নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তায় তারা বাঙালি!
পশ্চিমবঙ্গের মমতা দিদি তাঁর রাজ্যের নাম 'বাংলা' করিয়েছেন। পূর্ববঙ্গ যেখানে পূর্ববঙ্গ নেই, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ থাকার দরকার কি? এটা অনেক পুরনো প্রশ্ন। যাক এতদিনে টনক নড়ল! এতে আমি খুশী কিম্বা অখুশী নই। অনেকের আপত্তি হচ্ছে 'বাংলা' নাম না রেখে 'বঙ্গ' রাখলেই তো হয়! রবীন্দ্রনাথ যেমন 'দ্রাবিড়-উৎকল-বঙ্গ' লিখেছেন- তাতে এই বঙ্গকে স্পেসেফিক ভাবে বোঝানো যেত। বঙ্গ আর বাংলা- ফারাক শুধু শব্দের বানানে। আর কিছুতে তো নেই। বাংলা লিখলে বাংলাদেশের গন্ধ পাচ্ছেন অনেক বাংলাদেশীও! বিষয়টা এমন 'বাংলা' শব্দটা বাংলাদেশীদের একার এখতিয়ারে চলে গেছে! এটা নিয়ে আর কেউ কিছু করতে পারবে না! সিরাজদৌল্লা যাত্রায় একটা ডায়ালগ ছিল- 'বাংলা বিহার উড়িষ্যার অধিপতি'! এই ডায়ালগে 'বাংলা' বলতে কি বোঝানো হয়! অখণ্ড বাংলার কথা নিশ্চয়! বাংলা দ্বি-খণ্ড হলে এক খন্ড 'বাংলা' হতে পারবে না? 'বঙ্গ'- বাংলাকে সাধু ভাষায় বঙ্গ বলা হয়! বাংলাদেশও বঙ্গ। এটা পূর্ববঙ্গ থেকে, পূর্ব পাকিস্তান আর এখন বাংলাদেশ হয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বঙ্গীয় ব-দ্বীপ! বাংলা কিংবা বঙ্গ- বিষয়টা চিরকালই এক! তাই পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনে যৌক্তিকতা আছে এবং এতে বাংলাদেশের সর্বনাশের কোন কারণ দেখি না! ভারতভাগের সময় পাঞ্জাবকেও দু'টুকরো করে ফেলা হয়! ওই দুটূকরো এখনো পাঞ্জাব! পশ্চিমপাঞ্জাব, পূর্বপাঞ্জাব বলে কিছু নেই! একদিকের পাঞ্জাবীরা আজ পাকিস্তানী নাগরিক! অন্যদিকের পাঞ্জাবীরা ভারতের! তাদের পাঞ্জাবীয়ানা নিয়ে কোন সমস্যা নেই! সমস্যা কেবল বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে! বাঙালীর সমস্যাসন্ধানী মানসিকতা চিরদিনের!
কিছুদিন আগে একজন বলেছিলেন বাংলাদেশী ভাই বলছিলেন তিনি বাঙালী নন- তিনি বাংলাদেশী! আবার তিনিই বঙ্গবন্ধুকে (বাংলাবন্ধু নন!) বাঙালী জাতির পিতা বলাতে আমি কনফিউজড হয়ে পড়ি। তিনি বাঙালী না হলে 'বাঙালী জাতি' তে এত মুগ্ধ কেন? বাংলাদেশীদের মধ্যে এই সংকটটা নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে! কোনটা নৃতাত্ব্বিক (race)জাতীয়তা, আর কোনটা নাগরিকত্ব কেন্দ্রিক জাতীয়তা- তারা হয়ত ভুলে যাচ্ছেন। অথবা একটা শ্রেণী তাদের ভুলতে অনুপ্রাণিত করে চলেছে! নাগরিকত্ব পরিবর্তন সম্ভব! কিন্তু জাতিত্ব ঘোচানো যায় না! বাঙালী পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক তারা বাঙালি। বাঙালীর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসও বাংলাদেশীদের একার ইতিহাস নয়! চমকে গেলেন নাকি! বাংলা ভাষার জন্য মানভূম জেলা লড়েছে ১৯৪০ এর দশক থেকে! বিহারীদের হিন্দি ভাষার আগ্রাসন থেকে তারা মুক্তি চেয়েছে! ১৯৬১ সালে অসমীয়া ভাষার আগ্রাসণ থেকে মুক্তি পেতে বাঙালীর লড়াইয়ে ১১ জন বাঙালী শহীদ হন! আজও পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবি মহলে বাঙালি সংস্কৃতিতে 'হিন্দি আগ্রাসন' ঠেকানোর উপায় খোঁজা হয়! ১৯৫২ এর যে বাঙালি যে বাংলার জন্য রক্তস্নাত হয়েছিল, এরাও সেই একই বাংলার জন্য মরেছে! বাংলাদেশ স্বাধীন ভূখণ্ড হওয়াতে তাঁর দাবীর জোরটা শক্তিশালী! কিন্তু ওপাড় বাংলা সেটা পারে না। সঙ্গত কারণেই পারে না। কারণ একটা বৃহৎ রাষ্ট্রে প্রাদেশিকতার চাইতে দেশটা বড়! ভারতে এত ethnical diversity,  এত ভাষা, এত ধর্ম, এত প্রদেশ থাকা সত্ত্বেও তারা এক সাথে আছে কি করে?
আমাদের প্রথমে ধর্ম দিয়ে কাটা হল! তারপর আমরা দু দেশে ছড়িয়ে গেলাম! এতেও আমরা খুশী হইনি। এখন আমরা বিভাজনের জন্য আরও কোন ক্ষুদ্র ছিদ্র আবিষ্কার করা যায় কিনা তা নিয়ে চিন্তায় থাকি। মমতা ব্যানার্জির প্রতি আমার মমতা নেই। বাম-শাসনের চেয়ে তার শাসন ভালো এতটুকুই! Better, but not the best. শেখ হাসিনার মত কুশলী নন। দু'জনের দুটো বক্তৃতা পাশাপাশি রেখে শুনবেন। ফারাকটা টের পাবেন। কিন্তু তিনিই সেখানের সর্বাধিকারিণী! আমার কি বলার থাকতে পারে এতে! এটা সেখানকার জনগণের নির্বাচন। আমি আমারটা নিয়ে ভাবি। এতেই মঙ্গল! পশ্চিমবঙ্গের নাম 'বাংলা' না হলেও যা বাংলা হলেও তা- আমার জন্য আর কি! পশ্চিমবঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ যখন ছিল আমার তখনো ভাত হজম হত। পশ্চিমবঙ্গ নাম পরিবর্তন করে বাংলা হয়ে গেলেও ভাত হজম হবে! মমতা দিদির সরকারের সাথে বাংলাদেশের সরকারের অনেক ইস্যু আছে। সীমান্ত, ফারাক্কা ইত্যাদি! নাম পরিবর্তনে এসব ইস্যুতে কোন হেরফের হবে না। নামের সাথে কূটনীতি চলবে না, কূটনীতি মানুষ ও মানুষে হয়! জাতির সাথে হয় না! মাটি ও নদীর সাথে হয় না! ভাষা ও সঙ্গীতের সাথে হয় না! মানুষের সাথে মানুষের হয়!   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

গ্রাস

  বুঝি আর আমাকে দিয়ে হবে না কিছুই। অসময়ে, অনাহুত, অতি অনভিপ্রেত জানি, সমস্ত বিবাদী উষ্মার অন্তরালে হারিয়ে যাব আমার এ যাবৎ যতনে গড়া সুরের ...