{রবীন্দ্র সঙ্গীতের ছয়টি পর্যায় নিয়ে প্রস্তাবিত একটা ছোট্ট অডিও ডক্যুমেন্টরির জন্য এটা লেখা হয়েছিল।}
যদি বলা হয় বিগত এক হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের সকল
ধারাকে একটা সমুদ্রে এসে মেলানো হোক,
তবে সে সমুদ্রের নাম কি হতে পারে? সেই সমুদ্রের নাম হতে পারে রবীন্দ্রনাথ!বাংলা সাহিত্যের এমন কোন দিক নেই যেখানে
কবিগুরুর স্বচ্ছন্দ
পদচারণা ছিলনা। তাঁর সাহিত্যে কেবল যে সাহিত্যের কারুকার্যই ধরা দিয়েছে তা নয়, বরং সুগভীর দর্শন ও মনস্তাত্ত্বিক চেতনার আবহ তাঁর সাহিত্যকর্মকে বারবার আন্দোলিত করেছে। এই জন্যই তিনি শুধু
ছন্দসৃজনের কবি নন, নিছক ঔপন্যাসিক নন, নাট্যকার নন,
গীতিকার নন- সবকিছু ছাড়িয়ে তিনি ঋষি। কবির্ষি! ঋষি কবি!
কবিগুরু তাঁর দীর্ঘ জীবনে আমাদের দিয়ে গেছেন অনেক কিছু। বাংলা ভাষাকে বিশ্বসাহিত্যের পরিমন্ডলে নক্ষত্রের দ্যুতিময়তায় তুলে ধরেছিলেন তিনি। এই আধুনিক যুগের তীব্র ব্যস্ততার বাতাবরণে আমাদের ফুরসতই বা কোথায় মেলে যে একটু রবীন্দ্র বাতায়নের ভেতরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে আসি!তাঁর বিস্তৃত কর্মকান্ডের সবটুকু একজীবনে কেউ জেনে নেবেন এমন দুরাগ্রহ কবিগুরুও ছিলনা। তবে তিনি এটা নিশ্চিত করেই বলেছিলেন যে তাঁর সমস্ত সাহিত্য একদিন বিস্মৃত হলেও বেঁচে থাকবে গান।
হ্যাঁ, কবিগুরুর গান।কবিগুরুর বিরাট প্রজ্ঞার খবরাখবর কেউ না রাখুক, কিন্তু তাঁর গানে আপ্লুত নন এমন বাঙালি কোথায়? ‘জনগনমন অধিনায়ক’ হতে ‘আমার সোনার বাংলা’; আরও সুদুরে গিয়ে ‘আপ শ্রীলংকা নমো নমো মাতা’র সুর যখন যখন কোটি প্রাণে বেজে ওঠে তখন ভেসে আসে এক দীর্ঘ শ্বেতশ্মশ্রু বৃদ্ধের মুখ! তিনি বিশ্বকবি। তাঁর গানকে কি ভুলতে চাইলেই ভোলা যাবে?
আজন্ম প্রকৃতিপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথের গানে আকাশ, মাটি, নদী, সাগর, পাখি, প্রজাপতি, ফুল, মেঘ কত কি এসে তাকে ভরিয়ে তুলেছে বিশ্বজননীর পূজার ডালির মতন করে।কবিগুরু লিখছেন-
‘প্রকৃতি জননি ওগো, তোমার স্বরূপ
যত দূর জানিবারে ক্ষুদ্র মানবেরে
দিয়াছ গো অধিকার সদয় হইয়া, তত
দূর জানিবারে জীবন আমার করেছি
ক্ষেপণ আর করিব ক্ষেপণ।‘ (কবিকাহিনী - ৬)
‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ দিয়ে সেই অভিযানের সূচনা। সেই থেকে শেষ পর্যন্ত, প্রকৃতির মধ্যে যে অপার ছন্দ ও সুর খেলে যেতে প্রতিনিয়ত তাই ছিল কবিগুরুর সৃষ্টির প্রেরণা। মহাবিশ্বের এক অদৃশ্য রম্যবীণায় যে ঝংকার ওঠে কবিগুরু যেন কান পেতে তাই শুনতে পেতেন।
‘বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে।
স্থলে জলে নভতলে বনে উপবনে
নদীনদে গিরিগুহা-পারাবারে
নিত্য জাগে সরস সঙ্গীতমধুরিমা,
নিত্য নৃত্যরসভঙ্গিমা।–
নব বসন্তে নব আনন্দ, উৎসব নব।
অতি মঞ্জুল, অতি মঞ্জুল, শুনি মঞ্জুল গুঞ্জন কুঞ্জে–
শুনি রে শুনি মর্মর পল্লবপুঞ্জে,
পিককূজন পুষ্পবনে বিজনে,
মৃদু বায়ুহিলোলবিলোল বিভোল বিশাল সরোবর-মাঝে
কলগীত সুললিত বাজে।
শ্যমল কান্তার-’পরে অনিল সঞ্চারে ধীরে রে,
নদীতীরে শরবনে উঠে ধবনি সরসর মরমর।
কত দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা॥
............ ......'
কবিগুরু তাঁর দীর্ঘ জীবনে আমাদের দিয়ে গেছেন অনেক কিছু। বাংলা ভাষাকে বিশ্বসাহিত্যের পরিমন্ডলে নক্ষত্রের দ্যুতিময়তায় তুলে ধরেছিলেন তিনি। এই আধুনিক যুগের তীব্র ব্যস্ততার বাতাবরণে আমাদের ফুরসতই বা কোথায় মেলে যে একটু রবীন্দ্র বাতায়নের ভেতরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে আসি!তাঁর বিস্তৃত কর্মকান্ডের সবটুকু একজীবনে কেউ জেনে নেবেন এমন দুরাগ্রহ কবিগুরুও ছিলনা। তবে তিনি এটা নিশ্চিত করেই বলেছিলেন যে তাঁর সমস্ত সাহিত্য একদিন বিস্মৃত হলেও বেঁচে থাকবে গান।
হ্যাঁ, কবিগুরুর গান।কবিগুরুর বিরাট প্রজ্ঞার খবরাখবর কেউ না রাখুক, কিন্তু তাঁর গানে আপ্লুত নন এমন বাঙালি কোথায়? ‘জনগনমন অধিনায়ক’ হতে ‘আমার সোনার বাংলা’; আরও সুদুরে গিয়ে ‘আপ শ্রীলংকা নমো নমো মাতা’র সুর যখন যখন কোটি প্রাণে বেজে ওঠে তখন ভেসে আসে এক দীর্ঘ শ্বেতশ্মশ্রু বৃদ্ধের মুখ! তিনি বিশ্বকবি। তাঁর গানকে কি ভুলতে চাইলেই ভোলা যাবে?
আজন্ম প্রকৃতিপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথের গানে আকাশ, মাটি, নদী, সাগর, পাখি, প্রজাপতি, ফুল, মেঘ কত কি এসে তাকে ভরিয়ে তুলেছে বিশ্বজননীর পূজার ডালির মতন করে।কবিগুরু লিখছেন-
‘প্রকৃতি জননি ওগো, তোমার স্বরূপ
যত দূর জানিবারে ক্ষুদ্র মানবেরে
দিয়াছ গো অধিকার সদয় হইয়া, তত
দূর জানিবারে জীবন আমার করেছি
ক্ষেপণ আর করিব ক্ষেপণ।‘ (কবিকাহিনী - ৬)
‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ দিয়ে সেই অভিযানের সূচনা। সেই থেকে শেষ পর্যন্ত, প্রকৃতির মধ্যে যে অপার ছন্দ ও সুর খেলে যেতে প্রতিনিয়ত তাই ছিল কবিগুরুর সৃষ্টির প্রেরণা। মহাবিশ্বের এক অদৃশ্য রম্যবীণায় যে ঝংকার ওঠে কবিগুরু যেন কান পেতে তাই শুনতে পেতেন।
‘বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে।
স্থলে জলে নভতলে বনে উপবনে
নদীনদে গিরিগুহা-পারাবারে
নিত্য জাগে সরস সঙ্গীতমধুরিমা,
নিত্য নৃত্যরসভঙ্গিমা।–
নব বসন্তে নব আনন্দ, উৎসব নব।
অতি মঞ্জুল, অতি মঞ্জুল, শুনি মঞ্জুল গুঞ্জন কুঞ্জে–
শুনি রে শুনি মর্মর পল্লবপুঞ্জে,
পিককূজন পুষ্পবনে বিজনে,
মৃদু বায়ুহিলোলবিলোল বিভোল বিশাল সরোবর-মাঝে
কলগীত সুললিত বাজে।
শ্যমল কান্তার-’পরে অনিল সঞ্চারে ধীরে রে,
নদীতীরে শরবনে উঠে ধবনি সরসর মরমর।
কত দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা॥
............ ......'
কেবল মাত্র বাহ্য প্রকৃতির প্রেমে রবীন্দ্রনাথ আত্মস্থ
থাকেননি চিরদিন। অপরাপ্রকৃতির
মাঝখানে থেকেই তিনি অনুসন্ধান করেছিলেন পরাপ্রকৃতির নির্যাস!
প্রকৃতির খেলা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তিনি
কখনোই ‘আবৃতচক্ষুঃ অমৃতত্বমিচ্ছন’ বলে ধ্যানস্থ হতে
চাননি। তাই আমরা তাঁর বাণীতে পেয়েছিলাম ‘বৈরাগ্য সাধনে
মুক্তি সে আমার নয়।‘ প্রকৃতির সকল প্রেমের
ভেতরেই তিনি উপলব্ধি করতে
চেয়েছিলেন পরমাপ্রকৃতির অনুরণন। নরনারীর প্রেম সেখানটায় প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তুলতে পারেনি। বস্তুত রবীন্দ্রদৃষ্টিতে
সেই প্রেমও পেয়েছে এক
অত্যুচ্চ স্থান যা রবীন্দ্র-পূর্ববর্তী কোন কবিতে প্রকাশ পায়নি। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে দাম্পত্য প্রেমের নীরিখে
অনেক কিছু রচিত হলেও বিবাহপূর্ব
প্রেমকে কোনভাবেই প্রশ্রয় দেয়া হয়নি।এ জাতীয় প্রণয়ের সামাজিক স্বীকৃতিও তখন কতটাই বা ছিল। এই নিয়ে আক্ষেপও
করেছেন কবিগুরু। শুধু আক্ষেপ করেই
ক্ষান্ত থাকেননি। লিখেছেন অজস্র গান, কবিতা, গীতিনাট্য, উপন্যাস। আজকের
দিনে প্রেমকে নিয়ে কতহাজার গান হচ্ছে, সুর হচ্ছে;
অতীত পর্যালোচনা করে আমরা সানন্দে বলতে পারি এর গোড়াপত্তন
হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের
হাত ধরেই। কবিগুরুকে বাংলা গানের জগতে তথা বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার প্রবর্তক বললেও অত্যুক্তি হয়না।
কেমন ছিল কবিগুরুর প্রেম ভাবনা? সেই প্রেমে প্রিয়কে পাওয়ার হর্ষ, হারানোর বেদনা, না পাবার বিরহ সব ছিল। এসব তো প্রেমের সাধারণ বৈশিষ্ট যা থাকবেই। কিন্তু কবিগুরু এর ভেতরেই প্রেমকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি প্রেমকে দিয়েছেন সুখ-দুখের পারে স্থান।জাগতিক বাসনার ভারে ন্যুব্জ প্রেম সে নয়। বিনিময়যোগ্য প্রেম সে নয়। এ শুধু ভালবাসার জন্যই ভালবাসা। প্রেমের জন্যই প্রেম। কিছু পাব বলে নয়। বরং শুধু সমর্পণের জন্য। তা-ই হল মহত্তম প্রেম। তা-ই হল প্রকৃত প্রেম। এই প্রেমেরই পূজারী ছিলেন তিনি। সুখের আশায় যে প্রেম সে প্রেম যেন প্রেমই নয়। কবিগুরুর ‘মায়ার খেলা’ গীতিনাট্যে প্রকটিত হয়েছিল তাঁর প্রেমানুভূতির এই অপূর্ব রূপটি-
"এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না,
শুধু সুখ চলে যায় এমনই মায়ার ছলনা।
এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়।
তাই কেঁদে কাটে নিশি, তাই দহে প্রাণ,
তাই মান অভিমান, তাই এত হায় হায়।
প্রেমে সুখ দুখ ভুলে তবে সুখ পায়।
সখী চলো, গেল নিশি, স্বপন ফুরাল,
মিছে আর কেন বল।
শশী ঘুমের কুহক নিয়ে গেল অস্তাচল।
সখী চলো।
প্রেমের কাহিনী গান, হয়ে গেল অবসান।
এখন কেহ হাসে, কেহ বসে ফেলে অশ্রুজল।"
কেমন ছিল কবিগুরুর প্রেম ভাবনা? সেই প্রেমে প্রিয়কে পাওয়ার হর্ষ, হারানোর বেদনা, না পাবার বিরহ সব ছিল। এসব তো প্রেমের সাধারণ বৈশিষ্ট যা থাকবেই। কিন্তু কবিগুরু এর ভেতরেই প্রেমকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি প্রেমকে দিয়েছেন সুখ-দুখের পারে স্থান।জাগতিক বাসনার ভারে ন্যুব্জ প্রেম সে নয়। বিনিময়যোগ্য প্রেম সে নয়। এ শুধু ভালবাসার জন্যই ভালবাসা। প্রেমের জন্যই প্রেম। কিছু পাব বলে নয়। বরং শুধু সমর্পণের জন্য। তা-ই হল মহত্তম প্রেম। তা-ই হল প্রকৃত প্রেম। এই প্রেমেরই পূজারী ছিলেন তিনি। সুখের আশায় যে প্রেম সে প্রেম যেন প্রেমই নয়। কবিগুরুর ‘মায়ার খেলা’ গীতিনাট্যে প্রকটিত হয়েছিল তাঁর প্রেমানুভূতির এই অপূর্ব রূপটি-
"এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না,
শুধু সুখ চলে যায় এমনই মায়ার ছলনা।
এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়।
তাই কেঁদে কাটে নিশি, তাই দহে প্রাণ,
তাই মান অভিমান, তাই এত হায় হায়।
প্রেমে সুখ দুখ ভুলে তবে সুখ পায়।
সখী চলো, গেল নিশি, স্বপন ফুরাল,
মিছে আর কেন বল।
শশী ঘুমের কুহক নিয়ে গেল অস্তাচল।
সখী চলো।
প্রেমের কাহিনী গান, হয়ে গেল অবসান।
এখন কেহ হাসে, কেহ বসে ফেলে অশ্রুজল।"
এই জগতে প্রকৃতিকে নিজের ভাবে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা
কেবলমাত্র মানুষেরই আছে। মানুষ তার
ইন্দ্রিয় দিয়ে প্রকৃতির রূপ রস আস্বাদনের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে সর্বদা। উপনিষদ বলছে বিধাতা মানুষের
ইন্দ্রিয়গুলোকে বহির্মুখী করে গড়েছেন যাতে তারা তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে ও তাঁকে বিস্মৃত হয়। কিন্তু কখনো কখনো কিছু স্থিতধী ব্যাক্তি সেই
প্রত্যগাত্মাকে জানার অভিপ্রায়ে ইন্দ্রিয়সমূহকে অন্তর্মূখী করেন ও অমৃতত্ত্ব কামনা করেন।
কবিগুরু ছিলেন ঔপনিষদিক কবি। সেই অমৃতত্বের পিপাসা তাঁর মধ্যেও প্রবল ছিল। কবির নানান প্রবন্ধে অজস্রবার উঠে এসেছে বিভিন্ন উপনিষদের নাম ও শ্লোকের উদ্ধৃতি।তাঁর সমস্ত জীবনটিই যেন হয়ে উঠেছিল উপনিষদময়। বাল্যকাল থেকে প্রাপ্ত পারিবারিক শিক্ষা-ই যে এর মূল কারণ ছিল সেটা আর নতুন করে বলতে হয়না।
ব্রাহ্মরীতির নিরাকার উপাসনার ধর্মে যদিও তিনি নিমজ্জিত ছিলেন কিন্তু তাঁর বন্দনায় অভীপ্সিত ব্রহ্ম হয়ে উঠতেন সাকার। বাঙ্ময়- কখনো প্রভূরূপে, কখনো পিতারূপে, কখনো সখারূপে কখনো জগতের রাজা রূপে! অরূপের বাণীকে শোনার জন্য তাঁর ভেতরে যে একটা প্রবল আকাঙ্ক্ষা সেটা ধ্বণিত হয়েছে কবির নানা রচনায় নানা ভাবে। ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষের ভার তিনি ন্যাস্ত করেছিলেন যে বিশ্বরাজার কাছে, তাকে পাবার বাসনা তাঁকে ব্যাকুলিত করত সর্বদা। অদ্বৈত বেদান্তের পথে চলেও তিনি যেন কতকটা রামপ্রসাদের ঢঙেই ভাবতে চেয়েছেন- ‘চিনি হতে চাইনে মা, চিনি খেতে ভালবাসি।‘ অন্তস্থ ব্রহ্মকে জগতের মাঝে ব্যাপ্ত করে করতে চেয়েছেন তাঁকে সর্বস্ব নিবেদন সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে। সকল সুখের মাঝে, সকল চাওয়ায়, সকল পাওয়ায়, সকল কিছুর মাঝে-
আজি মম মন চাহে জীবনবন্ধুরে,
সেই জনমে মরণে নিত্যসঙ্গী
নিশিদিন সুখে শোকে–
সেই চির-আনন্দ, বিমল চিরসুধা,
যুগে যুগে কত নব নব লোকে নিয়তশরণ।
পরাশান্তি ,পরমপ্রেম, পরামুক্তি, পরমক্ষেম,
সেই অন্তরতম চিরসুন্দর প্রভু, চিত্তসখা,
ধর্ম-অর্থ-কাম-ভরণ রাজা হৃদয়হরণ॥
হয়ত ভাবতে পারেন রবীন্দ্রনাথের মধ্যে অধ্যাত্মচেতনার বিকাশ ঘটেছিল আর দশটা সাধারণ মানুষের মতই আয়ুসূর্যের গোধূলী লগনে। কিন্তু তাই কি? না তা নয়। হাস্যোচ্ছল প্রাণবন্ত কৈশোরের শেষ লগনেই জগতের আদিসত্বাকে জানার প্রেরণা তাঁর মনোজগতে স্থান করে নিয়েছিল এমনটাই ভাবেন রবীন্দ্র গবেষকরা।
১৮৮৩ সালের দিকে মাত্র ২২ বছর বয়সের জীবনস্মৃতি রোমন্থন করে কবি লিখছেন-
“সদর স্ট্রীটের রাস্তাটা যেখানে গিয়া শেষ হইয়াছে সেইখানে বোধ করি ফ্রী-ইস্কুলের বাগানের গাছ দেখা যায়। একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমি সেইদিকে চাহিলাম। তখন সেই গাছগুলির পল্লবান্তরাল হইতে সূর্যোদয় হইতেছিল। চাহিয়া থাকিতে থাকিতে হঠাৎ এক মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়া গেল। দেখিলাম, একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন, আনন্দে এবং সৌন্দর্যে সর্বত্রই তরঙ্গিত। আমার হৃদয়ে স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল তাহা এক নিমিষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলোক একবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল। সেইদিনই ‘নির্ঝরের স্বপভঙ্গ’ কবিতাটি নির্ঝরের মতোই যেন উৎসারিত হইয়া বহিয়া চলিল।” ......
আমি বারান্দায় দাঁড়াইয়া থাকিতাম, রাস্তা দিয়া মুটে মজুর যে-কেহ চলিত তাহাদের গতিভঙ্গি, শরীরের গঠন, তাহাদের মুখশ্রী আমার কাছে ভারি আশ্চর্য বলিয়া বোধ হইত; সকলেই যেন নিখিলসমুদ্রের উপর দিয়া তরঙ্গলীলার মতো বহিয়া চলিয়াছে। শিশুকাল হইতে কেবল চোখ দিয়া দেখাই অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল, আজ যেন একেবারে সমস্ত চৈতন্য দিয়া দেখিতে আরম্ভ করিলাম। রাস্তা দিয়া এক যুবক যখন আর-এক যুবকের কাঁধে হাত দিয়া হাসিতে হাসিতে অবলীলাক্রমে চলিয়া যাইত সেটাকে আমি সামান্য ঘটনা বলিয়া মনে করিতে পারিতাম না— বিশ্বজগতের অতলস্পর্শ গভীরতার মধ্যে যে অফুরান রসের উৎস চারি দিকে হাসির ঝরনা ঝরাইতেছে সেইটাকে যেন দেখিতে পাইতাম।” (প্রভাতসঙ্গীত)
ভাবলেও গায়ে শিহরণ দেয়। এ কোন সাধারণ মানুষের অনুভূতি কি? এই অধ্যাত্ম বিকাশটা আমরা আরো দু’বছর পেছনে গিয়ে দেখি। ১৮৮১ সালের কথা। কবির বয়স তখন মাত্র ২০। কবিত্বের অঙ্কুরোদগমের সময়। ব্যাপ্তি তখনো ঠাকুর বাড়ির দালান আর ব্রাহ্মসমাজের সভাগৃহ। সেই বয়সেই ব্রাহ্মসমাজের সভ্য রাজনারায়ণ বসুর মেয়ের বিয়েতে গাইবার জন্য একটি গান লিখেছিলেন। গানটি শুনলেই ধারণা করতে পারবেন সবকিছুর মধ্যে আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণ ঘটানোর প্রবণতা কত অল্প আয়ুতেই ধাতস্থ হয়ে গিয়েছিল কবির মধ্যে। গানটি গেয়েছিলেন ১৮ বছর বয়সী নরেন্দ্রনাথ- উত্তরকালে যার কীর্তি রবীন্দ্রনাথের পুর্বেই আলোড়িত করবে ভারতবর্ষকে। এই নরেন্দ্রনাথই স্বামী বিবেকানন্দ।
দুই হৃদয়ের নদী একত্র মিলিল যদি
বলো, দেব, কার পানে আগ্রহে ছুটিয়া যায়॥
সম্মুখে রয়েছ তার তুমি প্রেমপারাবার,
তোমারি অনন্তহৃদে দুটিতে মিলিতে চায়॥
সেই এক আশা করি দুইজনে মিলিয়াছে,
সেই এক লক্ষ্য ধরি দুইজনে চলিয়াছে।
পথে বাধা শত শত, পাষাণ পর্বত কত,
দুই বলে এক হয়ে ভাঙিয়া ফেলিবে তায়॥
অবশেষে জীবনের মহাযাত্রা ফুরাইলে
তোমারি স্নেহের কোলে যেন গো আশ্রয় মিলে,
দুটি হৃদয়ের সুখ দুটি হৃদয়ের দুখ
দুটি হৃদয়ের আশা মিলায় তোমার পায়॥
কবিগুরু ছিলেন ঔপনিষদিক কবি। সেই অমৃতত্বের পিপাসা তাঁর মধ্যেও প্রবল ছিল। কবির নানান প্রবন্ধে অজস্রবার উঠে এসেছে বিভিন্ন উপনিষদের নাম ও শ্লোকের উদ্ধৃতি।তাঁর সমস্ত জীবনটিই যেন হয়ে উঠেছিল উপনিষদময়। বাল্যকাল থেকে প্রাপ্ত পারিবারিক শিক্ষা-ই যে এর মূল কারণ ছিল সেটা আর নতুন করে বলতে হয়না।
ব্রাহ্মরীতির নিরাকার উপাসনার ধর্মে যদিও তিনি নিমজ্জিত ছিলেন কিন্তু তাঁর বন্দনায় অভীপ্সিত ব্রহ্ম হয়ে উঠতেন সাকার। বাঙ্ময়- কখনো প্রভূরূপে, কখনো পিতারূপে, কখনো সখারূপে কখনো জগতের রাজা রূপে! অরূপের বাণীকে শোনার জন্য তাঁর ভেতরে যে একটা প্রবল আকাঙ্ক্ষা সেটা ধ্বণিত হয়েছে কবির নানা রচনায় নানা ভাবে। ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষের ভার তিনি ন্যাস্ত করেছিলেন যে বিশ্বরাজার কাছে, তাকে পাবার বাসনা তাঁকে ব্যাকুলিত করত সর্বদা। অদ্বৈত বেদান্তের পথে চলেও তিনি যেন কতকটা রামপ্রসাদের ঢঙেই ভাবতে চেয়েছেন- ‘চিনি হতে চাইনে মা, চিনি খেতে ভালবাসি।‘ অন্তস্থ ব্রহ্মকে জগতের মাঝে ব্যাপ্ত করে করতে চেয়েছেন তাঁকে সর্বস্ব নিবেদন সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে। সকল সুখের মাঝে, সকল চাওয়ায়, সকল পাওয়ায়, সকল কিছুর মাঝে-
আজি মম মন চাহে জীবনবন্ধুরে,
সেই জনমে মরণে নিত্যসঙ্গী
নিশিদিন সুখে শোকে–
সেই চির-আনন্দ, বিমল চিরসুধা,
যুগে যুগে কত নব নব লোকে নিয়তশরণ।
পরাশান্তি ,পরমপ্রেম, পরামুক্তি, পরমক্ষেম,
সেই অন্তরতম চিরসুন্দর প্রভু, চিত্তসখা,
ধর্ম-অর্থ-কাম-ভরণ রাজা হৃদয়হরণ॥
হয়ত ভাবতে পারেন রবীন্দ্রনাথের মধ্যে অধ্যাত্মচেতনার বিকাশ ঘটেছিল আর দশটা সাধারণ মানুষের মতই আয়ুসূর্যের গোধূলী লগনে। কিন্তু তাই কি? না তা নয়। হাস্যোচ্ছল প্রাণবন্ত কৈশোরের শেষ লগনেই জগতের আদিসত্বাকে জানার প্রেরণা তাঁর মনোজগতে স্থান করে নিয়েছিল এমনটাই ভাবেন রবীন্দ্র গবেষকরা।
১৮৮৩ সালের দিকে মাত্র ২২ বছর বয়সের জীবনস্মৃতি রোমন্থন করে কবি লিখছেন-
“সদর স্ট্রীটের রাস্তাটা যেখানে গিয়া শেষ হইয়াছে সেইখানে বোধ করি ফ্রী-ইস্কুলের বাগানের গাছ দেখা যায়। একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমি সেইদিকে চাহিলাম। তখন সেই গাছগুলির পল্লবান্তরাল হইতে সূর্যোদয় হইতেছিল। চাহিয়া থাকিতে থাকিতে হঠাৎ এক মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়া গেল। দেখিলাম, একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন, আনন্দে এবং সৌন্দর্যে সর্বত্রই তরঙ্গিত। আমার হৃদয়ে স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল তাহা এক নিমিষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলোক একবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল। সেইদিনই ‘নির্ঝরের স্বপভঙ্গ’ কবিতাটি নির্ঝরের মতোই যেন উৎসারিত হইয়া বহিয়া চলিল।” ......
আমি বারান্দায় দাঁড়াইয়া থাকিতাম, রাস্তা দিয়া মুটে মজুর যে-কেহ চলিত তাহাদের গতিভঙ্গি, শরীরের গঠন, তাহাদের মুখশ্রী আমার কাছে ভারি আশ্চর্য বলিয়া বোধ হইত; সকলেই যেন নিখিলসমুদ্রের উপর দিয়া তরঙ্গলীলার মতো বহিয়া চলিয়াছে। শিশুকাল হইতে কেবল চোখ দিয়া দেখাই অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল, আজ যেন একেবারে সমস্ত চৈতন্য দিয়া দেখিতে আরম্ভ করিলাম। রাস্তা দিয়া এক যুবক যখন আর-এক যুবকের কাঁধে হাত দিয়া হাসিতে হাসিতে অবলীলাক্রমে চলিয়া যাইত সেটাকে আমি সামান্য ঘটনা বলিয়া মনে করিতে পারিতাম না— বিশ্বজগতের অতলস্পর্শ গভীরতার মধ্যে যে অফুরান রসের উৎস চারি দিকে হাসির ঝরনা ঝরাইতেছে সেইটাকে যেন দেখিতে পাইতাম।” (প্রভাতসঙ্গীত)
ভাবলেও গায়ে শিহরণ দেয়। এ কোন সাধারণ মানুষের অনুভূতি কি? এই অধ্যাত্ম বিকাশটা আমরা আরো দু’বছর পেছনে গিয়ে দেখি। ১৮৮১ সালের কথা। কবির বয়স তখন মাত্র ২০। কবিত্বের অঙ্কুরোদগমের সময়। ব্যাপ্তি তখনো ঠাকুর বাড়ির দালান আর ব্রাহ্মসমাজের সভাগৃহ। সেই বয়সেই ব্রাহ্মসমাজের সভ্য রাজনারায়ণ বসুর মেয়ের বিয়েতে গাইবার জন্য একটি গান লিখেছিলেন। গানটি শুনলেই ধারণা করতে পারবেন সবকিছুর মধ্যে আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণ ঘটানোর প্রবণতা কত অল্প আয়ুতেই ধাতস্থ হয়ে গিয়েছিল কবির মধ্যে। গানটি গেয়েছিলেন ১৮ বছর বয়সী নরেন্দ্রনাথ- উত্তরকালে যার কীর্তি রবীন্দ্রনাথের পুর্বেই আলোড়িত করবে ভারতবর্ষকে। এই নরেন্দ্রনাথই স্বামী বিবেকানন্দ।
দুই হৃদয়ের নদী একত্র মিলিল যদি
বলো, দেব, কার পানে আগ্রহে ছুটিয়া যায়॥
সম্মুখে রয়েছ তার তুমি প্রেমপারাবার,
তোমারি অনন্তহৃদে দুটিতে মিলিতে চায়॥
সেই এক আশা করি দুইজনে মিলিয়াছে,
সেই এক লক্ষ্য ধরি দুইজনে চলিয়াছে।
পথে বাধা শত শত, পাষাণ পর্বত কত,
দুই বলে এক হয়ে ভাঙিয়া ফেলিবে তায়॥
অবশেষে জীবনের মহাযাত্রা ফুরাইলে
তোমারি স্নেহের কোলে যেন গো আশ্রয় মিলে,
দুটি হৃদয়ের সুখ দুটি হৃদয়ের দুখ
দুটি হৃদয়ের আশা মিলায় তোমার পায়॥
পরবর্তীকালে কিন্তু নরেন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথ এই দুই
মহাহৃদয়ের নদীকে আর একত্রে মিলতে খুব
কমই দেখা গেছে। আমরা সে বিষয়ে যাব না। দুজনই ছিলেন ভারতমাতার দুই কৃতিসন্তান। ভারতমাতার (ভারতবর্ষ) যশ ও
কীর্তিকে তাঁরা ছড়িয়ে
দিয়েছিলেন ভারতের গন্ডি ছেড়ে দেশ দেশান্তরে। তবে স্বামী বিবেকানন্দ যখন ভারতের বিজয়ধ্বজ ওড়াচ্ছিলেন পাশ্চাত্যে
তখনো রবীন্দ্রনাথ আছেন পাদপ্রদীপের
নিচে। বৃটিশ ভারতে পরাধীনতার গ্লানি দু’জনই উপলব্ধি করেছিলেন তীব্রভাবে। তবে কবিগুরুর প্রকাশের
মাত্রা স্বামী বিবেকানন্দের মত খাপখোলা নয় বলেই মনে হয়। কবিগুরুর দেশপ্রেম জাগানিয়া রচনার অধিকাংশই রচিত হয়েছে বিবেকানন্দের প্রয়াণের পর। মূখ্যত
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়ে। প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে তাঁর সংযোগ না থাকলেও তিনি দেশকে নিয়ে,
দেশের রাজনীতি নিয়ে, স্বরাজ নিয়ে তার সুস্পষ্ট অভিমতকে তুলে ধরেছেন নানা ভাবে। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসকে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ
করে ‘দেশনায়ক’ উপাধি দিয়ে তিনি তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্যকে পরিস্ফুট করেছিলেন সর্বসমক্ষে। সেদিনই তিনি আবৃত্তি করে শোনান ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল’
এই কবিতাটি। রবীন্দ্রনাথ মনে প্রাণে অনুভব
করেছিলেন বৃহৎ জাতীয় সংহতি ব্যাতিরেকে ভারতকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করা যাবেনা। কেবল বৃটিশরাজকে দোষারোপ ও ইংরেজ ভারত ছাড়লে তাতেই
ভারতের কল্যাণ এই ধারণা কবিগুরু পোষণ করতেন না। তিনি সর্বাগ্রে চেয়েছিলেন ভাইয়ে-ভাইয়ে মিলন,
হিন্দু-মুসলিমে মিলন, ধনী-গরীবে মিলন! একটা ভূখন্ড নিয়েই একটা দেশ হয়না শুধু, দেশের জনসাধারণই
হল দেশের প্রাণ! কবিগুরু লিখছেন-
“আমরা নিজেরাই নিজেদের দলনের উপায়, অগ্রসর হইয়া প্রতিবন্ধক, এ কথা যখন নিঃসংশয়রূপে ধরা পড়িল তখন এই কথাই আমাদিগকে বলিতে হইবে যে, স্বদেশকে উদ্ধার করিতে হইবে, কিন্তু কাহার হাত হইতে? নিজেদের পাপ হইতে।
......... ইংরেজ সমস্ত ভারতবর্ষের কাঁধের উপরে এমন করিয়া যে চাপিয়া বসিয়াছে, সে কি কেবল নিজের জোরে। আমাদের পাপই ইংরেজের প্রধান বল। ইংরেজ আমাদের ব্যাধির একটা লক্ষণ মাত্র। লক্ষণের দ্বারা ব্যাধির পরিচয় পাইয়া ঠিকমত প্রতিকার করিতে না পারিলে গায়ের জোরে অথবা বন্দেমাতরম্ মন্ত্র পড়িয়া সন্নিপাতের হাত এড়াইবার কোনো সহজ পথ নাই।.........বিদেশী রাজা চলিয়া গেলেই দেশ যে আমাদের স্বদেশ হইয়া উঠিবে তাহা নহে। দেশকে আপন চেষ্টায় আপন দেশ করিয়া গড়িয়া তুলিতে হয়। অন্নবস্ত্র-সুখস্বাস্থ্য-শিক্ষাদীক্ষা দানে দেশের লোকই দেশের লোকের সর্বপ্রধান সহায়, দুঃখে বিপদে দেশের লোকই দেশের জন্য প্রাণপণ করিয়া থাকে, ইহা যেখানকার জনসাধারণে প্রত্যক্ষভাবে জানে সেখানে স্বদেশ যে কী তাহা বুঝাইবার জন্য এত বকাবকি করিতে হয় না। আজ আমাদের ইংরেজি-পড়া শহরের লোক যখন নিরক্ষর গ্রামের লোকের কাছে গিয়া বলে ‘আমরা উভয়ে ভাই’– তখন এই ভাই কথাটার মানে সে বেচারা কিছুই বুঝিতে পারে না। যাহাদিগকে আমরা ‘চাষা বেটা’ বলিয়া জানি, যাহাদের সুখদুঃখের মূল্য আমাদের কাছে অতি সামান্য, যাহাদের অবস্থা জানিতে হইলে আমাদিগকে গবর্মেন্টের প্রকাশিত তথ্যতালিকা পড়িতে হয়, সুদিনে দুর্দিনে আমরা যাহাদের ছায়া মাড়াই না, আজ হঠাৎ ইংরেজের প্রতি স্পর্ধা প্রকাশ করিবার বেলায় তাহাদের নিকট ভাই-সম্পর্কের পরিচয় দিয়া তাহাদিগকে চড়া দামে জিনিস কিনিতে ও গুর্খার গুঁতা খাইতে আহ্বান করিলে আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সন্দেহ জন্মিবার কথা।” (পরিশিষ্ট)
দেশের আপামর দরিদ্র সাধারণকে অবহেলা করা যে ভারতের মজ্জাগত পাপ তা গভীর ভাবে আন্দোলিত করেছিল কবিগুরুর মন। রবীন্দ্রনাথের কাছে স্বদেশ ছিল এরাই। তিনি সমগ্র ভারতের মর্মস্থল থেকে বিচ্ছুরিত বেদনাকে অনুভব করতে চেয়েছিলেন। ভাইয়ে-ভাইয়ে এত বিভেদ দেখে ভারতজননী কতটা বিমর্ষা ছিল তা বুঝেই হয়ত কবি লিখেছিলেন এই প্রেরণার গান-
আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে ।
ঘরের হয়ে পরের মতন ভাই ছেড়ে ভাই ক’দিন থাকে ?।
প্রাণের মাঝে থেকে থেকে ‘আয়’ ব'লে ওই ডেকেছে কে,
সেই গভীর স্বরে উদাস করে–আর কে কারে ধরে রাখে ?।
যেথায় থাকি যে যেখানে বাঁধন আছে প্রাণে প্রাণে,
সেই প্রাণের টানে টেনে আনে–সেই প্রাণের বেদন জানে না কে ?।
মান অপমান গেছে ঘুচে, নয়নের জল গেছে মুছে–
সেই নবীন আশে হৃদয় ভাসে ভাইয়ের পাশে ভাইকে দেখে ॥
কত দিনের সাধনফলে মিলেছি আজ দলে দলে–
আজ ঘরের ছেলে সবাই মিলে দেখা দিয়ে আয় রে মাকে ॥
“আমরা নিজেরাই নিজেদের দলনের উপায়, অগ্রসর হইয়া প্রতিবন্ধক, এ কথা যখন নিঃসংশয়রূপে ধরা পড়িল তখন এই কথাই আমাদিগকে বলিতে হইবে যে, স্বদেশকে উদ্ধার করিতে হইবে, কিন্তু কাহার হাত হইতে? নিজেদের পাপ হইতে।
......... ইংরেজ সমস্ত ভারতবর্ষের কাঁধের উপরে এমন করিয়া যে চাপিয়া বসিয়াছে, সে কি কেবল নিজের জোরে। আমাদের পাপই ইংরেজের প্রধান বল। ইংরেজ আমাদের ব্যাধির একটা লক্ষণ মাত্র। লক্ষণের দ্বারা ব্যাধির পরিচয় পাইয়া ঠিকমত প্রতিকার করিতে না পারিলে গায়ের জোরে অথবা বন্দেমাতরম্ মন্ত্র পড়িয়া সন্নিপাতের হাত এড়াইবার কোনো সহজ পথ নাই।.........বিদেশী রাজা চলিয়া গেলেই দেশ যে আমাদের স্বদেশ হইয়া উঠিবে তাহা নহে। দেশকে আপন চেষ্টায় আপন দেশ করিয়া গড়িয়া তুলিতে হয়। অন্নবস্ত্র-সুখস্বাস্থ্য-শিক্ষাদীক্ষা দানে দেশের লোকই দেশের লোকের সর্বপ্রধান সহায়, দুঃখে বিপদে দেশের লোকই দেশের জন্য প্রাণপণ করিয়া থাকে, ইহা যেখানকার জনসাধারণে প্রত্যক্ষভাবে জানে সেখানে স্বদেশ যে কী তাহা বুঝাইবার জন্য এত বকাবকি করিতে হয় না। আজ আমাদের ইংরেজি-পড়া শহরের লোক যখন নিরক্ষর গ্রামের লোকের কাছে গিয়া বলে ‘আমরা উভয়ে ভাই’– তখন এই ভাই কথাটার মানে সে বেচারা কিছুই বুঝিতে পারে না। যাহাদিগকে আমরা ‘চাষা বেটা’ বলিয়া জানি, যাহাদের সুখদুঃখের মূল্য আমাদের কাছে অতি সামান্য, যাহাদের অবস্থা জানিতে হইলে আমাদিগকে গবর্মেন্টের প্রকাশিত তথ্যতালিকা পড়িতে হয়, সুদিনে দুর্দিনে আমরা যাহাদের ছায়া মাড়াই না, আজ হঠাৎ ইংরেজের প্রতি স্পর্ধা প্রকাশ করিবার বেলায় তাহাদের নিকট ভাই-সম্পর্কের পরিচয় দিয়া তাহাদিগকে চড়া দামে জিনিস কিনিতে ও গুর্খার গুঁতা খাইতে আহ্বান করিলে আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সন্দেহ জন্মিবার কথা।” (পরিশিষ্ট)
দেশের আপামর দরিদ্র সাধারণকে অবহেলা করা যে ভারতের মজ্জাগত পাপ তা গভীর ভাবে আন্দোলিত করেছিল কবিগুরুর মন। রবীন্দ্রনাথের কাছে স্বদেশ ছিল এরাই। তিনি সমগ্র ভারতের মর্মস্থল থেকে বিচ্ছুরিত বেদনাকে অনুভব করতে চেয়েছিলেন। ভাইয়ে-ভাইয়ে এত বিভেদ দেখে ভারতজননী কতটা বিমর্ষা ছিল তা বুঝেই হয়ত কবি লিখেছিলেন এই প্রেরণার গান-
আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে ।
ঘরের হয়ে পরের মতন ভাই ছেড়ে ভাই ক’দিন থাকে ?।
প্রাণের মাঝে থেকে থেকে ‘আয়’ ব'লে ওই ডেকেছে কে,
সেই গভীর স্বরে উদাস করে–আর কে কারে ধরে রাখে ?।
যেথায় থাকি যে যেখানে বাঁধন আছে প্রাণে প্রাণে,
সেই প্রাণের টানে টেনে আনে–সেই প্রাণের বেদন জানে না কে ?।
মান অপমান গেছে ঘুচে, নয়নের জল গেছে মুছে–
সেই নবীন আশে হৃদয় ভাসে ভাইয়ের পাশে ভাইকে দেখে ॥
কত দিনের সাধনফলে মিলেছি আজ দলে দলে–
আজ ঘরের ছেলে সবাই মিলে দেখা দিয়ে আয় রে মাকে ॥
রবীন্দ্রজীবনে প্রকৃতি, প্রেম, দেশপ্রেম, আত্মানুসন্ধান, সমাজদর্শন,
প্রভৃতি গুণাবলীর এমন সমঞ্জসতাপূর্ণ সমাবেশ ছিল
যা পৃথিবীর কতজন কবির জীবনে প্রকাশ পেয়েছিল তা গবেষণাযোগ্য বিষয়। রবীন্দ্রপূর্ব বা রবীন্দ্রউত্তর যুগেও এমন প্রতিভা আজও পরিলক্ষিত হয়নি এই কথা
অকপটে মেনে নেবেন অনেকেই। সুদীর্ঘ একটি জীবন পেয়েছিলেন কবিগুরু। সেই জীবনটিকে তিনি ভরিয়েছিলেন নানা রূপের, নানা রসের,
নানা ভাবের বৈচিত্র্যতায়। কবি শুধু
বিশ্বপ্রকৃতির বিচিত্র শোভা
দেখেই বিমোহিত ছিলেন না নিজেই যেন হয়ে গিয়েছিলেন সেই বৈচিত্র্যতার মূর্তবিগ্রহ তাঁর বিরাট রচনাসম্ভারের মধ্য
দিয়ে। কবিগুরু লিখছেন-
‘হাসি দেখিয়া হাসে গম্ভীর পর্ব্বত, সে
হাসি দেখিয়া হসে উথল জলধি, সে
হাসি দেখিয়া হাসে দরিদ্র কুটীর। হে
প্রকৃতিদেবি তুমি মানুষের মন কেমন
বিচিত্র ভাবে রেখেছ পূরিয়া, করুণা,
প্রণয়, স্নেহ, সুন্দর শোভন-ন্যায়,
ভক্তি, ধৈর্য্য আদি সমুচ্চ মহান্-ক্রোধ,
দ্বেষ, হিংসা আদি ভয়ানক ভাব, নিরাশা
মরুর মত দারুণ বিষণ্ন-তেমনি আবার
এই বাহির জগৎ বিচিত্র বেশভূষায়
করেছ সজ্জিত। তোমার বিচিত্র কাব্য-
উপবন হোতে তুলিয়া সুরভি ফুল
গাঁথিয়া মালিকা, তোমারি চরণতলে দিব
উপহার!” এইরূপে সুনিস্তব্ধ নিশীথ-
গগনে প্রকৃতি-বন্দনা-গান গাইত সে কবি।’
এই পৃথিবীর সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, হিংসা-প্রেম, জয়-পরাজয় সকল কিছুর মাঝেই কবিগুরু প্রকৃতির এক অনির্বচনীয় লীলাকে অনুভব করতেন। যারা আচরণের ধরন সর্বদা অনির্দেশ্য। যে মহাকালের বুকের ওপর সর্বদা ক্রিয়াশীলা হয়ে ধরণীকে করে রেখেছে চঞ্চলা সেই আদিপ্রকৃতিকে রবীন্দ্রনাথ যে কেবল ভক্তের আর্তি নিয়ে প্রকাশিত হবার আবাহন করেছেন তা নয় তিনি মৌন হয়ে আস্বাদন করছিলেন সেই চঞ্চলতার মাধুর্য্যরস। সরল প্রাণে নিরব হয়ে বসেছিলেন সেই কালের প্রবাহের সাথে নিজেকে মিলিয়ে নেবার জন্য। জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলেন কালের পদবিক্ষেপের তাল। কবি কল্পনায় কালও হয়ে উঠেছিল মূর্তিমান। অতি বিচিত্রভাবে ফুটেছিল সে রূপ-
দুই হাতে–
কালের মন্দিরা যে সদাই বাজে ডাইনে বাঁয়ে দুই হাতে,
সুপ্তি ছুটে নৃত্য উঠে নিত্য নূতন সংঘাতে॥
বাজে ফুলে, বাজে কাঁটায়, আলোছায়ার জোয়ার-ভাঁটায়,
প্রাণের মাঝে ওই-যে বাজে দুঃখে সুখে শঙ্কাতে॥
তালে তালে সাঁঝ-সকালে রূপ-সাগরে ঢেউ লাগে।
সাদা-কালোর দ্বন্দ্বে যে ওই ছন্দে নানান রঙ জাগে।
এই তালে তোর গান বেঁধে নে– কান্নাহাসির তান সেধে নে,
ডাক দিল শোন্ মরণ বাঁচন নাচন-সভার ডঙ্কাতে॥
“ডাক দিল শোন্ মরণ বাঁচন নাচন-সভার ডঙ্কাতে।” কবিগুরু প্রকৃত অর্থেই হতে পেরেছিলেন এই সভার সভাকবি। মরিয়া প্রমাণ করিলেন রবীন্দ্রনাথ মরিতে পারেন না! তিনি আছেন বাংলার আকাশে বাতাসে, শ্যামল বিটপী বনে, গোচারণভূমিতে, রাখালের বাঁশীতে, নদীর পাড়ে, প্রতিটি বাঙালির অন্তর্চেতনায় মিশে। কবিগুরুকে জানাই কোটি কোটি প্রণাম।
‘হাসি দেখিয়া হাসে গম্ভীর পর্ব্বত, সে
হাসি দেখিয়া হসে উথল জলধি, সে
হাসি দেখিয়া হাসে দরিদ্র কুটীর। হে
প্রকৃতিদেবি তুমি মানুষের মন কেমন
বিচিত্র ভাবে রেখেছ পূরিয়া, করুণা,
প্রণয়, স্নেহ, সুন্দর শোভন-ন্যায়,
ভক্তি, ধৈর্য্য আদি সমুচ্চ মহান্-ক্রোধ,
দ্বেষ, হিংসা আদি ভয়ানক ভাব, নিরাশা
মরুর মত দারুণ বিষণ্ন-তেমনি আবার
এই বাহির জগৎ বিচিত্র বেশভূষায়
করেছ সজ্জিত। তোমার বিচিত্র কাব্য-
উপবন হোতে তুলিয়া সুরভি ফুল
গাঁথিয়া মালিকা, তোমারি চরণতলে দিব
উপহার!” এইরূপে সুনিস্তব্ধ নিশীথ-
গগনে প্রকৃতি-বন্দনা-গান গাইত সে কবি।’
এই পৃথিবীর সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, হিংসা-প্রেম, জয়-পরাজয় সকল কিছুর মাঝেই কবিগুরু প্রকৃতির এক অনির্বচনীয় লীলাকে অনুভব করতেন। যারা আচরণের ধরন সর্বদা অনির্দেশ্য। যে মহাকালের বুকের ওপর সর্বদা ক্রিয়াশীলা হয়ে ধরণীকে করে রেখেছে চঞ্চলা সেই আদিপ্রকৃতিকে রবীন্দ্রনাথ যে কেবল ভক্তের আর্তি নিয়ে প্রকাশিত হবার আবাহন করেছেন তা নয় তিনি মৌন হয়ে আস্বাদন করছিলেন সেই চঞ্চলতার মাধুর্য্যরস। সরল প্রাণে নিরব হয়ে বসেছিলেন সেই কালের প্রবাহের সাথে নিজেকে মিলিয়ে নেবার জন্য। জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলেন কালের পদবিক্ষেপের তাল। কবি কল্পনায় কালও হয়ে উঠেছিল মূর্তিমান। অতি বিচিত্রভাবে ফুটেছিল সে রূপ-
দুই হাতে–
কালের মন্দিরা যে সদাই বাজে ডাইনে বাঁয়ে দুই হাতে,
সুপ্তি ছুটে নৃত্য উঠে নিত্য নূতন সংঘাতে॥
বাজে ফুলে, বাজে কাঁটায়, আলোছায়ার জোয়ার-ভাঁটায়,
প্রাণের মাঝে ওই-যে বাজে দুঃখে সুখে শঙ্কাতে॥
তালে তালে সাঁঝ-সকালে রূপ-সাগরে ঢেউ লাগে।
সাদা-কালোর দ্বন্দ্বে যে ওই ছন্দে নানান রঙ জাগে।
এই তালে তোর গান বেঁধে নে– কান্নাহাসির তান সেধে নে,
ডাক দিল শোন্ মরণ বাঁচন নাচন-সভার ডঙ্কাতে॥
“ডাক দিল শোন্ মরণ বাঁচন নাচন-সভার ডঙ্কাতে।” কবিগুরু প্রকৃত অর্থেই হতে পেরেছিলেন এই সভার সভাকবি। মরিয়া প্রমাণ করিলেন রবীন্দ্রনাথ মরিতে পারেন না! তিনি আছেন বাংলার আকাশে বাতাসে, শ্যামল বিটপী বনে, গোচারণভূমিতে, রাখালের বাঁশীতে, নদীর পাড়ে, প্রতিটি বাঙালির অন্তর্চেতনায় মিশে। কবিগুরুকে জানাই কোটি কোটি প্রণাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন